নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেশে ইস্পাত খাতের আকার গত ১০ বছরে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। উদ্যোক্তাদের সম্প্রসারণ কার্যক্রমে বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে সরকারের মেগা প্রকল্প। ২০৪১-এর মধ্যে উন্নত দেশে পদার্পণে সরকারের যে ভিশন তাতে ভারী এ শিল্প খাতকে এগিয়ে নিতে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন উদ্যোক্তারা।
বাংলাদেশে বর্তমানে মাথাপিছু স্টিল ব্যবহারের গড় হিসাব করা হয় ৪৫ কেজি। অর্থনীতি বড় হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ করে সরকারিভাবে অবকাঠামোগত যে উন্নয়ন হচ্ছে, তাতে ধারণা করা হচ্ছে আগামী দুই বছরে এ চাহিদা বেড়ে ৭০ কেজি ছাড়িয়ে যাবে। দেশে মূলত লৌহ শিল্পের প্রবৃদ্ধি ঘটছে ১৯৯০ সালের পর থেকে। নব্বই দশকে খাতটিতে একে একে বিনিয়োগে এগিয়ে আসেন উদ্যোক্তারা। তখন রডের কাঁচামাল সহজলভ্য করে জাহাজ ভাঙার পুরনো লোহা। শুরুর তিন দশক সনাতন পদ্ধতিতে থাকলেও পণ্যে বৈচিত্র্য আর উৎপাদনে রূপান্তর ঘটিয়ে মূলত ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের ওপর ভর করে বড় হচ্ছে দেশের ইস্পাত খাত।
দেশের শীর্ষ পর্যায়ের উদ্যোক্তারা বলছেন, ইস্পাতের ভবিষ্যৎ চাহিদার কথা মাথায় রেখে আগে থেকেই বাড়িয়ে রাখা হচ্ছে উৎপাদনক্ষমতা। উৎপাদনের তালিকায় একের পর এক যুক্ত হচ্ছে নতুন ও উচ্চশক্তির বিশেষায়িত রড। এজন্য অবশ্য নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখিও হতে হচ্ছে তাদের। মহামারীতে কারখানাগুলো দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় গুনতে হয়েছে বড় অংকের লোকসান। কর্মীদের বেতন পরিশোধে এমনকি ব্যবসা চালু রাখা নিয়েই দুশ্চিন্তা তৈরি হয় উদ্যোক্তাদের। আবার কারখানা চালু রাখলেও অতিমারীতে সম্প্রতি তাদের সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে বিশ্ববাজারে মেল্টিং স্ক্র্যাপের দুষ্প্রাপ্যতা। যদিও বিপর্যয় কাটিয়ে এখন ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে দেশের ভারী এ শিল্প খাত।
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি স্টিল উৎপাদন এবং ব্যবহারকারী দেশ চীন, ভারত, আমেরিকা, জাপান ও রাশিয়া উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে অল্প সময়ে প্রচুর স্টিল উৎপাদন করে। তাদের উৎপাদন খরচও কম পড়ে। তবে বাংলাদেশের উদ্যোক্তারাও বৃহৎ আকারের ইনডাকশন ও ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস এবং অটোমেটিক রি-রোলিং মিল স্থাপনের মধ্য দিয়ে উন্নত ও বিশ্বমানের স্টিল উৎপাদনের সক্ষমতার দিকে এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।
বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএমএ) তথ্য বলছে, ইস্পাত খাতে বর্তমানে তাদের সদস্যভুক্ত কারখানা রয়েছে ৩৫টি। ১০ বছর আগেও দেশে বছরে সম্মিলিতভাবে এমএস রড উৎপাদন হতো ২৫ লাখ টন। বর্তমানে চাহিদা অনুযায়ী বছরে গড়ে উৎপাদন ও বাজারজাত হচ্ছে প্রায় ৬০ লাখ টন। যদিও উদ্যোক্তাদের কারখানা সম্প্রসারণ পদক্ষেপে ইস্পাতের (রড) সম্মিলিত উৎপাদন সক্ষমতা এখন ৯০ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। কারখানার সক্ষমতা যে গতিতে বাড়ছে তাতে আগামী দুই বছরে অর্থাৎ ২০২৩ সালে ১ কোটি টনে উন্নীত হবে। আর তখন এমএস রড উৎপাদন বছরে গড়ে ৭০ লাখ টন ছাড়াবে। গত কয়েক বছর সরকারি খাতে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন, অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা, বিদ্যুৎকেন্দ্র ছাড়াও প্রবাসী আয়ে গ্রামে পাকা ঘর নির্মাণ বৃদ্ধিই ইস্পাত খাতের প্রবৃদ্ধির মূল কারণ।
এ ব্যাপারে কেএসআরএম উপব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহান রাহাতের ভাষ্য, ‘২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের সমপর্যায়ে পৌঁছাতে ইস্পাত খাতের সঠিক বিকাশ খুবই প্রয়োজন। সরকারের মেগা প্রকল্পে ইস্পাতের ব্যবহার এখন সবচেয়ে বেশি। মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ বড় প্রকল্পগুলোতে প্রচুর ইস্পাত পণ্য দরকার হওয়ায় এসব পণ্যের প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। এ ছাড়া শিল্পাঞ্চল, বিশেষ অর্থনৈতিক জোন ও উপজেলা পর্যায়ে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে রডের চাহিদা ও জোগানের সম্ভাবনা বেশ ভালো। সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রাখতে চট্টগ্রাম বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানের নৌবন্দরগুলোকে আরো আধুনিকায়ন করা দরকার। চট্টগ্রাম থেকে খুলনা, বরিশাল, ভোলার মতো এলাকায় খুব সহজেই নৌপথে ভারী পণ্য পরিবহন বাড়ানো গেলে সড়কের ওপরও চাপ কমবে।’
দেশীয় উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি চীনা ও জাপানি উদ্যোক্তারাও দেশের ইস্পাত শিল্পে বড় আকারের বিনিয়োগ নিয়ে পরিকল্পনা করেছে। চট্টগ্রামের মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে চীনা ইস্পাত জায়ান্ট কুনমিং আয়রন অ্যান্ড স্টিল হোল্ডিং কোম্পানি বার্ষিক ২০ লাখ টন সক্ষমতার কারখানা স্থাপনে ২৩০ কোটি ডলার বিনিয়োগ পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়া জাপানের সবচেয়ে বড় ইস্পাত উৎপাদক নিপ্পন স্টিল ও সুমিতমো মেটাল স্থানীয় কোম্পানি ম্যাকডোনাল্ড স্টিল বিল্ডিং প্রোডাক্টসের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কারখানা স্থাপনে ৬ কোটি ডলার বিনিয়োগের বিষয়টিও আলোচিত হয়েছে।
বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএমএ) বর্তমান সভাপতি ও আনোয়ার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মানোয়ার হোসেন বলেন, ‘উচ্চব্যয়বহুল একটি শিল্প ইস্পাত খাত। যেখানে বিক্রি বেশি দৃশ্যমান হলেও মুনাফা কম। যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ব্যবহারের উপযুক্ত বিশ্বমানের স্টিল উৎপাদন হচ্ছে দেশে। বড় প্রকল্পগুলোতে প্রচুর ইস্পাতপণ্য দরকার হচ্ছে। আগামী ১০ বছর ইস্পাতপণ্যের এ প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। চাহিদার চেয়ে এখন উৎপাদন সক্ষমতা বেশি আছে। স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সম্মিলিত উৎপাদনক্ষমতা এখন বার্ষিক ৫৫ লাখ টন ছাড়িয়েছে। কারখানা স্থাপন কিংবা সম্প্রসারণে জ¦ালানি, রাসায়নিক ও পানি ব্যবহারের দক্ষতা বাড়াতে কাজ করছেন উদ্যোক্তারা। স্বাভাবিক সময়ে জাহাজ অপেক্ষমাণ থেকে বাড়তি ক্ষতিপূরণ গুনতে হয় উদ্যোক্তাদের। এতে খরচ বেড়ে অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়ছে। করোনার ধাক্কায় ইস্পাতপণ্যের বাজারের ধীরগতি কাটিয়ে কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধিতে ফিরবে দেশের ইস্পাত খাত।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের চেয়ারম্যান মো. সেলিম উদ্দিন বাংলাদেশের ইস্পাত শিল্প নিয়ে বেশ আশাবাদী। তিনি বলেন, নির্মাণসামগ্রীর মধ্যে ইস্পাত সবচেয়ে বড় খাত। এ খাতে বাজারের আকার ৫০ হাজার কোটি টাকার মতো হবে। সরকারি খাতে অসংখ্য বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। আগামী ১০ বছর অর্থাৎ ২০৩০ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে বাড়বে। ইস্পাতপণ্যে সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করতে হলে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের বিকল্প নেই। এজন্যই বিনিয়োগ বেশি হলেও কোম্পানিগুলো সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে এগিয়ে এসেছে। আকরিক লোহা, কয়লা, চুনাপাথর ও সামান্য পরিমাণ পুরনো লোহার টুকরো কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয় মৌলিক কারখানায়। বাংলাদেশ একটা পর্যায়ে মৌলিক ইস্পাত শিল্পের দিকে ধাবিত হবে, এটাই প্রত্যাশা।’
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ