November 22, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Wednesday, February 7th, 2024, 9:56 pm

অপরিশোধিত তেলের শুল্ক নিয়ে দ্বৈত নীতির কারণে সমস্যায় ব্যবসায়ীরা

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

সরকারি ও বেসরকারি খাতের অপরিশোধিত তেল আমদানিতে শুল্ক নির্ধারণের জন্য সরকারের দ্বৈত নীতির কারণে বেসরকারি উদ্যোক্তারা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন, যা অপরিশোধিত তেল আমদানিকারকদের সবার জন্য অভিন্ন নীতির দাবি। এই খাতের সাথে জড়িতরা জানান, চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) কর্তৃক আমদানিকৃত অপরিশোধিত তেল পরিষ্কার করার জন্য ট্যারিফ মূল্যের উপর ভিত্তি করে শুল্ক ধার্য করে, তবে তারা বেসরকারি আমদানিকারকদের কাছে চালানের মূল্যের ভিত্তিতে শুল্ক ধার্য করে। একই এইচএস কোডের অধীনে আমদানিকৃত পণ্য।

বিপিসি পণ্যের চালান মূল্যের ক্ষেত্রে পণ্যের উপর আরোপিত শুল্ক সঠিকভাবে বিবেচনা না করে পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) পরবর্তীতে পণ্যের মূল্যের উপর ভিত্তি করে আরও অর্থ প্রদানের জন্য বিপিসিকে ডিমান্ড নোট জারি করে, যা বিপিসি তার মূল্য নির্ধারণের সূত্রে অন্তর্ভুক্ত করে না। এখানে সরকারি ও বেসরকারি খাতের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্বৈত নীতি পরিলক্ষিত হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, একটি দেশে একই আমদানি পণ্যের ওপর কর আরোপের জন্য দুটি নীতি থাকতে পারে না।

অপরিশোধিত তেল আমদানির ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি উভয় কোম্পানির জন্য শুল্ক একই পদ্ধতিতে নির্ধারণ করতে হবে। শুল্ক মূল্যায়ন করে বা চালান মূল্যের উপর শুল্ক মূল্যায়ন করে জ্বালানির মূল্য নির্ধারণ করা উচিত। সার্বিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স্বয়ংক্রিয় মূল্য সমন্বয় ব্যবস্থা চালুর বিকল্প নেই বলেও জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে বৈশ্বিক বাজারের সাথে সামঞ্জস্য রেখে স্বয়ংক্রিয় মূল্য সমন্বয় ব্যবস্থা চালু করার আগে সরকারকে অবশ্যই দ্বৈত করের নীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সরকারী এবং বেসরকারী উভয় ক্ষেত্রেই একই নীতিতে মূল্য নির্ধারণ করা উচিত। তবেই আর্থিক সংকট কেটে যাবে এবং জ্বালানি চোরাচালান রোধ করা সম্ভব হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কর আদায়ে দ্বৈত নীতির কারণে বেসরকারি তেল আমদানিকারকদের আমদানি ব্যয় বাড়ছে। একই সঙ্গে তাদের দিতে হবে অতিরিক্ত ভ্যাট। বেসরকারী আমদানিকারকদের দ্বারা প্রদত্ত শুল্ক বিপিসি কর্তৃক প্রদত্ত শুল্কের দ্বিগুণেরও বেশি। ফলে তারা ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ঋণ বিতরণের জন্য গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে একটি “স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণের ফর্মুলা” বাস্তবায়নের শর্ত আরোপ করেছিল, কিন্তু সরকার এখনও তা পূরণ করতে পারেনি। ফলে ইতিমধ্যেই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বকেয়া আর্থিক ভর্তুকি পরিশোধের চাপে রয়েছে সরকার।

এ অবস্থা চলতে থাকলে চলমান আর্থিক সংকট থেকে উত্তরণের কোনো পথ থাকবে না। আইএমএফের শর্ত দ্রুত বাস্তবায়ন না হলে আর্থিক চাপ বাড়বে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ এবং বিপিসির কর্মকর্তারা বলেছেন, সরকার আইএমএফের শর্ত পূরণের জন্য চলতি বছরের এপ্রিল থেকে বিশ্ববাজারের দাম বিবেচনায় নিয়ে নিয়মিত ডিজেল, পেট্রোল, অকটেন এবং জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করার উদ্যোগ নিয়েছে। জ্বালানির স্বয়ংক্রিয় মূল্য সমন্বয়ের জন্য সরকার যে ফর্মুলা বিবেচনা করেছে তা কখনই দেশের আর্থিক সংকট সমাধান করতে পারবে না, তেল চোরাচালান রোধ করতে পারবে না।

বিপাকে পড়েছে চট্টগ্রাম কাস্টমস

রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন ও পেট্রোবাংলার বকেয়া ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা নিয়ে বড় ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস। বিপুল পরিমাণ পাওনা থাকায় এটি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বারবার চিঠি দিয়েও বিপিসি ও পেট্রোবাংলার কাছ থেকে সাড়া না পাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস থেকে এনবিআরকে দেওয়া চিঠিতে বিপিসি ও পেট্রোবাংলার রাজস্ব বকেয়া আটকে রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে।

চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের ডেপুটি কমিশনার ব্যারিস্টার মোঃ বদরুজ্জামান মুন্সী বলেন, আমরা আশা করছি, চলতি অর্থবছরে বিপিসি ও পেট্রোবাংলাসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বকেয়া রাজস্ব আদায় হলে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস কর্তৃপক্ষ তাদের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সক্ষম হবে। স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণের বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, আমরা জ্বালানি তেলের বাজার বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিয়েছি। চলতি বছরের এপ্রিলের মধ্যে দেশে জ্বালানি তেলের বাজারে ডাইনামিক প্রাইসিং সিস্টেম চালু করা হবে। ঋণের কত শর্ত পূরণ হয়েছে তা দেখতে ২০২৩ সালের অক্টোবরে আইএমএফের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আসে।

রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে আইএমএফ প্রতিনিধিদল অর্থ মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ বিভাগ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ এবং বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (বিপিডিবি) সহ বিভিন্ন সংস্থার সাথে সর্বশেষ বৈঠক করেছে। ওই বৈঠকে দাম সমন্বয় করে জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানোর আহ্বান জানায় আইএমএফ। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেন, “বিভিন্ন দেশ এখন জ্বালানি তেলের প্রাতিষ্ঠানিক মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি থেকে দূরে সরে গেছে। এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতও অনেক আগেই অটোমেটেড ফর্মুলা-ভিত্তিক সিস্টেমে চলে গেছে।

ভারত যে সূত্রে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ করছে সেই সূত্র আমাদের গ্রহণ করতে হবে। দেখা যায় প্রতি মাসে তেলের দাম পরিবর্তন হচ্ছে। দাম কমলে লাভবান হবেন ভোক্তারা। এটা করা এখন খুবই জরুরি, কারণ এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে তেল চোরাচালানও কমবে। আইএমএফ ঋণের তৃতীয় ও চতুর্থ ধাপ পেতে বাংলাদেশকে এ বছর বড় ধরনের সংস্কার করতে হবে। তৃতীয় কিস্তি জুন মাসে প্রকাশ করার কথা রয়েছে, যার আগে সংস্থাটি ঋণ কর্মসূচির আরেকটি পর্যালোচনা পরিচালনা করবে। তৃতীয় কিস্তির জন্য বাস্তবায়ন করা সংস্কারগুলির মধ্যে একটি হল জ্বালানি মূল্য সমন্বয়।

৩০ জানুয়ারী ২০২৩-এ, আইএমএফ বাংলাদেশের জন্য মোট ৪.৭ বিলিয়ন ঋণ অনুমোদন করেছে, যা সাড়ে তিন বছরে সাত কিস্তিতে বিতরণ করা হবে। আইএমএফ পর্যায়ক্রমে তাদের ৩৮টি শর্ত পূরণের প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। দ্বিতীয় ধাপের ঋণ বিতরণের সময় আইএমএফ বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছে। আগামী জুনের আগে সরকার প্রদত্ত ভর্তুকিতে দুটি প্রধান শর্ত রয়েছে। শর্তগুলির মধ্যে একটি হল আন্তর্জাতিক বাজারে দামের ওঠানামার সাথে সামঞ্জস্য রেখে স্থানীয় বাজারে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করার জন্য সরকারকে একটি “মূল্য নির্ধারণের কৌশল” তৈরিতে কাজ করতে হবে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় এখন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিষয়ে আইএমএফের দেওয়া শর্ত ও পরামর্শ পর্যালোচনা করছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আইএমএফের পরামর্শ অনুযায়ী সরকার এ খাতে ব্যাপক সংস্কার করেছে। ইতোমধ্যে কয়েক দফা বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম। এরপরও এ খাতে বকেয়া আর্থিক ভর্তুকি পরিশোধে সরকারের ওপর চাপ রয়েছে।

আইএমএফের মতে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সরকারের ভর্তুকি ধাপে ধাপে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে। স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ ব্যবস্থা চালুর পর বিশ্ববাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রতি মাসে জ্বালানির দাম নির্ধারণের পরিকল্পনা করছে সরকার। মূল্য নির্ধারণের প্রক্রিয়া সম্পর্কে, বিপিসি কর্মকর্তারা বলেছেন, সূত্রটির দুটি অংশ থাকবে। একটি বিভাগে প্রিমিয়াম (মালবাহী এবং অন্যান্য), কর, বিপণন মার্জিন এবং ডিলারদের কমিশনের একটি নির্দিষ্ট অংশ থাকবে, যা সাধারণত পরিবর্তন হবে না। অন্য অংশ আন্তর্জাতিক মূল্য অনুযায়ী বাড়বে বা কমবে। ফর্মুলা তৈরিতে ভারতের জ্বালানি তেলের দামও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। প্রতিবেশী দেশগুলোতে জ্বালানি তেল পাঁচার বন্ধে ভারতের বাজারদর অনুযায়ী বাংলাদেশে তেলের দাম নির্ধারণ করা হবে বলেও জানান তারা। বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে জ্বালানি তেলের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৭৫ লাখ টন। এর মধ্যে ডিজেলের চাহিদা ৫০ লাখ টন।