নিজস্ব প্রতিবেদক:
শিল্পখাতে নতুন করে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে নির্মাণশিল্পের অপরিহার্য উপকরণ রড উৎপাদনে টনপ্রতি খরচ ১ হাজার ২০০ টাকার বেশি বাড়তে পারে। বাড়তি এ উৎপাদন খরচ শেষ পর্যন্ত যুক্ত হবে পণ্যের দামে। রড় উৎপাদন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির ফলে গ্রাহকপর্যায়ে প্রতি টন রডের দাম ১ হাজার ২০০ থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়তে পারে। তবে কোম্পানির সক্ষমতাভেদে এ খরচ ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। আর রডের দাম বাড়লে অবশ্যই সব ধরনের অবকাঠামো বা নির্মাণ খাতের ব্যয়ও বাড়বে। বিশেষ করে সরকারের চলমান বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পের খরচও অনেক বেড়ে যাবে। জানা গেছে, গত এক বছরে রডের দাম ভেঙেছে অতীতের সব রেকর্ড। সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হচ্ছে সিমেন্ট। দাম বাড়ার রেকর্ড গড়েছে ইট, বালু, ভরাট বালু, পাথরও। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে নির্মাণে জড়িত শ্রমিকের খরচও। মূল্যবৃদ্ধির এ প্রভাব পড়েছে আবাসন প্রকল্পগুলোতে। নির্মাণ খরচ বেড়ে যাওয়ায় বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে ফ্ল্যাট। চলে যাচ্ছে মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। চাপ পড়েছে বাড়ি ভাড়ায়। এদিকে, নির্মাণ খরচ বাড়ায় দাম বেড়েছে সব ধরনের ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্টের। বর্ধিত দামের কারণে গত বছর বিক্রি নেমে আসে অর্ধেকে। যদিও খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্মাণসামগ্রীর দাম কমলে আবারও ফ্ল্যাটের দাম কমে আসবে। তবে চলমান বা শেষ পর্যায়ের প্রকল্পের ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্ট বর্ধিত দামেই বিক্রি হবে। মূলত খরচের সঙ্গে সমন্বয় করেই এ দরে তারা বিক্রি করছেন। আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের এক তথ্য বলছে, দুই বছরের ব্যবধানে প্রতি টন রডের দাম বেড়েছে ৩০ হাজার টাকা। ২০২০ সালে এক টন রড ছিল ৬৪ হাজার টাকা, ২০২১ সালে ৬ হাজার টাকা বেড়ে হয় ৭০ হাজার টাকা। আর ২০২২ সালে কয়েক ধাপে ২৪ হাজার টাকা বেড়ে সর্বোচ্চ ৯৪ হাজার টাকায় ঠেকে। এবং চলতি বছর তা ৯৪ হাজার টাকার বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। একইভাবে বেড়েছে সিমেন্ট, বালু, পাথর, ইট, থাই অ্যালুমিনিয়াম, গ্রিল ও রেলিং, জেনারেল ইলেকট্রিফিকেশন, স্যানিটেশন, টাইলস ও শ্রমিক খরচ। এতে ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্টের দাম প্রতি স্কয়ার ফুটে বেড়েছে ৫৪১ টাকা ৩৮ পয়সা। দুই হাজার ফুট কনস্ট্রাকশনের ক্ষেত্রে এর মধ্যে শুধু রডের দাম বাড়ার কারণে ফ্ল্যাটের প্রতি স্কয়ার ফুটে নির্মাণখরচ বেড়েছে ১২০ টাকা। একইভাবে সিমেন্টের কারণে ৪৪ টাকা, বালুর কারণে ২৩ টাকা, ইটের কারণে ৪০ টাকা, পাথরের কারণে ৬৭ টাকা ৫০ পয়সা, থাই অ্যালুমিনিয়ামের কারণে ৩৫ টাকা, শ্রমিক খরচের কারণে বেড়েছে ৭০ টাকা পর্যন্ত। এদিকে দুই বছর আগে প্রতি ব্যাগ সিমেন্ট পাওয়া যেত ৩৭৫ থেকে ৪০৫ টাকায়, ২০২১ সালে ছিল ৩৯০ থেকে ৪২৫ টাকা। যেটা বর্তমানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৭৫ থেকে ৫৬০ টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে প্রতি ব্যাগ সিমেন্ট বেড়েছে ৮৫ থেকে ১৩৫ টাকা। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে প্রতি ব্যাগ সিমেন্টে দাম বেড়েছিল ১৫ থেকে ২০ টাকা। যেটা এর পরের বছর সর্বোচ্চ ১৩৫ টাকা পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে এবং এখনও তেমনই রয়েছে। পাশাপাশি দাম বেড়েছে বিভিন্ন (লাল, সাদা ও ভরাট বালু) বালুর। সিএফটি হিসাবে এর আগে যেটা ৫০ থেকে ৭০ পয়সায় বিক্রি হয়েছে এখন তা আড়াই থেকে তিন টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক বছরের মধ্যে শুধু পাথরের দাম ৬০ টাকা, দুই বছরের ব্যবধানে দাম বেড়েছে ৮০ টাকা। দুই বছর আগে প্রতি স্কয়ার ফুট পাথরের দাম ছিল ১৬০ টাকা, এখন তা ২৫০ টাকার কাছাকাছি। অন্যদিকে, ইটের দাম বেড়েছে ৪ থেকে ৬ টাকা পর্যন্ত। দুই বছর আগে একটি ইটের দাম ছিল ৬ থেকে ৮ টাকা, পরের বছর ২০২১-এ হয় ৮ থেকে ১০ টাকা। আর বিদায়ী ২০২২ সালে সেখানে আরও ৪ টাকা বেড়ে হয় সর্বোচ্চ ১৪ টাকা। এদিকে, দুই বছরে থাই অ্যালুমিনিয়ামের দাম বেড়েছে ১৭০ টাকা পর্যন্ত। গ্রিল ও রেলিংয়ের দামও বেড়েছে ৫৫ টাকা পর্যন্ত। স্যানিটারি পণ্য ও জেনারেল ইলেকট্রিফিকেশনের দামও বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। এসবের সঙ্গে শ্রমিকের মূল্যও বেড়েছে। দুই বছর আগে প্রতি স্কয়ার ফুটের জন্য শ্রমিক খরচ হতো ১৪০ টাকা, ২০২১ সালে সেটা হয় ১৬০ টাকা। যা এর পরের বছর প্রতি স্কয়ার ফুটে ৭০ টাকা বেড়ে হয় ২৩০ টাকা। এদিকে নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় ফ্ল্যাটের ভাড়াও বাড়িয়ে দিয়েছেন ফ্ল্যাট মালিকরা। এতে সংকটে ভাড়াটিয়ারা। নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক দামে সব শ্রেণির মানুষ বিপাকে। উল্লেখযোগ্য হারে তাদের আয় বাড়েনি। এ কারণে সংসার চালাতে হচ্ছে খরচ কাটছাঁট করে। রাজধানীতে যাদের আয় ২০ হাজার টাকার মধ্যে তারা সংসার চালাতে এখন ঝুপড়ি ঘরে থাকছেন। আর ৩০ হাজারের মধ্যে আয় হলে তাদের ভরসা এখন ১০ হাজার টাকার মধ্যে সাবলেট। বাড়তি খরচ থেকে বাঁচতে অনেকেই পরিবার গ্রামে পাঠিয়ে ব্যাচেলর জীবন-যাপন করছেন। অনেকেই আবার বড় সাইজের ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে বেছে নিচ্ছেন ছোট ফ্ল্যাট বা ঝুপড়ি ঘর। এসব নিয়ে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সহ-সভাপতি প্রকৌশলী সোহেল রানা বলেন, ২০২০ সাল থেকে নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়তে থাকে। ২০২২-এর বছরজুড়েই দাম ছিল বেশি। এতে আবাসন ব্যবসায় শঙ্কাও তৈরি হয়। ফ্ল্যাট বিক্রি কমে যায়। ২০২২ সাল ব্যবসাবান্ধব হয়নি। তিনি বলেন, নতুন ড্যাপের কারণে আবাসনের স্বপ্ন মধ্যবিত্তদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। সবার জন্য মানসম্মত আবাসন কঠিন হয়ে যাবে আগামীতে। এসব সমস্যার সমাধান প্রয়োজন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ মুহূর্তে এই শিল্পে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির চেয়ে বড় সমস্যা ডলার-সংকটে কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র খুলতে না পারা। কাঁচামাল আমদানির সংকটের কারণে দেশেও স্ক্র্যাপের দাম বাড়তে শুরু করেছে। আমদানি স্বাভাবিক না হলে এ খাতে সংকট আরও বাড়বে। কাঁচামাল আমদানি স্বাভাবিক থাকলে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির এ চাপ আমরা মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। তাই আমদানি ঋণপত্র খোলার জটিলতার দ্রুত সমাধান চান নির্মাণশিল্পে সংশ্লিষ্টরা।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ