নিজস্ব প্রতিবেদক:
আদালতে মামলার নিষ্পত্তি হলেও আশানুরূপভাবে বাড়ছে না খেলাপি ঋণ আদায়। অর্থঋণ আদালতে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত এক লাখ ৪০ হাজার মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। কিন্তু ওসব মামলায় ৭০ হাজার ৪১ কোটি টাকা দাবির বিপরীতে ২০ হাজার কোটি টাকার কম আদায় হয়েছে। যা মোটের ২৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। আর দেউলিয়া আদালতে নিষ্পত্তি হয়েছে ৩৪৯টি মামলা। সেখানে ২ হাজার ২০৯ কোটি টাকার বিপরীতে ১৯ শতাংশের কম আদায় হয়েছে। এমননিতেই অর্থঋণ আদালত বা দেউলিয়া আদালতে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘ সময় লাগে। আর দীর্ঘ অপেক্ষার পর ওসব আদালতে মামলার নিষ্পত্তি হলেও খেলাপি ঋণ আদায় কম হচ্ছে। ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, মামলার মাধ্যমে অর্থ আদায় করা বিভিন্ন কারণে সময়সাপেক্ষ। বিবাদীপক্ষের আবেদনে অনেক ক্ষেত্রেই উচ্চ আদালতে মামলা ঝুলে থাকে। এসব সমস্যা সমাধানে ২০০৩ সালের অর্থঋণ আদালত আইন এবং ১৯৯৭ সালের দেউলিয়া আইন সংশোধনের প্রস্তাব প্রায় ৪ বছর আটকে আছে। বিগত ২০১৮ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে আইন দু’টি যুগোপযোগী করার প্রস্তাব করা হয়। তাতে বলা হয়, মামলা গ্রহণের পর সর্বোচ্চ ৯০ দিনের মধ্যে তা নিষ্পত্তি করতে হবে। উপযুক্ত কারণে নির্ধারিত সময়ে মামলা নিষ্পত্তি করতে না পারলে সর্বোচ্চ আরো ৩০ দিন সময় বাড়ানো যাবে। মূলত বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে যোগসাজশ করে ঋণ বিতরণের কারণে নিষ্পত্তি হওয়া মামলায় আদায় কম হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই জাল কাগজের বিপরীতে যোগসাজশে ঋণ দেয়া কিংবা বন্ধকি সম্পত্তির প্রকৃত মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দর দেখিয়ে ঋণ দেয়া হয়। তাছাড়া নিলামের মাধ্যমে বন্ধকি সম্পত্তি বিক্রি প্রক্রিয়ায়ও নানা যোগসাজশ হয়।
সূত্র জানায়, অর্থঋণ আদালত আইনে ২ লাখ ৭ হাজার ৮৯৬টি মামলা হয়েছে। দেশের ব্যাংকগুলো ২ লাখ ১৩ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা আদায়ে ওসব মামলা করে। তার মধ্যে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত এক লাখ ৩৯ হাজার ৬২৫টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। ওসব মামলায় ৭০ হাজার ৪১ কোটি টাকা দাবির বিপরীতে ব্যাংকগুলো মাত্র ১৯ হাজার ৭০৪ কোটি টাকা পেয়েছে, যা মোট পাওনার ২৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। আর বিচারাধীন ৬৮ হাজার ২৭১টি মামলার বিপরীতে ব্যাংকগুলোর দাবির পরিমাণ এক লাখ ৪৩ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা। বিচারাধীন ওসব মামলায় ৪ হাজার ৬১১ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। তাছাড়া বিগত ১৯৯৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংক দেউলিয়া আইনে ৫১৮টি মামলা করেছে। ওসব মামলার বিপরীতে দাবির পরিমাণ ২ হাজার ৭৫৭ কোটি টাকা। তার মধ্যে ৩৫৫টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। ওসব মামলায় ব্যাংকগুলোর ২ হাজার ২৯১ কোটি টাকা দাবির বিপরীতে মাত্র ৪১৪ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। যা মোট পাওনার যা মাত্র ১৮ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। আর বিচারাধীন ১৭১টি মামলার বিপরীতে ব্যাংকগুলোর ৪৬৫ কোটি টাকা পাওনা ছিল। তবে আদায় হয়েছে ২ কোটি ১১ লাখ টাকা। বিচারাধীন মামলায় পাওনার তা মাত্র শূন্য দশমিক ৪৫ শতাংশ। ২০২০ সাল শেষে ৫১৮টি মামলার বিপরীতে মোট দাবির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৭৩৩ কোটি টাকা। দেউলিয়া আদালতে করা মামলায় ব্যাংক ছাড়াও অন্য পাওনাদারও দাবি উত্থাপন করতে পারে। তবে অর্থঋণ আদালত আইনটি শুধু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্থ আদায়ে প্রণীত। ওই কারণে পাওনা আদায়ে অর্থঋণ আদালতে ব্যাংকগুলোর বেশিরভাগ মামলা হয়। দেউলিয়া আদালতে হাতেগোনা কিছু মামলা হয়।
সূত্র আরো জানায়, ছোট ঋণ গ্রহীতার তুলনায় বড় ঋণ গ্রহীতাদের মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা বেশি হয়। বড় ঋণ গ্রহীতারা নানা উপায়ে মামলা ঠেকিয়ে রাখে। অর্থঋণ আদালতে রায় বিপক্ষে গেলে অনেক সময় উচ্চ আদালতে যায়। যে কারণে অনিষ্পন্ন মামলার বিপরীতে গড়ে ২ কোটি ১০ লাখ টাকার বেশি পাওনা রয়েছে। আর নিষ্পত্তি মামলায় যেখানে গড় পাওনা মাত্র ৫০ লাখ টাকা। তবে অর্থঋণ আদালত আইন ও দেউলিয়া আইন সংশোধন প্রস্তাব অনুমোদিত হলে ব্যক্তির পাসপোর্ট জব্দ বা বাতিল, বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে দাওয়াত না দেয়া, কোম্পানির পরিচালক বা ক্লাবের সদস্যপদ বাতিল করার কথা রয়েছে। দ-িত ব্যক্তির গাড়ি কেনার ওপর নিষেধাজ্ঞা এমনকি একাধিক ব্যাংক হিসাব পরিচালনায়ও নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাব রয়েছে। আবার মামলা গ্রহণের কত দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে তাও উল্লেখ রয়েছে। তাছাড়া ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির একটা সংজ্ঞা নির্ধারণ করে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থার সুপারিশ রয়েছে।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ পুনঃতপশিল, পুনর্গঠনসহ নানান ছাড়ে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর সুযোগ করে দিচ্ছে। আবার অনেক গ্রাহকের আবেদনে উচ্চ আদালত থেকে খেলাপি না দেখানোর ওপর আদেশ দেয়া হচ্ছে। ওসব কারণে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী গত জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ রয়েছে এক লাখ ২৫ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা। তার বাইরে আরো ৪৫ হাজার কোটি টাকার মতো অবলোপন করা খেলাপি ঋণ রয়েছে। অবশ্য ওসব ঋণের বিপরীতে অনেক ক্ষেত্রে অর্থঋণ আদালত বা দেউলিয়া আদালতে মামলা চলমান।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান জানান, সুনির্দিষ্ট কয়েকটি কারণে মামলার পরও খেলাপি ঋণ আদায় হয় খুব কম। ওই ধরনের ক্ষেত্রে ঋণ দেয়ার শুরুতেই বন্ধকি সম্পত্তির দাম অনেক বেশি দেখানো হয়। ফলে সম্পত্তি বিক্রি করে ঋণের সমপরিমাণ টাকা আদায় হয় না। তাছাড়া ওই ধরনের মামলা চলেও দীর্ঘদিন। আর ব্যাংক তা সার্বক্ষণিক পাহারায় থাকতে পারার সুযোগে ঋণগ্রহীতা অনেক সময় সম্পদ বিক্রি করে ফেলে। তাছাড়া ব্যাংকের মধ্যে বন্ধকি সম্পদের ডকুমেন্টেশনেও গাফিলতি থাকে। ওসব কারণে মামলা করেও ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আদায় হয় খুব কম।
আরও পড়ুন
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে আগ্রহী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার: নাহিদ ইসলাম