নিজস্ব প্রতিবেদক:
আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী নিয়ে ক্ষোভ বাড়ছে দলের তৃণমূল পর্যায়ে। অনেক প্রার্থীর বিরুদ্ধে কেন্দ্রে লিখিত অভিযোগ জমা পড়ছে। চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, হত্যা এবং সংখ্যালঘু ও নারী নির্যাতন মামলার আসামিরাও দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বিএনপিসহ বিভিন্ন দল থেকে অনুপ্রবেশকারীরাও দলীয় প্রার্থী হয়েছেন। এমনকি অতীতের বিদ্রোহী প্রার্থীরা কোনো অবস্থায়ই নৌকার মনোনয়ন পাবেন না বলে দৃঢ় ঘোষণা সত্ত্বেও কোনো কোনো জায়গায় এর ব্যত্যয় ঘটেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
বিএনপি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন বয়কট করেছে। অর্থাৎ মাঠে কোন প্রতিপক্ষ নেই। গোলপোস্ট ফাঁকা। এমন পরিস্থিতিতে স্বস্তিতে থাকার কথা আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের। কিন্তু তাঁদের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠছেন সম্ভাব্য বিদ্রোহী প্রার্থীরা। প্রার্থী হতে পারলেই যেখানে বিজয় নিশ্চিত সেখানে সহজে কেউ হাল ছাড়তে চাইছেন না। তাই আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের মধ্যেই কোন্দল বাড়ছে। একে অন্যের গুমোর ফাঁস করে দিচ্ছেন তারা। নিজের প্রার্থীতার উপযুক্ততা প্রমাণ করতেই সবাই মরিয়া। মনোনয়ন নিয়ে দলের বিভিন্ন পর্যায়ে যেভাবে ক্ষোভ দানা বাঁধছে, তাতে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদেরও উদ্বেগ বেড়েছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা অবশ্য বলছেন, তৃণমূল থেকে পাঠানো তালিকা যাচাই-বাছাই করেই দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে তৃণমূল থেকেই বিতর্কিতদের নাম পাঠানো হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে তথ্য গোপন করে নাম পাঠানো হয়েছে। সেসব অভিযোগ বিচার-বিশ্নেষণও করা হচ্ছে। প্রমাণ হলে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এরইমধ্যে বেশ কয়েকটি স্থানে দলীয় প্রার্থী বদল করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, আগামী ১১ নভেম্বর দ্বিতীয় ধাপে ৮৪৮টি ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) ভোট হবে। এর মধ্যে ৯০টি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রে অভিযোগ জমা পড়েছে। দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে তৃণমূলের নেতারা যেসব অভিযোগ করেছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে, মাদকসেবী, দুর্নীতিবাজ, চাঁদাবাজ, ভূমি দখলকারী, সংখ্যালঘু নির্যাতনকারী, খুনের মামলার আসামি, রাজাকারের সন্তান, মাদক ব্যবসায়ী, সন্ত্রাসী বাহিনী লালনকারী, এমনকি সরকারি ত্রাণ আত্মসাৎকারীরাও অনেক ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন। এর বাইরে মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীদের কেউ কেউ বিএনপি বা জামায়াতের নেতা ছিলেন। প্রবাসী এবং জনবিচ্ছিন্ন ব্যক্তিও আওয়ামী লীগের প্রার্থী হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন।
দ্বিতীয় দফার ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী বাছাই শুরু হয় ৭ অক্টোবর। সব বিভাগে প্রার্থী মনোনয়ন শেষ হয় ১২ অক্টোবর। প্রার্থী ঘোষণার পরপরই অভিযোগ আসতে থাকে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দপ্তর সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত ৭০ জন প্রার্থীর বিষয়ে লিখিত অভিযোগ এসেছে। আওয়ামী লীগের সংসদীয় ও স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের প্রধান এবং দলের সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে খুদে বার্তায় (এসএমএস) কিংবা অন্য উপায়ে আরও ২০ জন প্রার্থীর বিষয়ে অভিযোগ এসেছে। এ ছাড়া সংক্ষুব্ধ কয়েক শ নেতা ও সম্ভাব্য প্রার্থী এবং তাঁদের সমর্থকেরা ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে, কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দলের মনোনীত প্রার্থীদের বিষয়ে নানা অভিযোগের কথা তুলে ধরেছেন।
দ্বিতীয় ধাপে ৮৪৮টি ইউনিয়নের নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার জন্য দলীয় ফরম সংগ্রহ করেছিলেন ৪ হাজার ৪৫৮ জন প্রার্থী। অর্থাৎ প্রতি ইউনিয়নের জন্য গড়ে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন পাঁচজন। প্রতিটি ফরমের দাম রাখা হয় পাঁচ হাজার টাকা।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, দুর্নীতিতে অভিযুক্ত, এর আগে বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন কিংবা অরাজনৈতিক কাউকে এবার ইউপি ভোটে মনোনয়ন দেওয়া হবে নাÑএমন নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন দলের নীতিনির্ধারকেরা। এ বিষয়ে তৃণমূলে মৌখিক নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছিল। কেন্দ্রীয় ও তৃণমূল নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, কোথাও কোথাও নাম পাঠানোর ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি করেছেন স্থানীয় মন্ত্রী, সাংসদসহ উপজেলা পর্যায়ের প্রভাবশালী নেতারা। আবার কিছু ক্ষেত্রে তৃণমূল থেকে যাঁদের বিষয়ে নেতিবাচক প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছিল, তা আমলে নেয়নি কেন্দ্রীয় মনোনয়ন বোর্ড। প্রার্থীদের নিয়ে ওঠা অভিযোগের পেছনে আসলে কেন্দ্র ও তৃণমূলÑদুই দিকেরই দুর্বলতা রয়েছে।
দলীয় সূত্র বলছে, মন্ত্রী ও সাংসদেরা যেসব জেলা-উপজেলার সভাপতি কিংবা সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন, সেসব জায়গায় দলীয় প্রার্থী হিসেবে কেন্দ্রে নাম পাঠানোর ক্ষেত্রে তাঁদের ইচ্ছে গুরুত্ব পেয়েছে। আবার যেসব জেলায় মন্ত্রী-সাংসদেরা দলীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নেই, সেব এলাকায় স্থানীয় নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁদের দ্বন্দ্ব প্রকট। এমনও ঘটনা ঘটেছে, ইউনিয়ন থেকে সম্ভাব্য নামের তালিকা উপজেলায় গিয়ে পরিবর্তন হয়ে গেছে। উপজেলার তালিকা জেলা কমিটি পরিবর্তন, পরিবর্ধন করেছে। আবার কয়েকটি জেলা ও উপজেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক আলাদা আলাদা তালিকাও কেন্দ্রে পাঠিয়েছেন। এসব কারণে তৃণমূল থেকে পাঠানো নামের বাইরেও দলের নেতা-কর্মীদের কাছে কেন্দ্র থেকে মনোনয়ন ফরম বিক্রি করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে- অতীতে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করা কেউ জনপ্রিয় হলেও তাকে আর দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হবে না। কিন্তু দলের এই রুইকাতলারা যতই স্বচ্ছতা ও কঠোরতার কথা বলুক না কেন দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিদ্রোহী প্রার্থীর হাতে নৌকার প্রতীক শোভা পাচ্ছে। পটুয়াখালীর দুটি ইউপিতে বিদ্রোহী প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৬ সালের ইউপি নির্বাচনে পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার নওমালা ইউপিতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে পরাজিত হওয়া কামাল হোসেন বিশ্বাস ২০১৯ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নৌকার বিপক্ষে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছিলেন। তিনি এবার নওমালা ইউপিতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন।
একইভাবে পটুয়াখালীর দশমিনা ইউনিয়নে গতবারের বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে বিজয়ী ইকবাল মাহমুদ লিটন এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। মনোনয়নের তালিকায় তার নাম পাঠানোর বিষয়ে জেলা সভাপতি আলমগীর হোসেন বলেন, আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতার নির্দেশে লিটনের নাম কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছিল।
তবে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ বলেন, বিদ্রোহী প্রার্থীকে কোনোমতেই দলের মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। পটুয়াখালীতে যিনি মনোনয়ন পেয়েছিলেন, তিনি ছিলেন উপজেলায় ডামি প্রার্থী। সেটা আগেই দলকে জানিয়ে রাখা হয়েছিল।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ