অনলাইন ডেস্ক :
বর্ষাকাল আসার আগেই পাহাড়ি ঢলে দেশের হাওরাঞ্চলে প্রায়ই আগাম বন্যা শুরু হয়। তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় হাওর অঞ্চলের ফসল। তলিয়ে যায় ফসলি জমি, গ্রাম ও বাড়িঘর। আর আগাম বন্যার হাত থেকে হাওরের ফসল বাঁচাতেই কোটি কোটি টাকা খরচ করে ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প নেয়া হয়। কিন্তু যথাযথ তদারকির অভাব, সিন্ডিকেট করে কাজ নেয়া, জনপ্রতিনিধিদের সরাসরি হস্তক্ষেপসহ নানা কারণে ফসলক্ষা বাঁধের কাজ পিছিয়ে। আবার কোথাও কোথাও ওই কাজ দায়সারাভাবে করা হয়। ফলে বন্যার পানিতে ফসল রক্ষার বদলে উল্টো প্রায়ই বাঁধ তলিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে থাকে। ভুক্তভোগী হাওরবাসী এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, চলতি বছর মাঘ মাসে বৃষ্টি হওয়ায় হাওর এলাকার কৃষক দুশ্চিন্তায় পড়েছে। গত চার বছর বন্যা না হওয়ায় তারা এবার আগাম বন্যার আশঙ্কা করছে। বন্যার মৌসুম এগিয়ে এলেও হাওরাঞ্চলে এখনো বেশির ভাগ স্থানেই বাঁধ নির্মাণ ও মেরামতের কাজ শুরু হয়নি। এমনকি বাঁধ নির্মাণ দূরের কথা, কোথাও কোথাও এখনো প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) কাজই শুরুই হয়নি। ফলে কবে নাগাদ ওসব বাঁধ নির্মাণ হবে বা বন্যার আগেই বাঁধের সুফল পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়েই সন্দেহ রয়েছে।
সূত্র জানায়, দেশের হাওরাঞ্চল জেলা সুনামগঞ্জে ছোট-বড় ৫২টি হাওরে ৭২০টি ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণ কাজ চলছে। গত ১৫ ডিসেম্বর হাওররক্ষা বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও ওদিন ১ শতাংশ বাঁধেও কাজ শুরু হয়নি। আর চলতি বছরের জানুয়ারির শেষের দিকে কিছু হাওরে বাঁধ নির্মাণকাজ শুরু হলেও এখনো ১৪টি পিআইসির কাজ হয়নি। অথচ কাবিটা নীতিমালা অনুযায়ী ২৮ ফেব্রুয়ারি কাজ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু এখন পর্যন্ত ২৫ শতাংশ বাঁধের কাজ শেষ হয়নি। আর সময় মতো বাঁধ নির্মাণকাজ শেষ না হলে কৃষকরা এবার বোরো ফসলের ক্ষতির আশঙ্কা করছে। তবে সুনামগঞ্জে ফলসলক্ষা বাঁধের ৩৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে দাবি করে জেলা কাবিটা নীতিমালা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক। তিনি সময়মতো বাঁধ নির্মাণকাজ শেষ করতে পারবেন বলেও আশা প্রকাশ করেন। তবে কৃষক ও হাওর আন্দোলনের নেতাদের মতে, পিআইসিতে নামকাওয়াস্তে কৃষককে রাখা হয়। মূলত স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও তাদের লোকজনই মূল কাজ করে। তদারক কমিটি গঠনেও পক্ষপাতিত্ব হয়। সেজন্য এবারও তারা ফসলরক্ষা বাঁধের নামে লুটপাট ও অনিয়মের অভিযোগ করে। কারণ ফসলরক্ষা বাঁধের নামে হাওরে নামমাত্র কাজ হয়। আর ওসব দেখারও কেউ নেই। হাওররক্ষা বাঁধ নির্মাণকাজ শুধু কাগজে আর কলমে হয়। প্রকৃতপক্ষে সঠিক কাজ হয় না। এ বছরও এখনো অনেক পিআইসির কাজ শুরু না হওয়য় কৃষকরা এবার বোরো ধান গোলায় তুলতে পারবে কিনা তা নিয়ে চিন্তিত।
সূত্র আরো জানায়, সংশোধিত কাবিটা নীতিমালা-২০১৭ অনুযায়ী ১৩ সদস্যের কমিটিতে দাপ্তরিক কর্মকর্তা ছাড়াও একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি, গণমাধ্যম প্রতিনিধি, এনজিও প্রতিনিধি, নারী প্রতিনিধি, কৃষক প্রতিনিধি, মৎস্যজীবী প্রতিনিধি থাকার কথা। কিন্তু অধিকাংশ কমিটিতেই প্রতি বছর একই মানুষ বা একই পরিবারের সদস্যদের রাখা হয়। ফলে দিন দিন কেবল সিন্ডিকেট শক্তিশালী হচ্ছে। আর ওসব কারণেই নির্ধারিত সময়ের এক মাস পার হয়ে গেলেও অনেক হাওরেই হাওররক্ষা বাঁধের কাজ শুরু করা হয়নি। আবার অনেক বাঁধ অক্ষত থাকার পরও সেখানে পিআইসি গঠন করা হয়েছে। ওসব পিআইসি গঠনের পেছনে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সরাসরি হস্তক্ষেপ থাকারও প্রমাণ মিলেছে। খোদ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) দায়িত্বশীলরাও তা স্বীকার করেছেন। অনেকের মতে, ওসব সিন্ডিকেট এতোই শক্তিশালী যে তাদের তৈরি করা কমিটি পিআইসিতে অন্তর্ভুক্ত না করলে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়ে। যার কারণে অক্ষত ও অপ্রয়োজনীয় বাঁধ, এমনকি কারো কারো বাড়ির রাস্তাও তৈরি করে দিতে হয়। অথচ ওই সিন্ডিকেট ভাঙতে পারলে এতোদিনে কাজের অগ্রগতি ৮০ শতাংশের বেশি হতো। পাউবো সংশ্লিষ্টরা নীতিমালা অনুযায়ী কাজ করতে চাইলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে উপজেলা প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের সরাসরি হস্তক্ষেপে তা করা যায় না।
এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যানুযায়ী চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সুনামগঞ্জ জেলায় ৭০৬টি পিআইসিতে বাঁধ নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। তবে এখনো ১৪টি পিআইসিতে কাজ শুরু হয়নি। তবে বাঁধ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে নেত্রকোনা বেশ এগিয়ে রয়েছে। ওই জেলার হাওরাঞ্চলের তিন উপজেলা মদন, মোহনগঞ্জ ও খালিয়াজুরীতে বোরোর আবাদি জমির পরিমাণ ৪৪ হাজার ৭৬৭ হেক্টর। ইতিমধ্যে কৃষি জমি তৈরি, বোরোর বীজতলা থেকে চারা তুলে ও সেচসহ ফসলের ক্ষেতে রোপণ করে হাওরাঞ্চলে শতভাগ জমিতে বোরোর আবাদ সম্পন্ন হয়েছে। আগাম বন্যার কবল থেকে বোরো ফসল রক্ষায় চারটি হাওর উপজেলাসহ নয়টি উপজেলায় নির্মিত হচ্ছে ১৩২টি ডুবন্ত বাঁধ। ১৭৫টি পিআইসির মাধ্যমে ওসব বাঁধ নিমাঁণ করা হচ্ছে। ওই জেলায় সর্বমোট ১৮৫ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হবে। ১৩২টি বাঁধের মধ্যে এক খালিয়াজুরী উপজেলাতেই ৬২টি বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। তাছাড়া, মদনে ২৩টি, মোহনগঞ্জে ১৪, কলমাকান্দায় ২০, বারহাট্টায় পাঁচ, পূর্বধলায় দুই, দুর্গাপুরে এক, আটপাড়ায় দুই এবং কেন্দুয়ায় তিনটি বাঁধ নির্মিত হচ্ছে।
অন্যদিকে ভুক্তভোগী কৃষকদের মতে, হাওরাঞ্চলে প্রতি বছর বাঁধ নির্মিত হয় আর আগাম বর্নায় পানির তোড়ে ভেঙে যায়। কিছু এলাকায় স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ না করায় বাঁধ ভেঙে জমিতে বালি প্রবেশ করে আবাদি জমি নষ্ট হয়। অথচ দেশের হাওর এলাকায় বোরো আবাদ সবচেয়ে বেশি হয়। আর আকস্মিকভাবে পাহাড়ি ঢল বা আগাম বৃষ্টি হলে হাওরগুলোতে পানি এসে গেলে হাওরের উঠতি বোরো ফসল তলিয়ে যায়। কৃষকরা পাকা ধান আর ঘরে তুলতে পারেন না। সেজন্যই বাঁধ নির্মাণ খুব প্রয়োজন। আবার জমিতে বালি ঢুকে গেলে পরের বছর সেখানে ভালো ফসলও হয় না। যদিও প্রতি বছরই ডুবে থাকা বাঁধগুলো সংস্কার করা হয়, কিছু বাঁধ নতুন করে নির্মাণও করা হয়। কিন্তু কৃষকের জমি রক্ষার স্বার্থে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ জরুরি। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সংশ্লিষ্টরাও বাঁধের বালি জমিতে পড়ায় অনেক ফসলি জমি অনাবাদি হয়ে পড়ার বিষয়টি স্বীকার করেন। সেজন্য কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ থেকে কৃষকদের স্বার্থে কিছু এলাকায় পরিকল্পিতভাবে মজবুত বাঁধ নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে নেত্রকোনা জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী এবং জেলা পিআইসি কমিটির সদস্য সচিব এমএল সৈকত জানান, বাঁধ নির্মাণে চাহিদা অনুযায়ী ৩৫ কোটি টাকার মধ্যে প্রথম পর্যায়ে ১৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে ৭ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। মদন, মোহনগঞ্জ, খালিয়াজুরী ও কলমাকান্দার হাওর এলাকায় বিভিন্ন ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। আশা করা যায় আগাম বন্যার পানি আসার আগেই বাঁধ নির্মাণ হবে।
একই প্রসঙ্গে সুনামগঞ্জ জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জহুরুল ইসলাম জানান, হাওররক্ষা বাঁধের কাজ এখনো কিছু পিআইসিতে শুরু হয়নি। তবে সময়মতো বাঁধের কাজ শেষ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে আগ্রহী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার: নাহিদ ইসলাম