নিজস্ব প্রতিবেদক:
টাকা ফেরত পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা এখনো না জাগায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন মাল্টি লেভেল মার্কেটিং(এমএলএম) কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ করে প্রতারিত কোটি মানুষ। মূলত নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষই এমএলএম কোম্পানিগুলোর প্রতারণার স্বীকার বেশি হচ্ছেন বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।
মুনাফার আশায় তিলে তিলে জমানো সম্পদ এসব কোম্পানিতে জমা দিয়েছেন তারা। অনেক শিক্ষিত বেকার যুবকও চাকরি না পেয়ে সহায় সম্বল বিক্রি করে এসব প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে আত্মকর্মসংস্থানের পথ খুঁজেছেন। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম এখন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সঞ্চয় হারিয়ে নি:স্ব অনেক বিনিয়োগকারী। টাকা ফেরত পাওয়ারও কোনো নিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছে না। এমন অবস্থায় চরম হতাশা বিরাজ করছে বিনিয়োগকারীদের মাঝে।
সূত্র জানায়, মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কম্পানির (এমএলএম) নামে প্রতারণার অভিযোগে সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। শনিবার রাতে সাভারের আমিনবাজার এলাকা থেকে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। ওই চক্র প্রায় পাঁচ লাখ ব্যক্তির কাছ থেকে ৫০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে বলে জানিয়েছে সিআইডি। প্রতারণার শিকার বেশির ভাগই নারী।
গ্রেপ্তার সাত ব্যক্তি হলেন মো. আবুল হোসেন পুলক (৪০), মো. মাহাদী হাসান মল্লিক (৩৫), মো. মিজানুর রহমান ওরফে ব্রাভো মিজান (৫৫), মো. মহিউদ্দিন জামিল (৩৮), মো. সাইফুল ইসলাম আকন্দ (৪২), মো. কভেজ আলী সরকার (৩৫) ও মো. শাহানুর আলম শাহীন (৪২)। তবে তাঁদের ঠিকানা জানানো হয়নি।
গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের কাছ থেকে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ৯টি মোবাইল ফোন, ২০টি সিম কার্ড, একাধিক ব্যাংক হিসাবের চেকবই, একাধিক ব্যাংকের এটিএম কার্ড, ভুয়া এমএলএম কম্পানির পরিকল্পনার কাগজপত্র এবং নগদ ৬২ হাজার টাকা জব্দ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে রোববার রাজধানীর মালিবাগে সিআইডির প্রধান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে সিআইডির ঢাকা মহানগরের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক জানান, চক্রটির চারটি অনলাইন কোম্পানি আছে। এই চারটি কোম্পানির মাধ্যমে গত এক বছরে প্রায় পাঁচ লাখ লোকের কাছ থেকে তারা অন্তত ৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। চক্রটি মোবাইল অ্যাপস ও ডিজিটাল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস ব্যবহার করে অবৈধভাবে এমএলএম ব্যবসা করে আসছিল। মানুষকে অধিক লাভের প্রলোভন দেখিয়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, বিকাশ ও নগদের মতো ডিজিটাল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস ব্যবহার করে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়।
অনেক ভুক্তভোগী সিআইডিতে অভিযোগ করেছেন। সিআইডি দীর্ঘদিন বিষয়টি মনিটর করে চক্রের মূলহোতা মো. মাহাদী হাসান মল্লিক, মিজানুর রহমান ওরফে ব্রাভো মিজান ও মো. আবুল হোসেন পুলকসহ সাতজনকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি।
গ্রেপ্তারকৃত অন্য আসামিরা হলেন, মো. মহিউদ্দিন জামিল (৩৮), মো. সাইফুল ইসলাম আকন্দ (৪২), মো. কভেজ আলী সরকার (৩৫) ও মো. শাহানুর আলম শাহীন (৪২)।
কিছু দিন আগেও গ্রেফতারকৃতদের ৫-৬ জন কক্সবাজারের বিলাসবহুল একটি হোটেলে প্রোগ্রাম করে সাধারণ মানুষকে বিনিয়োগে প্রলুব্ধ করে বলে জানান সিআইডির কর্মকর্তারা।
নির্দিষ্ট টাকার অঙ্ক নিয়ে একটি আইডি নম্বর দিতো তারা। বলা হতো ওই আইডি নম্বরে বিনিয়োগ করলে দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক ও বাৎসরিক মুনাফা মিলবে। ওই বিনিয়োগকারীদের হাত ধরে নতুন কেউ এলে মুনাফাও বাড়তে থাকবে। এভাবে চেইন মুনাফার লোভ দেখিয়ে অবৈধ এমএলএম ব্যবসা চালিয়ে আসছিল তারা।
চক্রের অনেকেই আগে ডেসটিনিতে কাজ করতো বলে জানিয়েছে সিআইডি। এ ছাড়া এদের অনেকে অবৈধ পন্থায় ম্যানপাওয়ার ব্যবসাতেও জড়িত বলে জানা গেছে।
ঠিক একইভাবে, ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মকে অনেকেই প্রতারণার বড় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আসছিলেন। এসব প্রতিষ্ঠানের আড়ালে অর্থ আত্মসাৎ ও প্রতারণা করে গ্রাহক ও মার্চেন্টদের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জ, ইভ্যালির বিরুদ্ধে অভিযানের ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি একের পর এক অভিযান পরিচালিত হয়েছে ইতোমধ্যে। কৌশলে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে অনেকে কারাগারে রয়েছেন। আবার অনেকে গ্রেপ্তার এড়াতে গা-ঢাকা দিয়েছেন। শক্ত নজরদারি ছাড়াই একটি দুর্বল কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে ই-কমার্সভিত্তিক অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছিল- এটা এখন স্পষ্ট। অফারের ফাঁদ আর লোভে পড়ে লাখ লাখ মানুষ টাকা খুইয়েছেন।
এ পরিস্থিতিতে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর সার্বিক চিত্র ও ১৯ দফা করণীয় উল্লেখ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। এতে বলা হয়েছে, ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মকে মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) ব্যবসা পরিচালনার জন্য ব্যবহার করা যাবে না। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণে একটি টাস্কফোর্স গঠনের কথা বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা-২০২১’ নামে নীতিমালা কার্যকর থাকলেও সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। এ ক্ষেত্রে ‘ডিজিটাল ই-কমার্স অ্যাক্ট’ প্রণয়ন করা প্রয়োজন। ক্রেতা পণ্য বুঝে পাওয়ার পরই মূল্য পরিশোধ করবেন- এটা নিশ্চিত করা জরুরি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে গ্রাহক ও মার্চেন্টদের অভিযোগের সংখ্যা বাড়ছে। শুধু ভোক্তা অধিদপ্তরের কাছে ২০ হাজারের বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে। আবার অভিযোগের অধিকাংশ রাজধানীকেন্দ্রিক।
মূলত ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে প্রায় ১১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে করা মামলার পর ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার বিষয় বড় আকারে প্রকাশ্যে আসে। গত ১৭ আগস্ট ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে মামলা হয়। এরপর গা-ঢাকা দেন প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম কর্ণধার পুলিশ পরিদর্শক সোহেল রানা। পরে তিনি ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন। এরপর ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. রাসেল এবং তার স্ত্রী প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনকে ১৬ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার করে র্যাব। এরই ধারাবাহিকতায় নিরাপদ ডটকম, ধামাকা শপিং, সিরাজগঞ্জ শপ, এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস লিমিটেডসহ আরও বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা ও মালিকদের গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
জানা যায়, ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কাছে যেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়েছে সেগুলো হলো- মনোহর, দালাল প্লাস, কিউকম, পিকাবু, পাবজি, আলাদীনের প্রদীপ, মীনা ক্লিক, বাবুই, ব্যাকপ্যাক, আলি টু বিডি, সেলমার্ট, গ্যাজেট মার্ট, বিডিটিকেটস, সাবু শপ, আমারি, শপআপ, সিরাজগঞ্জশপ, কমপ্লেক্স ডটকম, রাজারহাট, বিডিশপ, চাহিদা ইশপ, আনন্দের বাজার, বুমবুম, ইভ্যালি, দারাজ, সহজ, আজকের ডিল, ফুডপান্ডা, চালডাল, প্রিয়শপ, ফাল্কগ্দুনী, অথবা উবার, পাঠাও, বিক্রয়, নিরাপদ, ই-অরেঞ্জ, রকমারি, ধামাকা শপিং, আদিয়ান মার্ট ও আলেশা মার্ট।
এ বিষয়ে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) জেনারেল ম্যানেজার জাহাঙ্গির আলমের ভাষ্য, উন্নত দেশে ই-কমার্স খাতে নজরদারি ও স্বচ্ছ প্রতিযোগিতা পর্যবেক্ষণের জন্য ফেয়ার ট্রেড কমিশন থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে এ ধরনের কোনো কমিশন নেই। আমাদের প্রতিযোগিতা কমিশন রয়েছে। কিন্তু এটির ক্ষেত্র সীমিত। তা ছাড়া সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যেও সমন্বয়হীনতা রয়েছে।
এর জন্য ডিজিটাল কমার্স নীতিমালায় ‘রিস্ক ফ্যাক্টর ম্যানেজমেন্ট কমিটি’র বিষয়টি ই-ক্যাবের পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু এতদিনেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। এ কমিটি থাকলে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নজর রাখা সহজতর হবে। তা ছাড়া ই-ক্যাবের কাছে কোন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান কত টাকা লেনদেন করছে সে বিষয়ে কোনো তথ্য থাকে না। তথ্য থাকলে সন্দেহজনক প্রতিষ্ঠানগুলোর আগে থেকে চিহ্নিত করা যেত। অপরদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোকে তার সম্পদের ওপর ভিত্তি করে কত টাকা বাকি রেখে লেনদেন করতে পারবে তা বেঁধে দিতে পারে।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি