November 22, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Thursday, October 21st, 2021, 1:01 am

আমদানি পণ্য নৌপথে পরিবহনে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক:

সাগরপথে বিদেশ থেকে আমদানি পণ্য নৌপথে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। তারা বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার নারায়ণগঞ্জে সিমেন্টের এক টন কাঁচামাল নিতে যেখানে সব মিলিয়ে খরচ হয় সর্বোচ্চ ২৫০ টাকা, সেখানে পণ্য নিতে ব্যবসায়ীদের গুনতে হচ্ছে টনপ্রতি ৪১৫ টাকা। প্রতি টন পণ্য পরিবহনে মধ্যস্বত্বভোগীর পেটে যাচ্ছে বাড়তি ১৬৫ টাকা যাচ্ছে। আর সারাদেশে নৌপথে প্রতিদিন গড়ে এক লাখ টন পণ্য যায়। সে হিসাবে প্রতিদিন মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে যাচ্ছে বাড়তি এক কোটি ৬৫ লাখ টাকা। মাসে যার পরিমাণ সাড়ে ৪৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ বছর শেষে মধ্যস্বত্বভোগীরা হাতিয়ে নিচ্ছে ৫৯৪ কোটি টাকা। আমদানিকারক, বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিভোয়া) এবং ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল (ডব্লিউটিসি) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সাগরপথে চট্টগ্রাম বন্দরে আসা পণ্যের ৮০ শতাংশই দেশের ৩৬টি নৌঘাটে বহির্নোঙর থেকেই চলে যায়। ওসব পণ্য পরিবহনের জন্য এক হাজার ৮০০ লাইটার জাহাজ রয়েছে। তার মধ্যে দেড় হাজার লাইটার জাহাজ ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের (ডব্লিউটিসি) মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। বাকিগুলো বিভিন্ন শিল্প মালিকের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। শিল্প মালিকদের মতে, ডব্লিউটিসি বাড়তি ভাড়া আদায় করে মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে মুনাফার অংশ নিয়ে যাচ্ছে। তবে ডব্লিউটিসি বলছে, নিজেদের পণ্য বেশি থাকায় কিছু করপোরেট প্রতিষ্ঠান নৌপথে নৈরাজ্য জিইয়ে রাখছে।
সূত্র জানায়, দেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথে বর্তমানে যেসব জাহাজ পণ্য পরিবহন করছে সেগুলোর মালিক ৫ শতাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। কিন্তু ৭০ থেকে ৮০ জন দেশের ৩৬টি নৌঘাটে পণ্য আনা-নেয়ার কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করছে। বেশিরভাগ মালিকই ডব্লিউটিসির মাধ্যমে জাহাজ পরিচালনা করছে। তবে সংখ্যায় কম হলেও সিমেন্ট কারখানা মালিকদের নৌপথে পণ্য বেশি থাকায় তাদেরও প্রভাব রয়েছে। আর ওই প্রভাব ধরে রাখতে উভয় পক্ষকেই মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে যেতে হচ্ছে। সাধারণ আমদানিকারকদের কাছে মধ্যস্বত্বভোগী হচ্ছে ডব্লিউটিসি। আর ডব্লিউটিসি মতে, শিল্প মালিকদের যারা বছর হিসেবে চুক্তি করে জাহাজ ভাড়া দেয় তারাই হচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগী। দুই হাজার টন ধারণক্ষমতার একটি লাইটার জাহাজ চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার নারায়ণগঞ্জে যেতে গড়ে ৩ হাজার ৭০০ লিটার জ্বালানি লাগে। প্রতি লিটার জ্বালানির দাম ৬৫ টাকা হলে তাতে খরচ হয় ২ লাখ ৪০ হাজার ৫০০ টাকা। কিন্তু ওই রুটে লাইন খরচ ২০ হাজার টাকা। ১৩ জন নাবিক-ক্রুর বেতন বাবদ খরচ মাসে ২ লাখ টাকা। এক হাজার ৯০০ টন পণ্য যদি এক ট্রিপে নেয়া হয়, তবে এক টন পণ্যে লাইন খরচসহ তেল খরচ পড়ে ১৩৭ টাকা। এক হাজার ৯০০ টন পণ্য পরিবহন করা ১৩ জনের বেতনসহ অন্যান্য খরচ হবে আরো ১০৫ টাকা। সব মিলিয়ে চট্টগ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জে এক টন পণ্য নিতে এক ট্রিপে খরচ হয় ১৪২ টাকা। আনুষঙ্গিক অন্যান্য খরচ বাবদ প্রতি টনে ৮ টাকা যুক্ত করলেও তা হয় ২৫০ টাকা। কিন্তু ডব্লিউটিসি এতোদিন ওই ভাড়া নিয়েছে ৫৪৮ টাকা। অর্থাৎ তারা ২৯৮ টাকা বাড়তি নিয়েছে। তবে এখন আগের চেয়ে ১৩৩ টাকা কমিয়ে চট্টগ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জের নতুন ভাড়া ৪১৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। তারপরও মূল খরচের চেয়ে তা ১৬৫ টাকা বেশি। বাড়তি বো টাকা মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে ডব্লিউটিসি বেশি নিচ্ছে বলে শিল্প মালিকরা মনে করছে। সেজন্যই তারা ভাড়া আরো কমানোর দাবি তুলেছে। তবে ডব্লিউটিসি বলছে, ভাড়া এর চেয়ে কমালে শ্রমিক-কর্মচারীদের বৈষম্য দূর হবে না। বরং পুরো নৌখাতে আরো অস্থিরতা দেখা দেবে।
সূত্র আরো জানায়, দেশের ৩৬টি ঘাটে ডব্লিউটিসির মাধ্যমে লাইটার জাহাজ চলাচল করে। জাহাজ মালিকের সংগঠন বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিভোয়া) ও কোস্টা শিপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (কোয়াব) যৌথভাবে ডব্লিউটিসিকে ওই দায়িত্ব দেয়। কোন দিন কোন জাহাজে কী পরিমাণ পণ্য যাবে, কোন ঘাটে কোন জাহাজ নোঙর করবে ডব্লিউটিসি ওসব নির্ধারণ করে। ২০০৩ সালে চট্টগ্রাম চেম্বারের সহায়তায় তা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন সেল (ডব্লিউটিসিসি) নামে কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করে। পরে নাম থেকে ‘কো-অর্ডিনেশন’ শব্দটি বাদ দিয়ে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল নামে কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। যদিও বড় শিল্প মালিকদের ডাব্লিউটিসির উৎপত্তি ও সাংগঠনিক ভিত্তির বৈধতা নিয়ে শুরু থেকেই আপত্তি ছিল। কিন্তু ২০১৩ সালে তা প্রকট আকার ধারণ করলে কারখানা মালিকরা নিজেরাই লাইটার জাহাজ কিনে নিজেদের পণ্য পরিবহন শুরু করে। মূলত ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল থেকে চাহিদা মতো জাহাজ না পাওয়ায় এবং অতিরিক্ত ভাড়ার কারণে ওই খাতে সিমেন্ট, ভোগ্যপণ্যসহ বিভিন্ন খাতের শিল্পের উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করতে থাকে। তবে ২০২০ সালের মাঝামাঝি নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সিমেন্ট কারখানা মালিকদের ডব্লিউটিসির বাইরে গিয়ে জাহাজ পরিচালনা করার বৈধতাও দেয়। তারপর সিমেন্ট শিল্পের উদ্যোক্তারা লাইটার খাতে বিনিয়োগ আরো বাড়ায়। এখন লাইটার জাহাজ খাতে তাদের কয়েক হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আছে। কিন্তু শিল্প মালিকদের ৫০ শতাংশ জাহাজও বাধ্যতামূলকভাবে ডব্লিউটিসির মাধ্যমে পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত তাদের ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। তাদের মতে, নিজেদের পণ্য নিজেদের জাহাজে নিলে খরচ অনেক কম পড়ে। কিন্তু ডব্লিউটিসি মধ্যস্বত্বভোগী হয়ে বাড়তি ভাড়া নিচ্ছে। তাতে পণ্য পরিবহন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। জাহাজ মালিকরা সরাসরি কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারলে প্রতি টন পণ্যে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা ভাড়া কমবে। কিন্তু টাকা এখন ডব্লিউটিসির পেটে যাচ্ছে।
এদিকে ডব্লিউটিসি বলছে, নৌপথে শৃঙ্খলা ফেরাতেই তারা সমন্বয়ের কাজ করছে। কিন্তু শিল্প মালিকরা শুধু নিজেদের রেখে ছোট সবাইকে গ্রাস করতে চাচ্ছে। সেজন্যই কেউ কেউ ডব্লিউটিসিকে মধ্যস্বত্বভোগী আখ্যা দিচ্ছে। যদিও শিল্প মালিকরাই বছর ভিত্তিতে জাহাজ ভাড়া নিয়ে কিছু মধ্যস্বত্বভোগী পালন করছে। শিল্প মালিকদের মালিকানায় ২২০ থেকে ২৩০টি জাহাজ থাকলেও আরো অন্তত ৫০ থেকে ৭০টি জাহাজ মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে তারা নিজেদের পণ্য পরিবহন করছে। সেজন্য ইচ্ছামতো ভাড়া নির্ধারণ করছে আর শ্রমিক-কর্মচারীদের মধ্যেও বৈষম্য তৈরি করছেন। অথচ ডব্লিউটিসি শ্রমিকদের সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে কাজ করছে। ছোট-বড় সব জাহাজ মালিকই যাতে সুষমভাবে ভাড়া পায় সেদিকে দৃষ্টি দেয়া হচ্ছে। বেশি ভাড়া আদায় করার যে দাবি করা হচ্ছে তাও সত্য নয়।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম বন্দরে বড় জাহাজে আসা শস্যদানা, সার, গম, চিনি, ডাল জাতীয় খাদ্যপণ্য, সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামাল ক্লিঙ্কার, চুনাপাথর, জিপসাম, পাথর ইত্যাদি পণ্য লাইটার জাহাজে স্থানান্তর করে দেশের ৩৬টি নৌঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়। তাছাড়া সারাদেশে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের সরঞ্জামও নৌপথে পরিবহন করা হয়। ডব্লিউটিসি প্রতিদিন আমদানিকারদের চাহিদা অনুযায়ী গড়ে ৫০ থেকে ৫৫টি জাহাজ বরাদ্দ দিচ্ছে। প্রতিদিনের গড় হিসাবে তারা প্রায় ৭০ হাজার থেকে ৭৫ হাজার টন পণ্য পরিবহনের জন্য লাইটার জাহাজ সরবরাহ করছে। আবার বিক্ষিপ্তভাবে কিছু শিল্পপ্রতিষ্ঠান নিজেরাই পণ্য আনা-নেয়া করছে।
এ প্রসঙ্গে ডব্লিউটিসির নির্বাহী পরিচালক মাহবুব রশিদ জানান, সব মিলিয়ে বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় লাখ টন পণ্য নৌপথে পরিবহন হয়। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য নিয়ে সারাদেশে দুই ধরনের লাইটার জাহাজ যায়। কিছু লাইটার ২ হাজার টন ধারণক্ষমতার। আর কিছু লাইটার গড়ে এক হাজার ১০০ টন পণ্য পরিবহন করতে পারে। ছোট আকৃতির লাইটার জাহাজের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। বিশাল এই কর্মযজ্ঞ সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করতে সম্প্রতি সিমেন্ট কারখানা মালিকদেরও তাদের অধীনে থাকা লাইটার জাহাজের ৫০ শতাংশ ডব্লিউটিসির মাধ্যমে পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত জানায় নৌপরিবহন অধিদপ্তর। সেজন্য ডব্লিউটিসিকে ভাড়া তালিকাও সংশোধন করতে বলা হয় । নির্দেশনা পেয়ে আগের চেয়ে ১০ থেকে ২০ শতাংশ দর কমানো হয়েছে। ডব্লিউটিসি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার নারায়ণগঞ্জে সিমেন্টের কাঁচামাল নিতে টনে ১৩৩ টাকা কমিয়েছে। তবে চট্টগ্রাম থেকে ঘোড়াশালে ভাড়া কমেছে মাত্র ১১০ টাকা। আবার চট্টগ্রাম থেকে নোয়াপাড়ায় পণ্য নিতে ভাড়া আগের চেয়ে মাত্র ৯২ টাকা কমানো হয়েছে। তারপরও নতুন নির্ধারিত ভাড়া নিয়েও শিল্পকারখানা মালিকরা আপত্তি তুলেছে। তারা মনে করে এখনো প্রতি টনে ১৫০-২০০ টাকা মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে ডব্লিউটিসি বেশি নিচ্ছে। তবে বেশিরভাগ কারখানা মালিক নতুন ভাড়া মেনে নিয়েছে। কিন্তু পেশিশক্তি দেখাতে অল্প কিছু কারখানা মালিক নিয়ম না মেনে জাহাজ চালাতে চাচ্ছে। সেজন্যই শ্রমিকরা তাদের বাধা দিচ্ছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি ঘাটে অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিভোয়া) সাধারণ সম্পাদক মো. নূরুল হক জানান, ২০০৩ সালের আগে মধ্যস্বত্বভোগীরা আমদানিকারকদের কাছ থেকে ৩ থেকে ৪ গুণ বেশি ভাড়া আদায় করতো। ডব্লিউটিসি গঠনের পর তাদের দৌরাত্ম্য কমেছে। তবে এখন শিল্প মালিকদের সঙ্গে বছরভিত্তিক চুক্তি করে কিছু মধ্যস্বত্বভোগী লাইটার ব্যবসা করছে। তারাই এখন নতুন নিয়ম নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করছে।
একই প্রসঙ্গে সিমেন্ট প্রস্তুতকারক সমিতির সভাপতি মো. আলমগীর কবির জানান, মধ্যস্বত্বভোগীদের লোভে অতিষ্ঠ হয়ে শিল্পমালিকরা নৌপথে হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। অথচ এখন আবার বলা হচ্ছে শিল্পমালিকদের লাইটারের বুকিংও ডব্লিউটিসি থেকে নিতে হবে। নিজেদের লাইটারে যে পণ্য শিল্পমালিকরা ২৫০ টাকায় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আনতে পারে, সেজন্য ডব্লিউটিসি নিচ্ছে ৪১৫ টাকা। প্রতি টন পণ্যে শিল্পমালিকরা মধ্যস্বত্বভোগী ডব্লিউটিসিকে বাড়তি ১৬৫ টাকা দেবে কেন?