April 19, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Sunday, December 5th, 2021, 8:41 pm

অর্থনীতির কোমর ভেঙে দিচ্ছে রাজধানীর যানজট

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

যানজটের রাজা রাজধানী ঢাকা। মানুষ আর যানবাহনের আধিক্যে ধুঁকে ধুঁকে মরছে শহরটি। এই যানজট অর্থনৈতিকভাবেও বিপর্যস্ত করছে দেশকে। ঢাকা শহরের তুমুল যানজটের কারণে বছরে দেশের মোট দেশজ উৎপাদন জিডিপির ২.৫ শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে। গত অর্থবছরের ৩৪ লাখ ৮৪ হাজার কোটি টাকার জিডিপি বিবেচনায় নিলে যার পরিমাণ ৮৭ হাজার কোটি টাকা। পরোক্ষ প্রভাব মিলে ক্ষতি আরও বেশি হবে। অন্যদিকে অপরিকল্পিত নগর সম্প্রসারণের পরোক্ষ ক্ষতি জিডিপির ৬ শতাংশ বা তার বেশি হবে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) উন্নয়নবিষয়ক বার্ষিক সম্মেলনে বৃহস্পতিবার এ তথ্য তুলে ধরা হয়। রাজধানীর একটি হোটেলে সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে ‘ঢাকার অসম সম্প্রসারণ ও এর পরিণতি’ শীর্ষক প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) পরিচালক আহমেদ আহসান। বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন এ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে তিন দিনব্যাপী এই সম্মেলন শুক্রবার শেষ হয়।
মূলত, রাজধানীতে যানবাহনের চাপ তুলনামূলকভাবে বেশি গাবতলী, সায়েন্স ল্যাব, এয়ারপোর্ট রোড, কুড়িল বিশ্বরোড, গুলশান ২ নম্বর, মহাখালী, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, কাকরাইল, জিরো পয়েন্ট, বুড়িগঙ্গা ব্রিজ ও পোস্তগোলা ব্রিজ এলাকায়। এর মধ্যে আবার যানবাহনের চাপ সবচেয়ে বেশি এয়ারপোর্ট রোড, মহাখালী ও ফার্মগেট এলাকায়। রাজধানীর রাস্তাগুলোয় সবচেয়ে বেশিসংখ্যক যান চলাচল করে সন্ধ্যা ৬টায়। এ সময় প্রায় ১২ হাজার যানের চাপ পড়ে রাস্তাগুলোয়। রাত ৩টায় সবচেয়ে কম, দেড় হাজার যান চলাচল করে। মূলত সকাল ৬টা থেকে যানবাহনের চাপ বাড়তে থাকে। এ সময় কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ রাজধানীবাসীর যাতায়াত শুরু হয়। সকাল সাড়ে ৮টা নাগাদ যানবাহনের চাপ বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ১০ হাজারে। এরপর তা কিছুটা কমলেও বেলা ২টার পর বাড়তে থাকে।
এই বিষয়গুলোকে মাথায় রেখে রাজধানীর নান্দনিক বাসযোগ্যতা এবং অর্থনৈতিক কর্মকা-ের কেন্দ্র হিসেবে স্বাভাবিক চেহারায় ফিরিয়ে আনতে ড. আহম্মদ আহসান বেশ কয়েকটি সুপারিশ করেছেন বলে সূত্র জানায়। এর মধ্যে ঢাকার মতো আরও কয়েকটি শহর এবং চট্টগ্রামের মতো আরও বাণিজ্য নগরী গড়ে তোলার প্রস্তাব করেন তিনি। তার প্রবন্ধে রাজধানীর বিভিন্ন সেবা এবং বাণিজ্যিক পরিস্থিতিকে আরও উন্নত করা, নগর প্রশাসনকে শক্তিশালী করা এবং বিকেন্দ্রীকরণের সুপারিশ এসেছে। এ ছাড়া নগর গবেষণায় আরও মনোযোগ এবং বিনিয়োগের সুপারিশ করেছেন তিনি। অর্থনীতির পরিসংখ্যান অন্যান্য দেশের মতো হালনাগাদ করার প্রস্তাব দিয়ে তিনি জানান, ঢাকার এ-সংক্রান্ত পরিসংখ্যান প্রায় ১০ বছর আগে একবার করা হয়েছিল।
ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে নতুন নতুন অবকাঠামো গড়ে উঠছে। কিন্তু সেগুলোর ব্যবস্থাপনা ভালো নয়। ব্যবস্থাপনা ভালো না হলে যতই অবকাঠামো গড়ে তোলা হোক না কেন তার পূর্ণ সুফল পাওয়া যাবে না। ঢাকার পরিবহন ও পরিবহন সম্পর্কিত অবকাঠামোর ব্যবস্থাপনা এখনো প্রাথমিক পর্যায়েই রয়ে গেছে। এ অবস্থা থেকে বের হতে হলে আমাদের ঢাকার সঠিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও পরিবহন ব্যবস্থাপনা, পথচারীবান্ধব অবকাঠামো গড়ে তোলা, উন্নত গণপরিবহন প্রবর্তন, গণপরিবহনের জন্য আলাদা লেনের ব্যবস্থা, ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণ, পার্কিং ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের পাশাপাশি সড়ক ব্যবহারীদেরও মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটানোর ওপর বক্তারা গুরুত্ব দিতে বলেছেন বলে সূত্র জানায়।
এটি স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের যত মানুষ শহরে বাস করে, তার বেশির ভাগেরই বসবাস ঢাকায়। প্রধান শহরগুলোতে দেশের মোট জনসংখ্যার ৩১.৯ শতাংশ বসবাস করে। ঢাকায় বাস করে ১১.২ শতাংশ। ১০ লাখের মতো মানুষ বাস করে এমন শহর মাত্র পাঁচটি।
অথচ চীনের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৩৮ কোটি। এর মধ্যে শহরে বাস করে মাত্র ৩.১ শতাংশ। ১০ লাখের মতো মানুষ বাস করে এমন শহর আছে ১০২টি। ভারতের জনসংখ্যা প্রায় ১৩৩ কোটি। এর মধ্যে শহরে বাস করে ৬ শতাংশ মানুষ। সবচেয়ে বড় শহরে বাস করে ২ শতাংশ মানুষ। ১০ লাখের বেশি মানুষের বসবাসের মতো শহর রয়েছে ৫৪টি।
এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) পরিচালক আহমেদ আহসান বলেন, দারিদ্র্য নিরসনের হারও শহরে কম, গ্রামে বেশি। এ ছাড়া শ্রমিকদের মজুরি হারের প্রবৃদ্ধি শহরে কমছে। আগে যেখানে প্রবৃদ্ধির হার ১২ শতাংশ ছিল, এখন সেটি কমে ৮ শতাংশ হয়েছে।
কয়েক বছর আগে বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা প্রতিবেদনেও যানজটের কারণে অর্থনীতির ক্ষত বড় হওয়ার তথ্য উঠে এসেছিল। এতে বলা হয়, যানজটের কারণে ঢাকায় দৈনিক ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। যানজটে ঢাকার যোগাযোগ প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে পড়ার বিষয়টি দিনে দিনে আরো জোরালো হয়ে উঠছে, যা বসবাসযোগ্যতার দিক থেকে রাজধানীকে নামিয়ে আনছে নিচের সারিতে।
পিআরআইয়ের গবেষণা প্রতিবেদনে নগরের জনসংখ্যা চাপের বিষয়টিও উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, দেশের শহুরে জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই বাস করে ঢাকায়। দেশের মোট জনসংখ্যা এরইমধ্যে ১৬ কোটি ৩০ লাখ ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে আবার ঢাকায় বসবাস করছে ১ কোটি ৮৯ লাখ মানুষ। সে হিসেবে দেশের মোট শহুরে জনসংখ্যার প্রায় ৩২ শতাংশ এখন বসবাস করছে রাজধানীতে।
বাংলাদেশের উন্নয়ন কার্যক্রমের অধিকাংশ ঢাকাকেন্দ্রিক। ফলে অন্যান্য শহরে উন্নয়নের ঘাটতি থাকছে। দেশের বেশির ভাগ অর্থনৈতিক কার্যক্রম ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় সার্বিকভাবে দেশে নগর উন্নয়ন স্থবির হয়ে আছে।
বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন এ প্রসঙ্গে বলেন, রাজধানীতে যানজটের কারণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জিডিপির ৬-১০ শতাংশ ক্ষতি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। রাজধানীর উন্নয়ন ব্যয় সামাজিকভাবে সর্বোচ্চ দক্ষতার সুফল দিচ্ছে না। ফলে ঢাকার ওভারগ্রোথ ও অর্থনৈতিক ক্ষতির বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নীতিনির্ধারকদের উচিত এটিকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা। গবেষণার সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় কর্মপন্থা দ্রুত গ্রহণ করতে হবে। বিষয়টি সমাধানের জন্য শহর ও অন্যান্য অঞ্চলের উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দেয়া উচিত। সরকারি সেবার মান ও বিনিয়োগের পরিবেশকে আরো ভালো করতে হবে।