নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেশের ব্যাংকিং খাতে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে খেলাপি ও ঋণ অবলোপন। অবলোপনের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কম দেখালেও প্রকৃত অর্থে তা ঠিকই বাড়ছে। মূলত সাময়িকভাবে ব্যাংকের স্বাস্থ্য ভালো দেখাতেই এমন কৌশল নিচ্ছে ব্যাংকগুলো। বিগত এক দশকে দেশে ২৫ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা ঋণ অবলোপন বেড়েছে। সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংকই ব্যালেন্স শিট পরিষ্কার রাখতে এমন কৌশলী অবস্থান নিচ্ছে। একই সময়ে খেলাপি ঋণের হার ৬ থেকে বেড়ে ১২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
বিআইবিএমের গবেষণার তথ্যানুযায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরে পুরো ব্যাংকিং খাতে ঋণ অবলোপনের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ৪৩ হাজার ২৭০ কোটি টাকা, যা ২০০৯-১০ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। সে হিসাবে ১০ বছরে ঋণ অবলোপন বেড়েছে ২৫ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা। ১০ বছর আগে সরকারি ব্যাংকের ঋণ অবলোপনের অঙ্ক ছিল ৭ হাজার কোটি টাকা। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৯৪০ কোটি টাকায়। আর বেসরকারি ব্যাংকের ঋণ অবলোপন ছিল ৬ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। বাকি ১৩৯০ কোটি বিশেষায়িত ও বিদেশি ব্যাংক অবলোপন করেছে। ৯ বছরের ব্যবধানে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের হার বেড়েছে দ্বিগুণ। অর্থাৎ ২০১১ সালে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ৬ শতাংশ। ২০১৯ সালে সে হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ শতাংশ।
এদিকে অর্থনীতিবিদদের মতে, খেলাপি নামের এই ক্যানসার ব্যাংকিং খাতের জন্য মোটেও ভালো নয়। ব্যাংকের সব সমস্যার মূল এই খেলাপি ঋণ। যে কোনো মূল্যে তা কমিয়ে আনতে হবে। বর্তমানে ঋণ অবলোপনের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কার্পেটের নিচে লুকিয়ে রাখা হচ্ছে। যে কারণে মাত্র এক লাখ কোটি টাকা খেলাপি দেখানো হচ্ছে। অথচ সব মিলিয়ে প্রকৃত খেলাপি ঋণ ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। আর খেলাপি ঋণের বড় অংশই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। ওসব টাকা ফেরত আনতে ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিকল্প নেই। তাছাড়া ঋণখেলাপিদের জেলে ঢুকিয়ে সম্পত্তি ক্রোক করে কিছু টাকা আদায় করা যেতে পারে। নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকের অশ্রেণীকৃত বা নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে পাঁচ শতাংশ হারে প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) রাখতে হয়। তবে খেলাপির নানা শ্রেণিভেদে ২০ থেকে ১০০ শতাংশ প্রভিশন রাখতে হচ্ছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালার আওতায় ২০০৩ সাল থেকে ঋণ অবলোপন করে আসছে ব্যাংকগুলো। যদিও প্রথমে পাঁচ বছরের পুরোনো মন্দমানের খেলাপি ঋণ অবলোপন করা যেতো। কিন্তু এখন ৩ বছর হলেই ঋণ অবলোপন করা যায়। সাধারণত খেলাপি হওয়ার পর যে ঋণ আদায় করার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ, ওই ঋণই অবলোপন করে ব্যাংকগুলো। তার আগে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ এবং অর্থঋণ আদালতে মামলা করতে হয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে খেলাপি ঋণ অবলোপনের ক্ষেত্রে নীতিমালায় কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। আগে মামলা ছাড়া ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত অবলোপন করা যেতো। আর এখন ২ লাখ টাকা পর্যন্ত মামলা ছাড়াই অবলোপন করা যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন শিথিল নীতিমালার কারণে ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ অবলোপন বাড়িয়েছে। গত কয়েক বছরে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। ২০১৯ সালে বিশেষ নীতিমালার আওতায় ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেয় সরকার। যদিও কোভিডের কারণে ব্যবসায়ীদের ক্ষতি বিবেচনায় কয়েক দফায় সুযোগ দেয়া হয়, যা গত ডিসেম্বরে শেষ হয়েছে। তাই এ ধরনের ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা কম থাকায় আর্থিক প্রতিবেদন পরিচ্ছন্ন দেখাতে কৌশলেই মন্দমানের খেলাপি ঋণ অবলোপন করার পথে হাঁটছে ব্যাংকগুলো।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জানান, ঋণ আদায়ে সব ধরনের চেষ্টা ব্যর্থ হলে ব্যাংকগুলো তখন অবলোপনের পথে হাঁটে। তবে ওই টাকা আদায়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। অনেক সময় অর্থঋণ আদালতের নানা দীর্ঘসূত্রতার কারণেও ঋণ আদায়ের গতি শ্লথ হয়ে যায়।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি