নিজস্ব প্রতিবেদক:
কারখানায় মর্মান্তিক বিস্ফোরণ, অগ্নিকান্ডের ঘটনা একটি সাধারণ চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদায়ী ২০২১ সালে এমন অসংখ্য মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে গোটা দেশ। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে কেমিক্যাল কারখানাগুলোতে দুর্ঘটনার মাত্রা ভয়ানক বেড়ে গেছে। এটি সত্যি দারুণ উদ্বেগজনক। কেননা এই ধরণের দুর্ঘটনয়ায় নিরীহ কর্মীরা বেদনাদায়ক মৃত্যুর স্বীকার হয়ে থাকেন। পাশাপাশি আর্থিক ক্ষতির ব্যাপারটা তো থাকলোই।
জানা যায়, দেশে বৈধ কেমিক্যাল কারখানা ছাড়াও যত্রতত্র ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে অসংখ্য অবৈধ কেমিক্যাল কারখানা। আমদানি করা কেমিক্যাল বিস্ফোরক অধিদপ্তরের অনুমোদিত গোডাউনে মজুতের নিয়ম থাকলেও এসব কারখানায় তা মানা হচ্ছে না। পুরান ঢাকাসহ রাজধানীতে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের অনুমোদিত গোডাউন রয়েছে ১৩৭টি। অথচ সেখানে কেমিক্যাল গোডাউন রয়েছে প্রায় ৫ হাজার।
সূত্র জানায়, বৈধ লাইসেন্স ছাড়াই আরমানিটোলা, বাবুবাজার, মিটফোর্ড, চকবাজার, লালবাগ, ইসলামপুর ও চাঁনখারপুলসহ আশপাশের এলাকার আবাসিক ভবনে স্থাপন করা হয়েছে এসব গোডাউন। মার্কেট ও জনবহুল বিপণিবিতানেও স্থাপন করা হয়েছে গোডাউন। প্রায় প্রতিটি বাড়ির নিচের বেজমেন্টে গোডাউন রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অতি দাহ্য পদার্থ ও কম দাহ্য পদার্থ, যা খুবই বিপদজনক।
এই সব অবৈধ কেমিক্যাল কারখানার মালিকদের হাত খুব লম্বা। ফলে প্রশাসন চাইলেও কিছু করতে পারছে না। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তারা বহাল তবিয়তে ‘প্রাণঘাতী’ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
এটি কারও অজানা নেই যে, ঢাকা, বিশেষকরে পুরান ঢাকা ঘনবসতি এলাকা। এখানে বিল্ডিঙের পর বিল্ডিং পাশাপাশি ঘেঁষা। এসব বিল্ডিঙের অধিকাংশের অবস্থাও বেশ করুণ। আর এতে মানুষ থাকে ধারণক্ষমতার চেয়েও বেশ অধিক। এমন ঘন জনবসতি এলাকায় ঝুকিপূর্ণ এমন কেমিক্যাল কারখানার অবস্থান যে কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় সে ব্যাপারে বিভিন্ন সময়ে প্রতিবাদ হয়েছে। কিন্তু ‘অদৃশ্য শক্তির’ ইশারায় ঢাকা থেকে সরানো যাচ্ছে না রাসায়নিক কারখানা আর এর গুদামগুলো। কারখানাগুলো সরানোর জন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বারবার তাগাদা দিচ্ছে। গোয়েন্দা ও এলাকাবাসী বলছে, এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা প্রভাবশালী। স্থানীয় রাজনীতিকদের সঙ্গে সখ্য বা অনেকে নিজেই নেতা। ফলে ঢাকা থেকে সরানো যাচ্ছে না কারখানাগুলো। এলাকায় গিয়েও এর সত্যতা মিলেছে। ২০১০ সালের ৩ জুন রাতে পুরান ঢাকার নিমতলীতে ভয়াবহ আগুন লেগে ১২৪ জনের প্রাণহানির পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়েছিল ঢাকার মধ্যে আর কোনো কারখানা থাকবে না। কিন্তু ওই সিদ্ধান্ত আর বাস্তবায়িত হয়নি। এত প্রাণহানি হওয়ার পরও অসাধু ব্যবসায়ীরা ঠিকই তাদের কর্মকা- চালাচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, প্রভাবশালী মহলের হস্তক্ষেপে কেমিক্যাল পল্লী গড়ে তোলার প্রক্রিয়াও থেমে আছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গেলে মিলছে রাজনৈতিক বাধা। কেরানীগঞ্জে রাসায়নিক পল্লী গড়ে তুলতে স্বরাষ্ট্র ও শিল্প মন্ত্রণালয় একাধিক কমিটি গঠন করেলেও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি এ ব্যাপারে।
এটি স্পষ্ট যে, কেমিক্যাল কারখানা বা গুদাম তৈরির জন্য ‘বিস্ফোরক অ্যাক্ট-১৮৮৪ এবং সিলিন্ডার বিধিমালা-১৯৯১’ তে সুনির্দিষ্ট কিছু বিধিমালা আছে। কিন্তু এসব বিধিমালার তোয়াক্কা না করে গড়ে উঠছে এসব অবৈধ কেমিক্যাল গোডাউন। অধিকাংশেরই বৈধ কাগজপত্র ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের অনুমোদন নেই। বিস্ফোরক অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন ও পুলিশের সামনেই কেমিক্যালগুলো গোডাউনে মজুত করা হচ্ছে। অনিরাপদ অবস্হায় এসব কেমিক্যাল গুদাম থেকে ট্রাক, পিকআপ ও ঠেলাগাড়িতে করে বিভিন্ন স্থানে পরিবহন করা হয়। অভিযোগ আছে, কেমিক্যাল সংশ্লিষ্ট বড় ধরনের দুর্ঘটনার পর কিছুদিন সিটি করপোরেশন আরো কয়েকটি সংস্থার সহায়তায় চালায় অবৈধ কেমিক্যাল গোডাউন উচ্ছেদ অভিযান। কিছুদিন পর অভিযান ঝিমিয়ে পড়ে। হাজার হাজার অবৈধ কেমিক্যালের দোকান ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বাণিজ্য করলেও সংশ্লিষ্টদের গ্রেফতার তো দূরের কথা, মামলা পর্যন্ত দায়ের হয় না।
রাজনৈতিক অপশক্তিতে টিকে থাকা এসব অবৈধ কারখানাতেই সিংহভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে। নিরীহ মানুষকে বরণ করতে হচ্ছে অমানবিক মৃত্যু। ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, গত ১০ বছরে প্রায় ১ লাখ ৬৮ হাজারের বেশি অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে। এর প্রায় সবগুলোই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অবহেলাজনিত কারণে হয়েছে। যার সূত্রপাত হয়েছিল অনিরাপদ ও অবৈধ গোডাউনে কেমিক্যাল মজুতের কারণে। বেশির ভাগ ব্যবসায়ী শুধু ট্রেড লাইসেন্স নিয়েই কেমিক্যাল ব্যবসা করছেন। তারা চরম বিপজ্জনক কেমিক্যাল মজুত, পরিবহন ও বিক্রির ক্ষেত্রে আইনের বাধ্যবাধকতা মানছেন না।
জানা যায়, কেমিক্যাল কারখানাগুলো বিস্ফোরক অধিদপ্তর অনুমোদিত ৩১ ধরনের কেমিক্যালের বাইরে আরো বহু ধরনের কেমিক্যাল আমদানি করা হয়। এসব কেমিক্যাল সিটি করপোরেশনের ট্রেড লাইসেন্সের বিপরীতে আমদানি ও মজুদ করা হয়। তবে গত ১০ বছর ধরে সিটি করপোরেশনের এই ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন স্থগিত রয়েছে। এসব কেমিক্যাল মজুত করার জন্য শিল্প মন্ত্রণালয় মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে ‘কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক’নির্মাণ করছে। সেটি চালু না হওয়া পর্যন্ত পুরান ঢাকার বিভিন্ন ভবনে কেমিক্যাল গোডাউন রয়েছে। দক্ষিণ সিটি করপোরেশন রাসায়নিক ব্যবসার জন্য নতুন ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ রেখেছে। সিটি করপোরেশন বলছে, ২০১৯ সালের পর আর কোনো লাইসেন্স দেওয়া হয়নি। এমনকি আগের লাইসেন্সও নবায়ন করা হয়নি। কিন্তু কেমিক্যাল গোডাউনের ব্যবসা ঠিকই চলছে।
ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এক হাজার ৭০০ কেমিক্যাল কারখানা আছে। শুধু ঢাকায় আছে ৯৯৪টি। এর মধ্যে রমনা, মতিঝিল ও পল্টন জোনে ৬৬, কামরাঙ্গীরচর ও লালবাগে ৮৭, সূত্রাপুর ও কোতোয়ালিতে ৩৭৮, হাজারীবাগ ও নিউ মাকের্টে ৫, তেজগাঁও ও গুলশানে ৬৮, মিরপুর, পল্লবী, শাহআলী ও কাফরুলে ৯০, মোহাম্মদপুর, আদাবর ও শ্যামলীতে ২০৩, সবুজবাগ, যাত্রাবাড়ী ও শ্যামপুরে ৪৩, বাড্ডা, বারিধারা, উত্তরা ও তুরাগে ৫ এবং তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে ৩০টি কারখানা আছে। এর মধ্যে লাইসেন্স নেই ৮৬৭টির। এ প্রসঙ্গে ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা জানান, অবৈধ কারখানাগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চালানো যাচ্ছে না। বেশির ভাগ কারখানার মালিক রাজনৈতিক দলের নেতা। কিছুদিন আগে পুরান ঢাকায় অভিযান চালাতে গেলে স্থানীয় নেতাদের রোষানলে পড়তে হয়েছে। ইতোমধ্যে নতুন করে কেমিক্যাল কারখানার লাইসেন্স দেওয়া ও নবায়ন বন্ধ রাখা হয়েছে।
উল্লেখ্য, নিমতলী ট্র্যাজেডির পর একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ২০১০ সালের ১৫ জুন কমিটি ২৩ দফা সুপারিশ করে। সেগুলো হচ্ছে বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবন নির্মাণ নিশ্চিতকরণ, আগুন নেভানোর জন্য দ্রুত পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে রাজধানীসহ প্রতিটি বিভাগীয় শহরে স্থানীয়ভাবে পৃথক পানির লাইনসহ হাইড্রেন্ট পয়েন্ট স্থাপন নিশ্চিতকরণ, আবাসিক এলাকায় কেমিক্যাল বা বিস্ফোরক-জাতীয় পদার্থ মজুদ ও বিপণন নিষিদ্ধ, বাড়িঘরে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ কেব্লের গুণগত মান ও রাস্তায় স্থাপিত খোলা তার এরিয়াল বান্ডিল কেব্ল্, ইনসুলেটেড তার দিয়ে প্রতিস্থাপন, প্রতিটি ট্রান্সফরমারের স্ট্যান্ডার্ড ক্লিয়ারেন্স রাখাসহ যথাযথ সুরক্ষা ব্যবস্থা, মাসে একবার কারখানা পরিদর্শন, জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন, দাহ্য বস্তুর লাইসেন্স ভিন্ন ভিন্ন দপ্তরের পরিবর্তে সব দপ্তরের সমন্বয় করা, ফায়ার সার্ভিসের অবকাঠামো বাড়ানো, জনসচেতনতা সৃষ্টি করা, পুলিশ-র্যাবের নজরদারি বাড়ানো, সব স্তরের পাঠ্যসূচিতে অগ্নিকান্ড, উদ্ধার ও প্রাথমিক চিকিৎসা বিষয়ে অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করা, কমিউনিটি স্বেচ্ছাসেবক তৈরি করা, কমিউনিটি সেন্টারগুলোকে নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থায় আনা, বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ডেকোরেটরের উপকরণের সঙ্গে প্রয়োজনীয়সংখ্যক অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র রাখা, কেমিক্যাল মজুদ, বাজারজাতকরণ এবং বিক্রির জন্য লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে শর্ত পূরণ, আবাসিক এলাকায় কারখানা না থাকা, এর বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা, বৈধ কারখানাগুলো আবাসিক এলাকা থেকে অপসারণ করা, প্রয়োজনে ব্যাংক লোনের ব্যবস্থা করা এবং অবৈধ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য এসব সুপারিশ শুধু কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ। আজ পর্যন্ত এর কোনটিই বাস্তবায়ন করেনি।
আরও পড়ুন
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি