অনলাইন ডেস্ক :
সৌদি আরবের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক উন্নয়ন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথার কোনো কারণ দেখছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এ ঘটনায় মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন প্রভাব কমার আশঙ্কা থাকলেও খুব একটা লোকসানে পড়বে না যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্লেষকরা বলছেন, রিয়াদ এবং তেহরানের মধ্যে গত সপ্তাহে বেইজিংয়ে হওয়া চুক্তিটি উপসাগরীয় অঞ্চলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ। চীন এ ক্ষেত্রে দারুণ ভূমিকা রেখেছে। তেহরানের সঙ্গে বৈরিতা সত্ত্বেও চুক্তি থেকে সুবিধা নিতে পারবে ওয়াশিংটন। বোস্টন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জর্জ হেইন বলেন, ‘উত্তেজনা কমাতে তেহরান এবং রিয়াদ যে পদক্ষেপ নিয়েছে তাতে সবাই উপকৃত হবে। আসলে এটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভালো, চীনের জন্য ভালো। এটা মধ্যপ্রাচ্যের জন্য ভালো।’ চিলিতে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালনকারী হেইন বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে চুক্তিটি আসলে চীনের কূটনৈতিক জয়। তবে এর অর্থ এই নয় যে এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় ধাক্কা।’ আল জাজিরাকে তিনি বলেন, ‘ওয়াশিংটনের উচিত হবে অন্যান্য দেশের প্রতি তার দ্বন্দ্বমূলক নীতিগুলোকে পুনর্বিবেচনা করা।’ বছরের পর বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ছড়িয়ে পড়া উত্তেজনায় পানি ঢেলে দিয়েছে তেহরান-রিয়াদ সমঝোতা; বিশেষ করে ইয়েমেনে, যেখানে সৌদি-সমর্থিত সরকার এবং ইরান-মিত্র হুথি বিদ্রোহীদের দ্বন্দ্বে বড় মানবিক সংকট দেখা দিয়েছে।
চীনের ভূমিকা : চুক্তিটির সঠিক বিবরণ প্রকাশ করা হয়নি। তবে ১০ মার্চ যৌথ এক বিবৃতিতে বলা হয়, চুক্তিটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান এবং রাজ্যগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করাকে নিশ্চিত করেছে। ২০১৬ সাল থেকে স্থগিত হওয়া কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনরায় চালু এবং কয়েক দশক আগের নিরাপত্তা ও সাংস্কৃতিক চুক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করেছে তেহরান-রিয়াদ। ইরাক ও ওমানে এর আগে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে কয়েক দফা আলোচনা হয়েছিল। বেইজিংয়ে গত সপ্তাহে শীর্ষ চীনা কূটনীতিক ওয়াং ই ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল সেক্রেটারি আলী শামখানি এবং সৌদি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মুসাদ বিন মোহাম্মদ আল আইবানের সঙ্গে হাত মেলাতে উপস্থিত ছিলেন। যৌথ বিবৃতিতে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে সৌদি আরব ও ইরানকে একত্র করার ‘মহৎ উদ্যোগের’ কৃতিত্ব দেওয়া হয়েছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি গত বছরের ডিসেম্বরে সৌদি আরব সফর করেন। আবার ফেব্রুয়ারিতে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি তার সঙ্গে চীনে দেখা করেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, চুক্তিটি কার্যকর করার ক্ষেত্রে চীনা ভূমিকা নিয়ে ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারকদের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত হবে না। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ থিঙ্ক ট্যাঙ্কের সিনিয়র মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার উপদেষ্টা ডিনা এসফান্ডিয়ারি বলেন, ‘চুক্তিটি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি করবে। এটা ওয়াশিংটন নীতির উদ্দেশ্যও বটে। যুক্তরাষ্ট্র এখনও কিন্তু উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রগুলোর জন্য পছন্দের নিরাপত্তা অংশীদার।’ ইরান ও সৌদি আরব থেকে উপসাগরীয় তেলের শীর্ষস্থানীয় আমদানিকারক চীন। অন্যদিকে, মধ্যপ্রাচ্যের জ¦ালানি আমদানি থেকে অনেকটাই দূরে সরে গেছে যুক্তরাষ্ট্র। কারণ, তারা নিজেরাই জ¦ালানি উৎপাদন বাড়িয়েছে। আল জাজিরাকে এসফান্দিয়ারি বলেন, ‘এই অঞ্চলে নিজেদের অর্থনৈতিক প্রভাবের কারণে অনিবার্যভাবে চীনের গুরুত্ব বাড়ছে। চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব একসময় উপসাগরীয় অঞ্চলে ওয়াশিংটনের প্রভাব কমাতে পারে। আর সেটাই যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের কারণ হতে পারে।’
‘ভাল জিনিস’ : আপাতত, মার্কিন কর্মকর্তারা সেই সম্ভাবনা নিয়ে আতঙ্কিত হচ্ছেন না… অন্তত প্রকাশ্যে নয়। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি আরব এবং ইরানের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছে, তা আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে যেকোনও উত্তেজনা কমাতে, সংঘাত এড়াতে এবং ইরানের বিপজ্জনক বা অস্থিতিশীল পদক্ষেপগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করতে পারে।’ মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউট থিঙ্ক ট্যাঙ্কের মার্কিন কূটনীতির সিনিয়র ফেলো জেরাল্ড ফিয়েরস্টেইন বলেন, ‘ইরাক এবং ওমানে ইতোমধ্যে যে আলোচনা হয়েছে, তার উদ্ধৃতি দিয়ে চুক্তিতে চীনের জড়িত থাকার বিষয়টিকে অতিরঞ্জিত করা হতে পারে।’ ফিয়েরস্টেইন বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র চায় মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা কমে আসুক। ইরানকে কোনোভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা। এই চুক্তির ফলে তাই হওয়ার সম্ভাবনা হয়েছে। বেইজিংয়ে ত্রিমুখী হ্যান্ডশেক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতির কারণ আসলে তেহরানের সঙ্গে ওয়াশিংটনের সম্পর্ক নেই।’ ইয়েমেনে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করা সাবেক মার্কিন কূটনীতিক ফিয়েরস্টেইন আল জাজিরাকে বলেন, ‘সহজ সত্যটি হলো, যুক্তরাষ্ট্র এই ভূমিকা পালন করতে পারতো না।’
পারমাণবিক চুক্তি : যে বিষয়গুলো ওয়াশিংটনের জন্য জটিল করে তুলতে পারে তা হলো, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রচেষ্টা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে তিনি তেহরানকে পারমাণবিক অস্ত্র পেতে দেবেন না। ২০২১ সাল থেকে ওয়াশিংটন এবং তেহরানের মধ্যে পরোক্ষ আলোচনার একাধিক রাউন্ড হলেও, ২০১৫ সালের চুক্তি পুনরুদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়। তারপরও ইরান তার অর্থনীতির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিনিময়ে পারমাণবিক কর্মসূচি পিছিয়ে দিয়েছে। বাইডেন প্রশাসন এখন বলছে, জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ) নামে পরিচিত পারমাণবিক চুক্তিতে প্রত্যাবর্তন এখন আর এজেন্ডায় নেই। কারণ, ইরানের ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে চলেছে ওয়াশিংটন। সমঝোতা তেহরানকে তার অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতা থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করতে পারে। ইতোমধ্যে চুক্তিটি বাস্তবায়িত হওয়ার পর ইরানে বিনিয়োগ শুরু করার কথা বলছেন সৌদি কর্মকর্তারা। জেসিপিওএ পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা স্থগিত থাকা সত্ত্বেও মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি মোকাবিলার জন্য কূটনীতি হলো সর্বোত্তম উপায়। যদিও ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর বিরুদ্ধে সামরিক বিকল্পের কথা অস্বীকার করেনি ওয়াশিংটন। স্টেট ডিপার্টমেন্ট চলতি মাসের শুরুর দিকে জানায়, ইরান কখনই পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করবে না… বিষয়টি যেভাবেই হোক আমরা নিশ্চিত করবো।’ ফিয়েরস্টেইন বলেন, ‘এই চুক্তিটি ইরানের বিরুদ্ধে কাল্পনিক মার্কিন বা ইসরায়েলের সামরিক হামলাকে আরও কঠিন করে তুলেছে। সৌদি আরবকে উপেক্ষা করে ইরানের ওপর আক্রমণ করা এখন অনেক জটিল হবে।’ সূত্র: আল জাজিরা
আরও পড়ুন
গাজায় গত একদিনে নিহত ৫২
তীব্রতর হচ্ছে ইসরায়েলি হামলায় লেবাননে যুদ্ধ
হারিকেন হেলেনে যুক্তরাষ্ট্রে অন্তত ৯০ জনের মৃত্যু