November 19, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Friday, December 17th, 2021, 9:00 pm

আর্থিক খাতে জালিয়াতি বন্ধে শুরু হচ্ছে বহুমুখী তদারকি

প্রতীকী ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

আর্থিক খাতে জালিয়াতি বন্ধ ও অর্থ লোপাটকারীদের শনাক্তে বহুমুখী তদারকি শুরু হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মিত ও বিশেষ তদন্তের পাশাপাশি প্রযুক্তিকেও কাজে লাগানো হবে। এর আওতায় এক ছাতার নিচে আসবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সব লেনদেন। ফলে একটি বোতাম টিপেই মিলবে জালজালিয়াত বা অর্থ লুটেরাদের লেনদেনের সব তথ্য।
এ লক্ষ্যে গঠন করা হচ্ছে ইন্টার-অপারেবল ডিজিটাল ট্রানজেকশন প্ল্যাটফরম (আইডিটিপি)। যেখানে এক আইডিতে (জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর) গ্রাহকের সব হিসাব ও লেনদেনের তথ্য থাকবে। কেন্দ্রীয় গেটওয়ে দিয়ে হবে সব লেনদেন।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এ ধরনের কাঠামো কার্যকর হলে অর্থনৈতিক অপরাধ রোধে যোগ করবে নতুন মাত্রা। লেনদেন সহজ হবে। নগদ টাকার পরিবর্তে গ্রাহকরা অনলাইন লেনদেনে উৎসাহিত হবেন। ভূমিকা রাখবে কাগজের মুদ্রাবিহীন সমাজ (ক্যাশলেস সোসাইটি) গঠনেও, যা উন্নত দেশগুলোয় ইতোমধ্যে গঠিত হয়েছে।
জাল আর্থিক প্রতিবেদনের মাধ্যমে আর্থিক অবস্থা ভালো দেখিয়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেয়ার সংস্কৃতি চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরেই। ঋণের ক্ষেত্রে নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই-বাছাইয়ের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেটি পরিপালন করছিল না ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে এ ধরনের প্রবণতা রোধ করতে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল (এফআরসি)। এরইমধ্যে সংস্থাটির পক্ষ থেকে ঋণ অনুমোদন ও নবায়নের ক্ষেত্রে নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন জমা নেয়া সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা যথাযথভাবে পরিপালন করা হচ্ছে কিনা সেটি খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে দেশের সব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের পাশাপাশি নিরীক্ষকদের চিঠি পাঠিয়েছে এফআরসি।
ঋণ অনুমোদন বা নবায়নের সময় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে বাধ্যতামূলকভাবে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসের মাধ্যমে নিরীক্ষিত এবং স্টেকহোল্ডারদের জন্য প্রণীত হালনাগাদ আর্থিক প্রতিবেদন গ্রহণ এবং তা যথাযথভাবে ঋণ ফাইলে সংরক্ষণ করে সে বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের পক্ষ থেকে এ বছরের ৪ জানুয়ারি একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। পরবর্তী সময়ে গত ৬ জুলাই জারি করা আরেকটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ঋণ অনুমোদন বা নবায়নের সময় ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের জমা দেয়া আর্থিক প্রতিবেদন ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) ডকুমেন্ট ভেরিফিকেশন সিস্টেম (ডিবিএস) ডাটাবেজের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশ দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এসব নির্দেশনা যথাযথভাবে পরিপালন করা হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করার জন্য এফআরসির পক্ষ থেকে এরইমধ্যে ৬০টি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের কাছে চিঠি দেয়া হয়েছে। চিঠিতে ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন প্রণয়নের সময় অন্য বিধি-বিধানের সঙ্গে ঋণ অনুমোদন বা নবায়নের ক্ষেত্রে নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন জমা নেয়া, সংরক্ষণ ও ডিবিএসের ডাটাবেজের সঙ্গে যাচাই করা সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা কতটুকু পরিপালন করা হয়েছে সে বিষয়ে একটি নোট সংযোজন করতে বলা হয়েছে। এ বছরের ৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত হিসাব বছর এবং তার পরবর্তী হিসাব বছর শেষে ব্যাংকগুলোর আর্থিক বিবরণী প্রণয়নের সময় কত শতাংশ ঋণ ফাইলেÑকেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা পরিপালন করা হয়েছে তা সুনির্দিষ্টভাবে আর্থিক বিবরণী নোটস টু দ্য অ্যাকাউন্টসে ডিসক্লোজার হিসেবে সংযোজন করতে হবে। ব্যাংকের পাশাপাশি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যও এফআরসির পক্ষ থেকে অনুরূপ নির্দেশনা পাঠানোর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
এদিকে, সব ধরনের পেমেন্ট সিস্টেম কার্যক্রম পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণে ‘পেমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট সিস্টেমস আইন ২০২১’-এর খসড়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এ আইন অনুযায়ী পেমেন্ট তথা পরিশোধ ব্যবস্থা পরিচালনাকারী, পরিশোধ ব্যবস্থায় অংশগ্রহণকারী ও পরিশোধ সেবাদানকারীর কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি প্রদান, তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ থাকবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে। কোনো সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের যদি অবসায়ন ঘটে তাহলে দায়দেনা পরিশোধের ক্ষেত্রে আইনে গ্রাহকদের অগ্রাধিকার দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে।
সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ অনুমোদন দেয়া হয়। ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে গণভবন থেকে প্রধানমন্ত্রী ও সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে মন্ত্রী এবং প্রতিমন্ত্রীরা বৈঠকে যোগ দেন। বৈঠক শেষে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম প্রেস ব্রিফিংয়ে এ অনুমোদনের কথা জানান।
তিনি বলেন, ব্যাংকে যেসব পেমেন্ট এবং সেটেলমেন্ট হচ্ছে, সেখানে কোনো আইন ছিল না। কিছু রেগুলেশন দিয়ে পরিচালিত হতো। বর্তমান অবস্থায় ডিজিটাল লেনদেন হওয়ার কারণে এ আইন নিয়ে আসা হয়েছে। খসড়া আইনে ৪৭টি ধারা রয়েছে। তবে ক্রিপ্টোকারেন্সি বা ভার্চুয়াল মুদ্রা এ আইনে যুক্ত করা হয়নি বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব। বলেন, ক্রিপ্টোকারেন্সির সঙ্গে এ আইনের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। ক্রিপ্টোকারেন্সি ইজ নট আ কারেন্সি। ওটা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অনুমোদিত কোনো ট্রানজেকশন না। ডিজিটাল ব্যাংকিং ডাজ নট মিন ক্রিপ্টোকারেন্সি, এটা খেয়াল রাখতে হবে।
আইনটি প্রণয়নে যুক্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ আইনের মাধ্যমে দেশে কার্যরত সব পরিশোধ ব্যবস্থা পরিচালনাকারী, নিকাশ ও নিষ্পত্তিকরণ কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি প্রদান, তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে বাংলাদেশে কার্যরত স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর কার্যক্রম এ আইনের বাইরে থাকবে।
জানা গেছে, বর্তমানে অনেক ধরনের লেনদেন হচ্ছেÑমূল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বাইরে ইন্টারনেট ও এজেন্ট ব্যাংকিং, ইলেকট্রনিক তহবিল স্থানান্তর, ক্রেডিট ও ডেবিট কার্ডসহ বিকাশ, নগদ, রকেট, বিভিন্ন ব্যাংকের ই-ওয়ালেট, ইন্টারনেট ব্যাংকিং, ইলেকট্রনিক মুদ্রা, ইলেকট্রনিকভাবে তহবিল স্থানান্তর, চেক ইলেকট্রনিকভাবে উপস্থাপন, ডিজিটাল মুদ্রা, ট্যাংকেটেড চেক, ট্রাস্ট কাম সেটেলমেন্ট অ্যাকাউন্ট, সরকারি সিকিউরিটিজ সেটেলমেন্ট সিস্টেম ইত্যাদি। এসব পদ্ধতির মাধ্যমে অর্থ পরিশোধ, অর্থ গ্রহণ ও গ্রাহকের অর্থ চাহিদা নিষ্পত্তি হচ্ছে। আর এসব পদ্ধতি ব্যবহার করছে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, এজেন্ট ব্যাংকিংসহ বিভিন্ন ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউট। এদের কার্যক্রম তদারকি ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ঝুঁকি কমানো এবং গ্রাহকের স্বার্থ সংরক্ষণে এ আইন গ্রণয়ন করা হচ্ছে।
এতদিন বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডারের অধীনে তৈরি করা রেগুলেশন দ্বারা দেশের পেমেন্ট সিস্টেম ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হতো। রেগুলেশনের বিষয়ে আদালতের এখতিয়ার ও দ- সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশনা না থাকায় পেমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট সিস্টেমস আইন প্রণয়নের গুরুত্ব বাড়তে থাকে। প্রযুক্তির আধুনিকায়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে দেশে নতুন নতুন পেমেন্ট সেবা প্রতিষ্ঠান যুক্ত হচ্ছে। এ অবস্থায় পেমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট সিস্টেমস আইনের খসড়া তৈরি শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা ও দীর্ঘ পর্যালোচনাশেষে পেমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট সিস্টেমস আইন-২০২১-এর খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
খসড়া আইনে শাস্তির বিষয়ে বলা হয়েছে, বিধিবিধান লঙ্ঘন করে কোনো প্রতিষ্ঠান লেনদেন ব্যবসা পরিচালনা করলে সংশ্লিষ্ট দায়ী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর বিধিনিষেধ আরোপসহ সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা জরিমানা আরোপ করতে পারবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স স্থগিত ও প্রত্যাহার করা হতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লাইসেন্স না নিয়ে বা কোনো বিধি লঙ্ঘনের দায়ে লাইসেন্স বাতিল হওয়ার পর কেউ এ ধরনের ব্যবসা পরিচালনা করলে সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ এবং সর্বনিম্ন ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হবে। এর পরও একই কার্যক্রম অব্যাহত রাখলে প্রতিদিনের জন্য ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা হবে।
উল্লেখ্য,ডি-৮ অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তির (পিটিএ) আওতায় আট দেশের মধ্যে আমদানি-রফতানি শুল্ক ১৫ শতাংশ থেকে কমে ১০ শতাংশ করা হচ্ছে। এজন্য ডি-৮ প্রিফারেন্সিয়াল ট্রেড এগ্রিমেন্টের (পিটিএ) আওতায় অন্য সদস্য দেশগুলোর শুল্ক ছাড় দেয়ার পণ্য তালিকা ও সার্টিফিকেট অব অরিজিন অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা, জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব।