নিউজ ডেস্ক :
তীব্র গরমে, সন্তান এবং সুটকেস ও স্ট্রলার নিয়ে বিমানবন্দরের টারম্যাকে অক্লান্ত প্রতীক্ষা- কখন ‘মুক্তির’ ফ্লাইটটি অবতরণ করবে। রাঁধুনি, মালী, দোভাষী, গাড়িচালক, সাংবাদিক- এমন দুইশ’র বেশি আফগান কাবুল বিমানবন্দরে জড়ো হয়ে আছে দেশ ছেড়ে পালানোর জন্য। এরা নিউ ইয়র্ক টাইমস, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ও ওয়াশিংটন পোস্টের স্থানীয় কর্মী ও তাদের স্বজন। তালেবান বাহিনী যখন ভিড়ে ঠাসা কাবুল বিমানবন্দর অভিমুখে এগিয়ে যাচ্ছিল, এই দলটি গুলির শব্দ শুনতে পায়। জান বাঁচাতে তারা দ্রুত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে, শেষমেশ বাড়ি ফিরে যায়, যেখানে তাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নেই। ওই দলের কিছু সদস্য কয়েক দিনের অপেক্ষা শেষে বৃহস্পতিবার আফগানিস্তান থেকে বের হতে পেরেছে। কাজটি এত সহজ ছিল না। এই প্রক্রিয়াটি যুক্তরাষ্ট্রের বার্তাকক্ষ থেকে শুরু হয়ে পেন্টাগনের হল রুম ঘুরে কাতারের দোহায় আমিরের প্রাসাদে পৌঁছানোর পর সম্পন্ন হয়েছে। নিউ ইয়র্ক টাইমসের একজন সংবাদদাতা টমাস গিবনস-নেফ; যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক এই মেরিন সেনা আগেই বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন, তবে আফগান সহকর্মীদেরও বের করে আনতে একটি সামরিক বিমানে আবার ফিরে গেছেন। কাবুল বিমানবন্দরে অবস্থান করে তিনি এই পালানোর প্রক্রিয়া সমন্বয়ে সহযোগিতা করছেন। এই দলের ভাগ্যপরীক্ষা, আফগানিস্তানে গত সপ্তাহে এ ধরনের অনেক দলের ভাগ্যপরীক্ষার একটি, যেখানে বছরের পর বছর পশ্চিমা সাংবাদিকদের সহায়তাকারী হিসেবে আফগান নাগরিকেরা কাজ করেছে। নিজ দেশের দুর্দশার তথ্য বিশ্ববাসীকে জানাতে সহায়তা করেছে। এখন তারা তালেবানের শাসনে নিজেদের এবং পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সংবাদ মাধ্যম উচ্চ-পর্যায়ের কূটনীতিক ও মাঠ পর্যায়ের মধ্যস্ততাকারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, যাতে তাদের কর্মীদের পালাতে সাহায্য করে। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে আফগানিস্তানের পরিস্থিতির অবনতির প্রেক্ষাপটে নিউ ইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট ও ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল তাদের কর্মীদের আফগানিস্তান থেকে বের করে আনার উদ্যোগে একত্র হয়েছে। সকালের ফোন কলে নিরাপত্তা কর্মী ও সম্পাদকরা তথ্য আদান-প্রদান করছেন। প্রকাশকরা প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনের কাছে ফোন করছেন, যাতে তাদের আফগান সহকর্মীদের সেখান থেকে বের করে আনার পথ করে দেওয়া হয়। এ নিয়ে হোয়াইট হাউজ, পেন্টাগন ও পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তারাও আলোচনা করছেন। রোববার নাগাদ এসব সংবাদপত্রের আফগানিস্তানের ব্যুরো অফিসগুলো বন্ধ হয়ে যায়। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের সেনা সদস্য, ঠিকাদার ও নিরাপত্তা দলগুলো আফগানিস্তান ছেড়ে গেলে এসব অফিসের আফগান কর্মীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তাদের শঙ্কা, আমেরিকার সংবাদ মাধ্যমগুলোতে কাজ করেছে যারা, তালেবান বাহিনী তাদের ঘরে ঘরে গিয়ে হানা দেবে, হয়রানি করবে বা অপহরণ করে নিয়ে যাবে। তেমন ঘটনা ঘটতেও শুরু করেছে। সাংবাদিকের খোঁজে বাড়িতে হানা, না পেয়ে আত্মীয়কে মারল তালেবান কাবুলের কেন্দ্রস্থল থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের হাতে থাকলেও সেখানে পৌঁছানো এবং টারমিনালে ঢোকার সুযোগ পাওয়াও প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। রোববার ২০০ জনের দলটি, কর্মী ও স্বজনসহ, বিমানবন্দরের টারম্যাকে পৌঁছায় এই আশায় যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে, পরিচয় গোপন রাখার শর্তে তিন ব্যক্তি এভাবেই ঘটনার বিবরণ দেন। তারা জানান, সেখানে পৌঁছে তারা একটি সংশয়ের চিত্র দেখতে পান, যেখানে আরও হাজার হাজার আফগান নিরাপদ আশ্রয়ের প্রত্যাশায় জড়ো হয়েছে। যখন তালেবান বাহিনী সেখানে পৌঁছায়, পরিস্থিতি আরও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে; দলের সদস্যরা তৃষ্ণার্ত, ক্ষুধার্ত ও হতাশ হয়ে পড়ে এই ভেবে যে এখন কী হবে? কাবুল বিমানবন্দরের বাইরে উদ্বিগ্ন অপেক্ষা। নিউ ইয়র্ক টাইমসের সহকারী ব্যবস্থাপনা সম্পাদক মাইকেল স্ল্যাকম্যান বলেন, “অনেক পরিকল্পনা এবং অনেক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সেগুলো হয় ব্যর্থ হয়েছে বা ঝুলে পড়েছে। আপনি হয়ত পরিকল্পনা করেছেন রাতে, কিন্তু দুই ঘণ্টা পর হয়ত পরিস্থিতি বদলে গেছে।” ক্রিস্টিন কোরাটি কেলি নামের একজন মুখপাত্র জানান, মঙ্গলবার ওয়াশিংটন পোস্টের ১৩ জন যুক্তরাষ্ট্রের একটি সামরিক বিমানে চড়ে কাতারের উদ্দেশে রওনা দিতে সক্ষম হয়। এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে বিভিন্ন পর্যায়েরে অনেকগুলো ব্যক্তির সহায়তা প্রয়োজন হয়েছিল। তাদেরকে সহায়তার জন্য ওয়াশিংটন পোস্টের প্রকাশক ফ্রেড রায়ান যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেইক সুলিভানকে ইমেইল করেছিলেন। উদ্ধার পাওয়া এই দলের মধ্যে দুই জন আফগান কর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্য ও একজন মার্কিন সংবাদদাতা রয়েছেন। বিদেশি সেনাদের সহায়তাকারী আফগানদের হন্যে হয়ে খুঁজছে তালেবান মঙ্গলবার ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের তিনজন সংবাদদাতাও আফগানিস্তান থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছেন এবং আরও ডজনখানেক আফগান কর্মীকে বের করে আনতে কাজ করে যাচ্ছে সংবাদপত্রটি। বৃহস্পতিবার জার্নালের একজন মুখপাত্র কলিন শোয়ার্টজ বলেন, “ইতিবাচক অগ্রগতি হচ্ছে এবং আমাদের সহকর্মীরা নিরাপদে বের হয়ে আসার পথে রয়েছেন। দ্রুতই এ বিষয়ে আরও তথ্য জানাতে পারব।” নিউ ইয়র্ক টাইমসের ১২৮ জনের একটি দলকে বের করে আনার একটি পথ খুলে যায় যখন তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র কাতার সরকার সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। কাতারে যুক্তরাষ্ট্রের একটি সামরিক ঘাঁটি আছে এবং কাবুলে কাতারের দূতাবাস রয়েছে এবং তালেবান নেতাদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কও রয়েছে। নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রকাশক এজি সুলসবারগার বলেন, আফগান সহকর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের বের করে আনতে সহযোগিতা করায় তার প্রতিষ্ঠান কাতারের সরকারের কাছে ‘আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ’। সংবাদ মাধ্যমগুলো এমন আফগানদেরও সহায়তা করতে চাইছে, যারা হয়ত অনেক বছর আগে তাদের হয়ে কাজ করেছিল। লোকজনকে কাবুল বিমানবন্দরে যেতে বাধা দিচ্ছে তালেবান বৃহস্পতিবার রাতে নিউ ইয়র্ক টাইমসের কর্মী ও তাদের আত্মীয়রা বিমানবন্দরে পৌঁছানোর আরেকটি উদ্যোগ নেয়। ঘটনাটি সম্পর্কে জানেন, এমন তিন ব্যক্তি জানান, প্রথমে দলটি ভিড় ও তালেবান চৌকিতে বাধা পায়, তবে শেষ পর্যন্ত তারা একটি পথ খুঁজে পেয়েছিল। টাইমসের বিদেশি সংবাদদাতা মুজিব মার্শাল ও থমাস গিবনস-নেফ ওই দলটিকে সাহায্য করেন। বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর জানায়, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদ মাধ্যমগুলোর সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রাখছেন কর্মকর্তারা। তাদের সাংবাদিক, কর্মী ও সহযোগীদের নিরাপত্তার বিষয়টিতে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। সংবাদ মাধ্যমগুলোর জন্য পরবর্তী পদক্ষেপটি স্পষ্ট নয়। ইংরেজিভাষী সাংবাদিক যারা এখনও কাবুলে অবস্থান করে সংবাদ পাঠাচ্ছেন, তাদের জন্য পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে উঠছে। বৃহস্পতিবার লস এঞ্জেলেস টাইমসের আলোকচিত্র সাংবাদিক মারকাস ইয়াম এবং আরেকটি আমেরিকান সংবাদ মাধ্যমের চিত্রগ্রাহককে মারধর করেছে তালেবান যোদ্ধারা। তারা ওই দুজনের ক্যামেরার ছবি মুছে ফেলতে বলে। চিত্রসাংবাদিক দুজনকে ২০ মিনিট আটকে রাখার পর যখন একজন ইংরেজি জানা তালেবান যোদ্ধা বুঝতে পারেন যে তারা পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমের জন্য কাজ করছেন, তখন তাদের মুক্তি দেওয়া হয়। কঠিন পরিস্থিতির কারণে সিএনএনের ক্ল্যারিসা ওয়ার্ড নিজেকে বোরকায় ঢেকে নিয়েছেন, যাতে রাস্তায় চলাচলরত আফগানদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। সিবিএস নিউজের রোক্সানা সাবেরি অনলাইনে জুমের মাধ্যমে সাক্ষাৎকার নেন, যখন তা প্রকাশ্যে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। মোবাইল ফোনের উপরও এখন আস্থা রাখতে না পেরে কিছু সংবাদদাতা স্যাটেলাইট ফোন সঙ্গে রেখেছেন। সাংবাদিকদের জন্য প্রতিকূল এই পরিস্থিতিতেও কাতারভিত্তিক আল জাজিরা টেলিভিশন আফগানিস্তানে তাদের সংবাদদাতার সংখ্যা বাড়িয়েছে। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক মোহাম্মদ মোয়াদ বলেন, তার সংবাদদাতারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিনা বাধায় চলাফেলা করতে পারছে। তবে তার উদ্বেগ, আফগানিস্তান নিয়ে বৈশ্বিক সংবাদ প্রচার কমে যেতে পারে, যেহেতু পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে এবং বিদেশি সাংবাদিক ও তাদের আফগান সহকর্মীরা সেখানে আর নিরাপদ বোধ করছেন না।
আরও পড়ুন
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি
গাজায় গত একদিনে নিহত ৫২