নিজস্ব প্রতিবেদক:
নির্বাচন কমিশনের সক্রিয় উদ্যোগের অভাবে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে দেশব্যাপী সহিংসতা বাড়ছে। মাঠ প্রশাসন থেকে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে এমন বার্তাই এসেছে।
ইতোমধ্যে চলমান দশম ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপ শেষ হয়েছে। ঘোষণা দিয়ে এই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মাঠের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি। কিন্তু তাতেও নিরঙ্কুশ সাফল্য আসছে না ব্যালট বাক্সের ফলে। অনেক ইউপিতেই নৌকার প্রার্থীরা পরাজিত হচ্ছেন ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’ তথা দলের মনোনয়ন থেকে বঞ্চিতদের কাছেই। কোথাও কোথাও অবশ্য ধানের শীষ না নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সামিল হচ্ছেন বিএনপি প্রার্থীরাও। সব মিলিয়ে ভোটের মাঠে কোথাও দ্বিমুখী, কোথাও ত্রিমুখী ‘ছায়াশত্রু’র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা।
মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, জেলা ও উপজেলা নির্বাচনী কর্মকর্তারা নির্বাচনি আচরণবিধি নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেন না। তারা শুধু সংশ্লিষ্টদের ট্রেইনিং করিয়ে দায়িত্ব শেষ করেন। কিন্তু প্রার্থীরা নির্বাচনি আচরণবিধি মেনে চলছেন কিনা, না চললে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নির্বাচন কর্মকর্তারা নেন না। ফলে ভোটের দিন সংঘাতে জড়ানোর সাহস পাচ্ছেন প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা।
সূত্র জানায়, ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা হত্যা অব্যাহত আছে। কুমিল্লায় আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে এক প্রার্থীসহ ১০ জন আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। এদিকে, লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জে মাঝেমধ্যেই সহিংসতা ঘটছে। এখানে সন্ত্রাসীরা ভোটারদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সূত্র জানায়, যশোরের শার্শা উপজেলার বাগআঁচড়া ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে আহত মোস্তাক ধাবক মারা গেছেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার ভোরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর খবর পেয়ে সকাল থেকেই এলাকাবাসী যশোর-সাতক্ষীরা সড়ক অবরোধ ও টায়ার জ¦ালিয়ে বিক্ষোভ করে। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
এদিকে, শনিবার দুপুরে চৌগাছা উপজেলার হাকিমপুর ইউনিয়নের হাজীপুর গ্রামে পরাজিত দুই নারী সদস্য প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে শতকত আলী খাঁ নামের এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন।
শার্শায় নিহত মোস্তাক ধাবক স্থানীয় বাগআঁচড়া ইউনিয়নের সাতমাইল গ্রামের বাসিন্দা। তার আত্মীয় হাসানুজ্জামান জানান, গত মঙ্গলবার শার্শার বাগআঁচড়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল খালেক ও নৌকার প্রার্থী ইলিয়াছ কবির বকুলের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে মোস্তাক, তার বাবা আবদুল খালেক খতিব ও তার ভাই সাজ্জাদুল আহত হন। তারা আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থী আবদুল খালেক ধাবকের কর্মী। মোস্তাকের অবস্থার অবনতি ঘটায় পরের দিন তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।
নাভারণ সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) জুয়েল ইমরান জানান, যশোর-সাতক্ষীরা সড়ক অবরোধের খবর পেয়ে তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। পরিস্থিতি বর্তমানে স্বাভাবিক আছে।
অন্যদিকে, চৌগাছার হাকিমপুর ইউনিয়নের হাজীপুর গ্রামে সংঘর্ষে নিহত শওকত পেশায় রাজমিস্ত্রি। স্থানীয়রা জানান, শনিবার স্থানীয় সেলিমের বাড়িতে শওকত কাজে যান। সেখানে তার ভাবি সাহিদা বেগমের নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বী পলি পারভীনের বাগ্বিত-া হয়। পরে শওকত পরিবারের লোকজন সেখানে গেলে দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। একপর্যায়ে তার বুকে একটি ইট লাগে।
কুমিল্লার হোমনায় উপজেলার ঘাড়মোরা ইউনিয়নেও আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে দু’দফা সংঘর্ষ হয়েছে। এতে স্বতন্ত্র প্রার্থী সাইদুর আলম অপুসহ ১০ জন আহত হয়েছেন। গুরুতর আহত আবুল কালামকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। রাতে স্বতন্ত্র প্রার্থী বাদী হয়ে ১৫ জনকে আসামি করে হোমনা থানায় মামলা করেন। পুলিশ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তারা নৌকার প্রার্থীর সমর্থক বলে জানা গেছে।
স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার মনিপুর বাজারে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী সাইদুর ও নৌকা প্রতীকের প্রার্থী এ কে এম মনিরুজ্জামান মনিরের সমর্থকদের মধ্যে শুক্রবার গণসংযোগকালে সংঘর্ষ হয়। এতে উভয় পক্ষের কয়েকজন আহত হন। তাদের হোমনা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। খবর পেয়ে উভয় প্রার্থী রোগীদের দেখতে হাসপাতালে গেলে সেখানে আবার সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে দু’পক্ষ। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
সংঘর্ষ-সংঘাত অব্যাহত আছে লক্ষ্মীপুরেও। জানা যায়, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জে সহিংস ঘটনা ঘটছেই। এতে গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছেন ২০ জন। উপজেলার পূর্ব ভাদুর রাজারামপুর এলাকায় শনিবার আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহাম্মদ জাবেদের নির্বাচনী অফিস ভাঙচুর করে সন্ত্রাসীরা। এর আগে বুধবার রাতে গুলিবিদ্ধসহ আহত হন পাঁচজন। আর একই দিন রায়পুর উপজেলায় উত্তর চরবংশী এলাকায় দুই মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে আহত হন ১০ জন।
এখানকার নির্বাচনে সন্ত্রাসীরা নিজ নিজ প্রার্থীর সমর্থনে প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দিয়ে ভোটারদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্থানীয়রা বলছেন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার না হওয়ায় বেপরোয়া হয়ে উঠছে সন্ত্রাসীরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্বাচনি আচরণবিধি অনুসরণের ব্যাপারে শুরু থেকেই কড়া পদক্ষেপ নেওয়া হলে ভোটের দিন পরিস্থিতি শান্ত রাখা সহজ হতো। কিন্তু ভোটের আগে থেকেই সহিংসতা শুরু হলেও সেগুলো নিয়ন্ত্রণে তেমন কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এটা শুধু জেলা-উপজেলার বিষয় নয়, কেন্দ্রীয়ভাবে নির্বাচন কমিশন থেকে মাঠ কর্মকর্তাদের মনিটর করারও ব্যবস্থা নেই।
সূত্র জানায়, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে একেকটি উপজেলার দুই-তিনটি ইউনিয়নের জন্য একজন করে রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা না থাকায় নির্বাচনি অনিয়মের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেন না। এ কারণে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের নির্বাচনকালীন ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে নির্বাচনি কর্মকর্তারা।
আরও পড়ুন
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি