নিজস্ব প্রতিবেদক:
ঈদ উদযাপন করতে যে যেভাবে পারছেন ছুটছেন বাড়ির পানে। এ কারণে মহাসড়কে সৃষ্টি হয়েছে যানজট। যানজটে স্থবির হয়ে পড়ে ঢাকা থেকে বেরোনো সড়ক-মহাসড়কগুলো। এর সঙ্গে যাত্রীদের ভুগতে হচ্ছে অবর্ণনীয় কষ্টে। তবুও ভোগান্তিকে সঙ্গী করে লাখো মানুষ ছুটছেন বাড়ির পানে। শুক্রবার (৮ জুলাই) ভোর থেকে দেখা গেছে উত্তরবঙ্গগামী নবীনগর থেকে চন্দ্রা সড়কের ১৮ কিমি জটলা। দেখা যায়, সাভারের সড়কে রয়েছে অতিরিক্ত যাত্রীর চাপ। তবে সংকট রয়েছে গণপরিবহনের। গত বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। নবীনগর-চন্দ্রা সড়কের নবীনগর থেকে চন্দ্রা পর্যন্ত পুরো পথেই গাড়ি থমকে রয়েছে। পাঁচ মিনিটের পথ পাড়ি দিতে সময় লাগছে কয়েক ঘণ্টা। চারশ টাকার ভাড়ার পরিবর্তে নেওয়া হচ্ছে ১৮০০ টাকা। তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ট্রাকে কিংবা বাসের ছাদে করে গন্তব্যে ছুটছেন অনেকে। দিনমজুর জহির মিয়া বলেন, বউ বচ্চা নিয়া যামু রংপুর। আইছি সকালে। গাড়ি পাইতাছি না। টিকিট কাটবার গেছি ভাড়া হুইনা বাড়ি না যাওয়ার চিন্তা করতাছি। দিনমজুরের কাম কইরা যে টেহা পাই তা দিয়া সংসারই চলে না। এত ভাড়া দিয়া যামু কেমনে কিছুই বুঝতাছি না। আবুল কাশেম বলেন, দোকানে কাজ করি। ছুটি দিয়েছে রাত ১২টায়। বাসা থেকে বের হয়েছি রাত ১টায়। এখনও কোনো গাড়ি পাচ্ছি না। এদিকে, আব্দুল্লাহপুর-বাইপাইল সড়কেও একই চিত্র। টঙ্গী-আশুলিয়া-ইপিজেড সড়কে বাইপাইল থেকে আশুলিয়া বাজার পর্যন্ত ১৬ কিমি থেমে থেমে যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। তবে ঢাকা-আরিচা মহাড়কে রয়েছে কিছুটা স্বস্তি। নবীনগর ও নয়ারহাটসহ কয়েকটি পয়েন্ট ছাড়া বাকি পথ যানজট মুক্ত রয়েছে। মোহনা পরিবহনের চালক সুলতান মিয়া বলেন, আশুলিয়া থেকে বাইপাইল আসতে সময় লেগেছে পাঁচ ঘণ্টা। যা আমরা ৪০-৪৫ মিনিটেই আসতে পারি। তার অভিযোগ অন্যান্য বারের চেয়ে এবার মহসড়কে পুলিশের ভূমিকাও কম। তাই তীব্র যানজট পোহাতে হচ্ছে। এ বিষয়ে সাভার হাইওয়ে থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আতিকুর রহমান বলেন, সড়কে যাত্রীবাহি বাস ও গরুবাহী ট্রাকের চাপ অনেক বেশি। চেষ্টা করছি যানজট নিরসনের। প্রত্যেক স্থানে হাইওয়ের পাশাপাশি ট্রাফিক পুলিশ রয়েছে।
এদিকে সড়ক দুর্ঘটনা, টোল আদায়ে ধীরগতি ও ঈদকে কেন্দ্র করে রাত থেকে অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ বেড়ে যায় ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধুসেতু মহাসড়কে। ফলে মহাসড়কের ২৩ কিলোমিটার এলাকায় থেমে থেমে যানজটের সৃষ্টি হয়। শুক্রবার (৮ জুলাই) ভোর থেকে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্বপাড় থেকে সদর উপজেলার আশেকপুর বাইপাস পর্যন্ত এ যানজটের সৃষ্টি হয়। এতে ঘরমুখো মানুষ বিশেষ করে নারী ও শিশুরা বিপাকে পড়েন। ভ্যাপসা গরমে অতিষ্ঠ তারা। এলেঙ্গা এলাকায় আটকে থাকা উত্তরবঙ্গগামী বাসচালক জুয়েল মিয়া বলেন, সড়কে প্রচুর গাড়ি। পাঁচ কিলোমিটার পার হতে এক ঘণ্টা সময় লেগেছে। রিনা বেগম নামের এক নারী যাত্রী বলেন, পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে রংপুর যাচ্ছি। জ্যামে এক বছরের ছেলের খুব কষ্ট হচ্ছে। তা দেখে আমারও খুব খারাপ লাগছে। ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বঙ্গবন্ধুসেতু পূর্ব থানার ওসি শফিকুল ইসলাম বলেন, সেতুর পশ্চিম পাশে ১৭ নম্বর পিলারের কাছে বাস-পিকআপের সংঘর্ষে একজন নিহত হয়েছেন। এতে এক ঘণ্টা ৪০ মিনিট টোল আদায় বন্ধ রাখে সেতু কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ রয়েছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যান চালাচল স্বাভাবিক হবে।
এদিকে ঢাকা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পেরিয়েছে সড়কের যানজট। এতে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে উত্তরের ঘরমুখো যাত্রীদের। দেখা যায়, গত বৃহস্পতিবার রাত ১টায় কল্যাণপুর থেকে বাসে উঠে ৯ ঘণ্টা ধরে সকাল ১০টায় বঙ্গবন্ধু সেতু পার হতে পেরেছে। যদিও বাসের শিডিউল বিপর্যয়ে ১১টার বাস ছাড়ে দুই ঘণ্টা পরে। এই পুরো পথে থেমে থেমে চলেছে বাস। যেখানে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে লেগেছে দ্বিগুণ সময়। রাতের যানজট দুপুর নাগাদও শেষ হয়নি। লাবলু নামে এক যাত্রী সকাল ৮টায় জানিয়েছেন, শ্যামলী থেকে গাবতলী পার হতে তার সময় লেগেছে সাড়ে তিন ঘণ্টা। বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত যাত্রীদের যাত্রাপথের পুরোটাই ছিল অসহনীয় কষ্ট আর ভোগান্তির। সড়কে দেখা গেছে বাস, প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাসের পাশাপাশি মোটরসাইকেল, গরুবাহী ফিরতি ট্রাক, পিকআপ ভ্যানে করে মানুষ ফিরছেন। কোথাও কোথাও যানবাহন বিকল হওয়ায় সড়কে বাধা তৈরি হয়। সকাল ৯টার দিকে বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর ঢাকা যাওয়ার পথে যানবাহন থেমে থাকতে দেখা যায়। টাঙ্গাইল অংশে কয়েকটি ট্রেনও থেমে থাকতে দেখা গেছে, ট্রেনগুলোর ছাদেও ছিল যাত্রী বোঝাই। এদিকে সকালের রোদে খোলা ট্রাকের নারী-পুরুষের মধ্যে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এ ছাড়া সড়কের পাশে বেশ কয়েকজনকে অসুস্থ হয়ে পড়তে দেখা যায়।
অন্যদিকে ঈদকে কেন্দ্র করে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জ অংশে যানবাহনের তুলনায় ঘরমুখো যাত্রীদের চাপ বেশি। তবে মিলছে না বাসের টিকিট। মহাসড়কে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থেকেও বাস মিলছে না সহজে। ফলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ট্রাক-পিকআপে বাড়ি যাচ্ছেন অনেকে। কেউ কেউ যাত্রীবাহী বাসের ছাদেও বাড়ি যাচ্ছেন। শুক্রবার (৮ জুলাই) সকালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শিমরাইল মোড়ে গিয়ে এমন চিত্র দেখা গেছে। গত কয়েকদিনের তুলনায় যানবাহনের চাপ বেড়েছে। কিন্তু যানবাহনের তুলনায় যাত্রী বেশি দেখা যাচ্ছে। টিকিট কাউন্টারগুলোতেও দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থেকেও মিলছে না। তবে যাত্রীর চাপ বাড়লেও মহাসড়কে নেই কোনো যানজট। বিল্লাল হোসেন নামের একজন গার্মেন্টসকর্মীর বলেন, সারাবছর তো ঢাকাতেই কাটাই। এবার কোরবানির ঈদটা গ্রামে পরিবারের লগে করমু বইলা যাইতাছি। ছুটি মাত্র চারদিন। তাই আবার তাড়াতাড়ি ফিইরা আসতে হইবো। শিল্পী বেগম নামে এক যাত্রী বলেন, ঈদের সময় গ্রামের বাড়ি একা গেলে ভোগান্তিও কষ্ট মনে হয় না। কিন্তু ছোট বাচ্চাদের নিয়ে রাস্তায় বের হলে বোঝা যায় কী পরিমাণ ভোগান্তি পোহাতে হয়। আব্দুর রহিম নামে এক যাত্রী বলেন, দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থেকে কুমিল্লার বাস পাচ্ছি না। তাই বাধ্য হয়ে পিকআপে করে কুমিল্লায় যাচ্ছি। কাচঁপুর হাইওয়ে থানার ওসি মো. নবীর হোসেন বলেন, ঈদযাত্রা নির্বিঘœ করতে ৩৫টি টিম কাজ করছে। প্রতিটি পয়েন্টে পর্যাপ্ত পুলিশ ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে। পুলিশের পাশাপাশি হোন্ডা পার্টি, মোবাইল টিম ও সাদা পোশাকে পুলিশ থাকছে। আশা করছি এবারের ঈদযাত্রা সবার ভালো হবে।
এছাড়া ঈদুল আজহার ছুটির প্রথম দিন শুক্রবার (৮ জুলাই) সকাল থেকে ঘরমুখো যাত্রীদের চাপ বাড়ে ঢাকা ময়মনসিংহ ও ঢাকা টাঙ্গাইল মহাসড়কে। একই সঙ্গে মহাসড়ক দুটিতে যানবাহনের চাপও ধীরে ধীরে বাড়ে। বিশেষ করে গাজীপুরের টঙ্গী থেকে চন্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার সড়কের বিভিন্ন অংশে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া চন্দনা চৌরাস্তা থেকে কালিয়াকৈরের চন্দ্রমোড় পর্যন্ত সড়কের বিভিন্ন জায়গায় রাত থেকে থাকা যানজট শুক্রবার (৮ জুলাই) প্রায় দুপুর পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর যেসব যাত্রী গাজীপুর থেকে টাঙ্গাইলের উদ্দেশ্যে গিয়েছিলেন তাদের ১৫ কিলোমিটার পথ পার হতেই চার থেকে ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লেগেছে বলে জানিয়েছেন কয়েকজন যাত্রী। ওই মহাসড়কের কোনাবাড়ী মৌচাক শফিপুর পল্লী বিদ্যুৎ অংশে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। ওই সড়কগুলোতে কোনাবাড়ী পর্যন্ত গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ এবং মৌচাক থেকে চন্দ্র পর্যন্ত গাজীপুর জেলা পুলিশ যানজট নিরসনে কাজ করে যাচ্ছে। গাজীপুর জেলার পুলিশ সুপার এস এম শফিউল্লাহ বলেন, ঈদে যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য জেলা পুলিশের সদস্যরা দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। বিশেষ করে মহাসড়ককে যানজট মুক্ত রাখতে চন্দ্রা এলাকায় বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। যাত্রী এবং যানবাহনের সংখ্যা সড়কে বেশি থাকায় যানজট নিরসনে পুলিশকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার ট্রাফিক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, টঙ্গী থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত এবং চৌরাস্তা থেকে কোনাবাড়ী পর্যন্ত মহাসড়কে যানজটের জন্য ট্রাফিক পুলিশ এবং থানা পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। শুক্রবার (৮ জুলাই) সকাল থেকেই মহাসড়কে যাত্রী এবং পরিবহনের বেশ চাপ রয়েছে। যাত্রীদের নির্বিঘেœ গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য পুলিশ সবরকম চেষ্টা করে যাচ্ছে। এদিকে টঙ্গী ব্রিজ থেকে চন্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার সড়কে বিআরটি প্রকল্পের কাজ চলমান থাকায় মহাসড়কের মাঝখানের দুটি লেন বন্ধ রয়েছে। যার কারণে মহাসড়কে পূর্ব এবং পশ্চিম পাশের দুটি সিঙ্গেল লেন দিয়ে বিপুলসংখ্যক যানবাহন চলাচল করতে হচ্ছে। ফলে মহাসড়কে যানবাহনের সারি বেশ দীর্ঘ হচ্ছে। এ কারণে গত বৃহস্পতিবার দুপুর পর থেকেই শুক্রবার (৮ জুলাই) সকাল পর্যন্ত ওই মহাসড়কে তীব্র যানজট আছে।
এদিকে মহাসড়কের পাশাপাশি ট্রেনে ও যাত্রীদের প্রচন্ড চাপ রয়েছে। শুক্রবার (৮ জুলাই) সকালে বিপুল সংখ্যক যাত্রীকে জয়দেবপুর জংশনে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাওয়ার জন্য ট্রেনের অপেক্ষায় বসে থাকতে দেখা গেছে। ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া ট্রেনর ভেতরে যাত্রীদের পা ফেলার জায়গা নেই। অনেকেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ট্রেনের ইঞ্জিন এবং ট্রেনের ছাদে উঠে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন। জয়দেবপুর স্টেশনের স্টেশন মাস্টার রেজাউল ইসলাম বলেন, যাত্রীদের ছাদে না উঠতে মাইকিং করা হচ্ছে। এরপরও সব বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে যাত্রীরা ছাদে ঝুঁকিপূর্ণভাবে ভ্রমণ করছে। যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড় সামলাতে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের হিমশিম খেতে হচ্ছে।
আরও পড়ুন
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি