নিজস্ব প্রতিবেদক :
অপরাধী চক্র মানুষের প্রযুক্তিমুখী হওয়ার সুযোগটা কাজে লাগাচ্ছে। তারা সাইবার জগতে ফাঁদ পেতে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে অর্থ এবং একই সাথে বিপদে ফেলছে। অনেক ক্ষেত্রে অপরাধী ধরা পড়লেও সব ধরনের প্রতারণার সাজা একই হওয়ায় বড় অপরাধ করেও অপরাধীরা ছাড় পেয়ে যাওয়ায় তারা আরো বড় অপরাধে জড়াচ্ছে। বর্তমানে দেশে প্রযুক্তির সুযোগ নিয়ে শত শত প্রতারণা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। আর সামাজিক মাধ্যমে প্রতারণার ফাঁদে পড়েছে হাজার হাজার ভুক্তভোগী। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রলোভন দেখিয়ে পাতা হচ্ছে ঋণের ফাঁদ। আর ওই ফাঁদে পড়ে দেশের হাজার হাজার তরুণ-তরুণী ঋণ নিয়ে প্রতারিত হচ্ছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো অন্ধকারেই রয়েছে। এমনকি অ্যাপভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কতো টাকা লেনদেন হচ্ছে তা জানা তো দূরের কথা, অ্যাপভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ দেয়ার কথাই জানে না বাংলাদেশ ব্যাংক। অথচ অনলাইনে জামানতবিহীন ঋণের হাতছানিতে অনেক তরুণ-তরুণীই হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। অনলাইনে সুদের কারবারিদের প্রথম টার্গেটই হচ্ছে বেকার যুবকরা। আর তাদের অধিকাংশই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অথবা করোনাকালে কাজ হারানো মানুষ। বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ফলে টিউশনি করে পড়ালেখার খরচ চালানো অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী বিপদে পড়েছে। পরিবার ও আশপাশের মানুষের কাছে সহযোগিতা না পেয়ে বাধ্য হয়েই তারা চড়া সুদের জালে পা দিচ্ছে। অ্যাপভিত্তিক ঋণের টাকা গ্রাহককে বিকাশ অথবা নগদ অ্যাকাউন্টে পরিশোধ করা হচ্ছে। অর্থাৎ অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তির সরাসরি সম্পৃক্ততা নেই। এমন পরিস্থিতিতে অ্যাপভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ভুক্তভোগীদের পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগের ফেসবুকে পেইজে অভিযোগ দেয়ার অনুরোধ জানিয়েছে পুলিশ। একইসঙ্গে প্রতারণার বিষয়ে সাধারণ মানুষকে আরো সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও সমাজবিজ্ঞানীরা।
সূত্র জানায়, এখন বেশিরভাগ প্রতারণা অনলাইনভিত্তিক হচ্ছে। অনলাইনের মাধ্যমে মানুষ ঘরে বসে মোবাইলে রিচার্জ বা যে কোনো কেনাকাটা করতে পারছে। আবার সেখানে মানুষ প্রতারিতও হচ্ছে। মূলত সরকারি কোনো নিয়মনীতি বা লাইসেন্সের বিষয় না থাকায় অনেকেই নামে-বেনামে প্রতিষ্ঠান খুলে বসছে। আর ওসব প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে নিশ্চিত সুযোগও মানুষের কম। পরিস্থিতি সামাল দিতে দ্রুত এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর মনিটরিং করা জরুরি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কাজ ব্যাংকগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু সক্ষমতার অভাবে স্বাভাবিকভাবে ওই কাজটিই বাংলাদেশ ব্যাংক করতে পারছে না। আর এ সুযোগে প্রতারক চক্র বেপরোয়া হয়ে অনলাইনে ঋণের ফাঁদ পেতে হাতিয়ে নিচ্ছে সাধারণ মানুষের শত শত কোটি টাকা। বর্তমানে ফেসবুকে র্যাপিড ক্যাশ, ক্যাশম্যান, ক্যাশক্যাশ, টাকাওয়ালা, এমক্যাশ বাংলাদেশসহ বেশকিছু অ্যাপসভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। প্রচলিত ব্যাংকিং নিয়মে একজন গ্রাহককে সুদ দিতে হয় ঋণের বিপরীতে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ। অথচ অ্যাপভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে সার্ভিস চার্জের নামে গ্রাহককে সুদ দিতে হচ্ছে ৫০ শতাংশেরও বেশি।
এদিকে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ জানান, দীর্ঘদিন ধরেই দেশে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) ও ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন ভুঁইফোর প্রতিষ্ঠান খুলে অপরাধী চক্র গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে। ভোক্তা অধিকার আইন অনুযায়ী ওসব প্রতারণা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আর তার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক নির্বিকার।
অন্যদিকে প্রযুক্তি নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনকৃত প্রতিষ্ঠানই শুধুমাত্র ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে। কিন্তু অনলাইনে ব্যাংকের বাইরে এমন ধরনের অ্যাপসের মাধ্যমে অর্থ লেনদেনের সুযোগ নেই। মূলত দেশে ডিজিটাল সুবিধার অপব্যবহার হচ্ছে। সেক্ষেত্রে ব্যক্তির ব্যক্তিগত নিরাপত্তা থাকছে না। সার্ভিস চার্জের নামে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে বড় অংকের অর্থ।
এ বিষয়ে সিআইডির সাইবার শাখার বিশেষ পুলিশ সুপার (এসপি) রেজাউল মাসুদ জানান, অ্যাপসের মাধ্যমে ঋণ দিতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিতে হয়। আবার ওয়েবপেজভিত্তিক ব্যবসা করতে চাইলে ই-কমার্স, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন লাগবে। ওসব অনুমোদন না নিয়ে যদি কেউ ঋণ বা লভ্যাংশ দেয় তবে অবশ্যই সেটা প্রতারণা। এ ধরনের কোনো অভিযোগ পুলিশ এখনো পায়নি। তবে যদি কেউ অভিযোগ করে যে প্রতারিত হয়েছে, তাহলে অবশ্যই বিষয়টি তদন্ত করা হবে।
আর অনলাইনে প্রতারণার বিষয়ে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ জানান, মানুষ এখন তথ্য প্রযুক্তিনির্ভরতা বা অনলাইনের প্রতি নির্ভরশীলতা বেড়েছে। সেজন্যই সাম্প্রতিক সময়ে অনলাইনে বিভিন্নভাবে মানুষ প্রতারণার শিকার হচ্ছে। মূলত যেখানেই মানুষের নির্ভরশীলতা বাড়ে, সেখানেই একধরনের প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে কিছু মানুষ সংক্ষিপ্তপন্থায় ধনী হবার চেষ্টা করে। এমন কোনো লেনদেনের বেলায় কাউকে সহজেই বিশ্বাস করা ঠিক নয়। বরং যে কোনো লেনদেনের পূর্বে প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়তে যাচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম জানান, ব্যাংক কোনো ঋণ দেয়ার আগে গ্রাহকের তথ্য ভালোভাবে যাচাই করে নেয়। কিন্তু কোনো চক্র যদি অনলাইনে এমন অ্যাপস খুলে ঋণ দিতে চায় সেক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু করার থাকে না। কারণ এসব ফাঁদে যেন না পড়ে সে ব্যাপারে বারবার গ্রাহককে বিভিন্নভাবে সতর্ক করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও এক শ্রেণীর প্রতারক এভাবে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। আর সাধারণ নিরীহ মানুষ তাদের ফাঁদে পা দিচ্ছে।
আরও পড়ুন
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে আগ্রহী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার: নাহিদ ইসলাম