March 29, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Saturday, December 25th, 2021, 12:32 pm

আগুন লাগার পরও লঞ্চ ৪০ মিনিট চলে

‘এমভি অভিজান-১০’ এ আগুন লাগার সাথে সাথে তাৎক্ষণিকভাবে তীরে ভিড়লে হয়তো এতো বড় দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। সেক্ষেত্রে বেঁচে যেত সবাই। এমনটাই মনে করছেন মাঝ নদীতে অগ্নিকাণ্ডে লাশের স্তুপ গড়া লঞ্চ এমভি অভিযান ১০’র বেঁচে যাওয়া যাত্রীরা।

রাত ২টা নাগাদ বরিশাল নদী বন্দর পার হয় লঞ্চটি। এর ঠিক ২০-২৫ মিনিট পর সুগন্ধি নদীর দপদপিয়া পয়েন্ট পার হওয়ার সময় প্রথম ইঞ্জিন রুমে আগুন জ্বলতে দেখেন লঞ্চের যাত্রী বরগুনার বামনা উপজেলার বাসিন্দা রাশেদ।

বরিশাল শেরে বাংলা চিকিৎসা মহবিদ্যালয় (শেবাচিম) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রাশেদ বলেন, ‘লঞ্চ বোঝাই ছিল যাত্রী। কোথাও জায়গা না পেয়ে ইঞ্জিন রুমের পাশেই ছিলাম। দপদপিয়া এলাকা পেরুনোর পরপরই ইঞ্জিন রুমের পাশে জ্বলতে দেখি আগুন। তখন অবশ্য তা খুব বেশি ছিল না। এই অবস্থাতেই চলতে থাকে লঞ্চ। সেই সাথে স্টাফরা চেষ্টা চালাতে থাকে তা নেভানোর। এভাবে প্রায় ৪০-৪৫ মিনিট চলার পর হঠাৎ করেই বেড়ে যায় আগুনের ভয়াবহতা।’

আগুন লাগার পর লঞ্চ তীরে না ভিড়িয়ে চালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন সদ্য সচিব পদে পদোন্নতি পাওয়া বরিশালের বিভাগীয় কমিশনার সাইফুল আহসান বাদল।

সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘চালকের অদক্ষতা এক্ষেত্রে বড় অপরাধ হিসেবে কাজ করেছে। আগুন লাগার পর ঝুঁকি না নিয়ে লঞ্চ থামিয়ে দিলে হয়তো এতো বড় মর্মান্তিক ঘটনা ঘটতো না।’

যাত্রীদের দাবি ইঞ্জিন রুমে আগুনের সূত্রপাত

ইঞ্জিন রুমের পাশেই থাকা চিকিৎসাধীন দগ্ধ যাত্রী বরগুনার ঢলুয়া এলাকার বাসিন্দা কালু মিয়া বলেন, ‘ইঞ্জিন রুমের পাশেই ছিল ৭ ব্যারেল তেল। আগুনের উত্তাপে এর পর্যায়ে সেগুলো বিস্ফোরিত হলে মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে যায় পুরো লঞ্চে।এর ভয়াবহতা এতোটাই বেশি ছিল যে তৃতীয় তলার কেবিনে থাকা যাত্রীদের প্রায় কেউই আর বেরুতে পারেনি। মুহূর্তেই পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে সবাই।’

বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরেক যাত্রী বরগুনার খোলপটুয়া গ্রামের আসিফ সিকদার বলেন, ‘তীব্র শীতে ঠান্ডা বাতাসের হাত থেকে বাঁচতে একদিকে যেমন লঞ্চে ঢোকা বেরুনোর সবগুলো গেট আটকানো ছিল তেমনি চারপাশের মোটা পর্দাগুলো নামিয়ে রাখা হয় বেঁধে। চোখের পলকে ছড়িয়ে পড়া আগুনে সবার আগে পুড়তে শুরু করে পর্দাগুলো। তীব্র উত্তাপে স্টীল কাঠামোর আয়তন বেড়ে যাওয়ায় আটকে যায় গেট। ফলে লঞ্চের দু’দিক দিয়ে যেমন যাত্রীরা ঝাপ দিতে পারেনি নদীতে তেমনি গেট আটকে যাওয়ায় বেরুতেও পারেনি কেউ। বদ্ধ উনোনে পুড়ে মরেছ মানুষ।’

লঞ্চের বেঁচে যাওয়া যাত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, ‘বৃহস্পতিবার বিকালে ঢাকা সদর ঘাট থেকে লঞ্চটি ছাড়ার পর থেকেই খানিকটা অদ্ভুত শব্দ হচ্ছিল লঞ্চের ইঞ্জিন থেকে।’ নিয়মিত লঞ্চ যাত্রী কামরুল’র ভাষ্যমতে, ‘শব্দটা ছিল অস্বাভাবিক। সাধারণতঃ এরকম শব্দ এর আগে আর কখনো শুনিনি অন্য কোন লঞ্চে। এভাবেই ঢাকা থেকে সুগন্ধা নদীর দপদপিয়া পর্যন্ত আসার পর আগুর জ্বলে উঠে ইঞ্জিন রুমে। চালকসহ লঞ্চের অন্যান্য কর্মকর্তারা এসময় যদি লঞ্চ না চালিয়ে তীরে ভিড়িয়ে দিতেন তাহলে হয়তো এতোবড় দুর্ঘটনা ঘটতোনা। কিন্তু তারা তা না করে আগুন নেভানোর চেষ্টার পাশাপাশি লঞ্চ চালাতো থাকেন। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন যাত্রীদেরকেও জানানো হয়নি কিছুই। এরপর যখন বিস্ফোরণ এবং মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে তখন আর কারও কিছু করার ছিল না।’

শেবাচিমের পরিস্থিতি

দুর্ঘটনার পর ঝালকাঠী থেকে ৭০ জনের মতো দগ্ধ নারী পুরুষকে চিকিৎসার জন্য দ্রুত নিয়ে আসা হয় বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালে। এসব আহতদের প্রায় সবারই পোড়া চিহ্ন দেখা গেছে হাত এবং পায়ে।

এদের একজন বরগুনার বেতাগীর বাসীন্দা হারুন মিস্ত্রি বলেন, ‘আগুন ছড়িয়ে পড়ার পরপরই মুহূর্তের মধ্যে তীব্র উত্তাপে উত্তপ্ত হয়ে উঠে লঞ্চের স্টিল কাঠামো। নিচে ডেকে যেমন রাখা যাচ্ছিল না পা তেমনি হাত দিয়েও ধরা যাচ্ছিল না কিছুই। ওই অবস্থায়ই জীবন বাঁচাতে হাত পা পুড়িয়ে নদীতে ঝাপ দিতে থাকে মানুষ। মূলতঃ যারা নদীতে ঝাপ দিতে পেরেছে তারাই বেঁচে গেছে। অন্যদের ভাগ্যে জুটেছে নির্মম মৃত্যু।’

লঞ্চের বেঁচে যাওয়া একাধিক যাত্রী জানান, ‘ঘটনাস্থলে পৌছানোর পর হঠাৎ যখন লঞ্চটিকে আগুন গ্রাস করে তখন এর চালক প্রথমে তীরের দিকে নিয়ে গেলেও পরে আবার মাঝ নদীতে নিয়ে আসে। কেন সে এটা করলো তা পরিস্কার নয়।’

যাত্রীর সংখ্যা নিয়ে ধোয়াশা

দুর্ঘটনার সময় অভিশপ্ত অভিযান ১০ লঞ্চে ঠিক কতজন যাত্রী ছিল তাই নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ধোয়াশা। লঞ্চের মালিক পক্ষের দাবি অনুযায়ী সব মিলিয়ে ৩ থেকে সাড়ে ৩শ’ যাত্রী ছিল লঞ্চে। বিআইডব্লিউটিএ বরিশালের যুগ্ম পরিচালক এস এম আজগর আলী-রও দাবি যে ঢাকা থেকে ৩১০ জনের মতো যাত্রী নিয়ে বরগুনার উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসে লঞ্চটি। এমনকি দুর্ঘটনার পর গতকাল শুক্রবার দুপুরে আহত যাত্রীদের দেখতে বরিশালে আসা নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীও বলেছেন যে রাতের বেলা সাড়ে ৪শ’র মতো যাত্রী ধারনের অনুমতি থাকা লঞ্চটিতে ৩ সাড়ে ৩শ’র বেশি যাত্রী ছিল না।

তবে দুর্ঘটনার কবল থেবে বেঁচে ফিরে আসা যাত্রীরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের মতে দেড় হাজারের বেশি যাত্রী ছিল লঞ্চে।

শেবাচিম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন যাত্রী বরগুনার রাশেদ বলেন, ‘নিচতলার ডেকে যাত্রীদের ভীড়ের কারণে বসার মতো জায়গা ছিল না। পরে ইঞ্জিনের পাশে কোনভাবে একটু জায়গা করে ফিরছিলাম বরগুনায়।’

দগ্ধ হয়ে আহত আরেক যাত্রী কালু মিয়াও বলেন একই কথা।

দুর্ঘটনার পর বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালে ভর্তি করা প্রায় ৭০ জন নারী-পুরুষের পাশাপাশি লাশ উদ্ধার হওয়া ৩৯ (শুক্রবার বিকাল ৪টা পর্যন্ত) জনের খবর জানা গেলেও লঞ্চে থাকা বাকি যাত্রীদের ভাগ্যে কি ঘটেছে তা এখনো পরিস্কার নয়।

সবকিছু সঠিক থাকার দাবি লঞ্চ মালিকের

ঢাকা থেকে বরগুনাগামী ঝালকাঠিতে এমভি অভিযান -১০ লঞ্চে বিকট শব্দে বিস্ফোরণের পর আগুন লাগে বলে জানিয়েছেন আগুনে পুড়ে যাওয়া নৌযানের মালিক হাম জালাল শেখ।

শুক্রবার দুপুরে যোগাযোগ করা হলে তিনি ইউএনবি বলেন, লঞ্চের এক সুপারভাইজার আনোয়ার ভোর রাত আনুমানিক ৩টার দিকে ফোন করে প্রথম অগ্নিকাণ্ডের খবর দেয়।

কর্মচারী আনোয়ারের খবরের বরাতে মালিক হাম জালাল বলেন, প্রথমে দোতলায় একটা বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়, সঙ্গে সঙ্গে কেবিনে আর লঞ্চের পেছনের বিভিন্ন অংশে আগুন লাগে। তারপর তৃতীয় তলার কেবিন ও নিচতলায় ছড়িয়ে পড়ে আগুন। তবে কিভাবে আগুন লাগে এটা জানা যায়নি।

যান্ত্রিক ত্রুটি সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে হাম জালাল বলেন, ওই লঞ্চে অন্তত ২১টি অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র ছিল, কিন্তু এত দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে যে সময় পাওয়া পায়নি।

লঞ্চে কোনো যান্ত্রিক ক্রুটি ছিল না দাবি করে তিনি বলেন, ইঞ্জিনে আগুন লাগলে কখনো পুরো জাহাজে আগুন ছড়িয়ে পড়ে না। বিকট শব্দে দোতলা থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে ইঞ্জিন ও কেবিনের দিকে।

হাম জালাল এমভি অভিযান-১০, ৩ ও ৫ লঞ্চের মালিক।

তদন্ত কমিটি

নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য অফিসার মো. জাহাঙ্গীর আলম খান জানান, লঞ্চে আগুন লাগার ঘটনা তদন্তে নৌ-পরিবহন মন্ত্রনালয়ের যুগ্ম সচিব তোফায়েল আহম্মেদকে আহ্বায় করে ৭ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী ৩ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে হবে। মন্ত্রণালয়ের উপ সচিব আমিনুর রহমানকে সদস্য সচিব করার পাশাপাশি কমিটিতে নৌ পুলিশ, জেলা প্রশাসন এবং ফায়ার সার্ভিসের প্রতিনিধি রাখা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীর দিয়াবাড়ি নামক স্থানে শুক্রবার ভোরে ঢাকা থেকে বরগুনাগামী এমভি অভিযান ১০ নামে একটি লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩৯ জনের লাশ এবং আহত ৭২ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে।

—ইউএনবি