April 25, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Friday, February 25th, 2022, 8:43 pm

ই-কমার্স ধোঁয়াশা কাটেনি, টাকা ফেরতে দোলাচল

প্রতীকী ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

যুগের পরিবর্তনের সাথে বাণিজ্য ক্ষেত্রেও এসেছে নতুন পরিবর্তন। ই-কমার্স বাণিজ্য বিশ্বব্যাপী লাভ করছে তুমুল জনপ্রিয়তা। এই ই-কমার্স বাণিজ্যের প্রসারতা অনেক ক্ষুদ্র পুঁজির ব্যাবসায়ী বা সৃজনশীল উদ্যোক্তাদের জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। একইসাথে এটিকে অনেকে ব্যবহার করছে প্রতারণার ফাঁদ হিসেবে। আমাদের দেশে ই-কমার্সকে ঘিরে প্রতারক চক্রের সংখ্যাই বেশি। এদের ফাঁদে পড়ে অনেক নিরীহ ক্রেতা হারিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। সেই টাকা অনেকেই ফিরে পাননি আজও।
প্রতারণার ফাঁদ হিসেবে ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা শপের মতো দেশের বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকদের দিয়েছিল আকর্ষনীয় অফার। এসব অফারে প্রলুব্ধ হয়ে পণ্য কিনতে প্রতিষ্ঠানগুলোতে আগাম টাকা দিয়েছিলেন অনেকেই। সেই পাওনা টাকা ফেরতের কোনো দিশা এখনও মিলছে না। ধারণা করা হচ্ছে, প্রায় ৫০টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে কয়েক লাখ গ্রাহকের হাজার হাজার কোটি টাকা আটকে গেছে। গ্রাহকের টাকা এসব প্রতিষ্ঠান থেকে কবে নাগাদ তাদের পকেটে ফিরবে, সেই নিশ্চয়তা দিতে পারছে না কেউই।
সূত্র জানায়, বর্তমান পেমেন্ট গেটওয়েগুলোয় গ্রাহকদের প্রায় ২১৪ কোটি টাকা আটকে আছে। ইভ্যালি কা-ের পর গত বছরের পহেলা জুলাই থেকে সব লেনদেন পেমেন্ট গেটওয়ের মাধ্যমে করার নিয়ম বেঁধে দেয় সরকার। এর ফলে যারা কোন পণ্য কিনেছেন, সেই টাকা পেমেন্ট গেটওয়েতে গিয়ে জমা হয়েছে। পণ্য সরবরাহ করার পর ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান মূল্য পাবে। তবে ব্যাপক সমালোচনার মুখে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস নাগাদ ইভ্যালিসহ অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। সেসব প্রতিষ্ঠানের অর্থ এই পেমেন্ট গেটওয়েতে জমা রয়েছে।
জানা যায়, গত বছরের ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝিতে পেমেন্ট গেটওয়েগুলোয় আটকে থাকা ২১৪ কোটি টাকা গ্রাহকদের হিসাবে ফেরত দিতে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য চিঠি পাঠিয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সেই চিঠিতে বলা হয়, যেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোন মামলা চলমান নেই, সেসব প্রতিষ্ঠানের নামে এসক্রো সার্ভিসে ভোক্তাদের আটকে থাকা অর্থ ফেরত দেয়া হবে। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পেমেন্ট গেটওয়েগুলোকে অর্থ ছাড়ের নির্দেশ দিয়ে চিঠি পাঠানো হয়।
কিন্তু এসক্রো সার্ভিস ব্যবস্থা চালুর আগে প্রায় ৫০টি ই-কমার্স কোম্পানি অতিরিক্ত ছাড়ের টোপ ফেলে বিপুলসংখ্যক মানুষের কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা আগাম নিয়েছে। পরে পণ্য সময়মতো সরবরাহ করেনি। এমনকি প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাংক হিসাবে গ্রাহকদের পরিশোধ করা টাকাও নেই। বিশেষ কোনো সম্পদেরও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর লেনদেন, সম্পদ, ব্যাংক হিসাবে জমা টাকা ইত্যাদি নিয়ে প্রায় এক বছর ধরে কাজ করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এসব সংস্থার কর্মকর্তারা মনে করছেন, ওইসব প্রতিষ্ঠানের মালিকরা ক্রেতাদের থেকে নেওয়া টাকার একটি অংশ পাচার করেছেন কিংবা অন্য কোনো খাতে সরিয়েছেন। আর বিশাল অঙ্কের টাকা পণ্য কেনায় লোকসান ও পরিচালন কাজে খরচ হয়েছে। ফলে লাখ লাখ প্রতারিত ই-কমার্স গ্রাহকের টাকা ফেরতের বিষয়টি এখন অনিশ্চিত। অন্যদিকে কোম্পানিগুলোর দেনা কত সে ব্যাপারে সরকারের কাছে কোনো সুস্পষ্ট তথ্য নেই। এ কারণে টাকা উদ্ধার আরও চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়েছে। এদিকে এস্ট্ক্রো সার্ভিস চালুর পরে পেমেন্ট গেটওয়ে কোম্পানিগুলোর ২১৪ কোটি টাকা আটকে আছে। এই টাকা ফেরত দেওয়ার চেষ্টা চলছে। ইতোমধ্যে কিউকম ও আলেশা মার্টের কিছু গ্রাহকের টাকা ফেরত দেওয়া শুরু হয়েছে।
এ ব্যাপারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ই-কমার্স সেলের প্রধান অতিরিক্ত সচিব এএইচএম সফিকুজ্জামানের ভাষ্য, এস্ট্ক্রো সার্ভিস চালুর পরে যেসব গ্রাহকের টাকা আটকে গেছে সেগুলো ফেরত দেওয়ার চেষ্টা চলছে। কিউকমের গ্রাহকদের ৫৯ কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। সেগুলো দেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে ২৫ কোটি টাকার বেশি ফেরত দেওয়া হয়েছে। আলেশা মার্টের কাছে আটকে থাকা ৪২ কোটি টাকা দেওয়া শুরু হয়েছে। আশা করা যায়, পেমেন্ট গেটওয়ে কোম্পানিতে যে টাকা আটকে আছে সেগুলো দেওয়া যাবে।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, প্রতারক ৩০টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ক্রেতাদের কাছ থেকে ২১ হাজার ৩০ কোটি ৫১ লাখ টাকা নিয়েছে। এসব কোম্পানির অ্যাকাউন্টে সর্বশেষ স্থিতি ছিল মাত্র ৩৮৮ কোটি টাকা, যা মোট জমার মাত্র ১.৮৪ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানগুলোর অ্যাকাউন্টে ক্রেতারা যত টাকা জমা করেছেন তার প্রায় পুরোটাই তুলে নেওয়া হয়েছে। উত্তোলন করা টাকার কত অংশ কোম্পানিগুলো গ্রাহকদের পণ্য সরবরাহে কোম্পানি পরিচালনায় ব্যয় করেছে সে বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায়নি। পণ্য কেনা ও পরিচালন ব্যয়ের বাইরে বাকি টাকা কোথায় গেছে সে বিষয়েও কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
এই অবস্থায় কীভাবে গ্রাহকরা টাকা ফেরত পাবে তা নিয়ে বিরাজ করছে ধোঁয়াশা। গ্রাহকরাও নিরাশ হয়ে পড়ছেন। প্রতারক শিরোমণি ই-ভ্যালীর অবস্থা সবচেয়ে বেশি করুণ। গত সেপ্টেম্বরে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেল নিজেই ক্রেতা ও মার্চেন্টদের কাছে ৫৪২ কোটি টাকা দেনা থাকার কথা লিখিতভাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছিলেন। গ্রেপ্তারের পর পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এক হাজার ১০০ কোটি টাকার কথা জানান তিনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ইভ্যালির ১৩টি ব্যাংক হিসাবে ক্রেতারা ৭ হাজার ১৭৭ কোটি টাকা জমা করেছেন। ইভ্যালি তুলে নিয়েছে ৭ হাজার ১৩০ কোটি টাকা। বর্তমানে আদালত গঠিত পরিচালনা পর্ষদ ইভ্যালি পরিচালনা করছে। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির লকার ভেঙে কয়েকশ ব্যাংক চেক ও মাত্র ২ হাজার ৫৩০ টাকা পেয়েছে পরিচালনা কমিটি। অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করার আগেই গ্রাহকের জমা দেওয়া সব টাকা তুলে নিয়েছে আদিয়ান মার্ট, র‌্যাপিড ক্যাশ, ২৪টিকেটি, নিডস ডটকম ও নিরাপদ-এর মতো ছোট কোম্পানিগুলোও।
গ্রাহকদের ন্যায্য টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য লুট হওয়া টাকা আসলে কোথায় গচ্ছিত আছে তা খুঁজে বের করতে হবে বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের। তাঁদের মতে, টাকার হদিস না পেলে যতোই কথা বলা হোক না কেন গ্রাহকরা তাঁদের টাকা ফেরত পাবেন না। এগুলো কেবল সান্ত¡নাবাণী হিসেবেই থেকে যাবে।