নিজস্ব প্রতিবেদক:
বাংলাদেশে অবকাঠামগত উন্নয়নে ইতোমধ্যে অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছে। বর্তমানে অবকাঠামো থেকে শুরু করে আরও নানা উন্নয়নমূলক প্রকল্প চালু আছে, এবং কিছু প্রকল্প চালু হওয়ার প্রক্রিয়াধীন। এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ যে অবকাঠামোগতভাবে এবং অর্থনৈতিকভাবে বেশ এগিয়ে যাবে সে কথা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। তবে এসব প্রকল্পে বেশ অনিয়মের চিত্র ফুটে উঠেছে যা খুবই দুঃখজনক। অধিকাংশ প্রকল্পে ‘খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি’ প্রবাদের মতোই প্রকল্প বাস্তবায়নের চেয়ে পরামর্শকদের প্রচুর টাকা দিতে হচ্ছে বলে জানা যায়। অভিযোগ উঠেছে যে, দেশি-বিদেশী অর্থায়নে এসব প্রকল্পে বিপুল পরিমাণ টাকা ঢুকছে বিদেশী পরামর্শকদের পকেটে।
সূত্র জানায়, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ের ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পে পরামর্শক খাতে ব্যয়ের ২৫ কোটি টাকা প্রস্তাব করেছে। এভাবেই অসংখ্য প্রকল্পে পরামর্শকদের পেছনে খরচ হচ্ছে বিপুল পরিমাণ টাকা। ফলে প্রকল্প কাজ প্রকল্পের কাজ যেমন-তেমন চলুক না কেন, ফুলে ফেঁপে উঠছে তাঁদের পকেট।
ভাঙ্গা ইটের রাস্তায় গরুর গাড়ি চলার মতো উন্নয়ন প্রকল্পের ধীরতায় সন্তুষ্ট নন খোদ প্রধানমন্ত্রী। তিনি এজন্য বেশ বিরক্ত প্রকাশ করেছেন। প্রকল্প বাস্তবায়ন দ্রুত করতে গতি বৃদ্ধির নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। সম্প্রতি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় এই নির্দেশ দেন তিনি।
প্রকল্প যতো দীর্ঘস্থায়ী হবে ব্যয় ততো বৃদ্ধি পাবে এবং জনদুর্ভোগ বাড়বে সেটির প্রতিও ইঙ্গিত দেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর এই কথার কথার প্রতিফলন পাওয়া যাচ্ছে বিশেষজ্ঞদের কথাতেও। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের অভিমত, উন্নয়ন প্রকল্পে প্রতিস্থাপক পরামর্শক নিয়োগ-সংক্রান্ত আন্ত:মন্ত্রণালয় কমিটি থাকলেও এ কমিটি কাজ করছে না। সে কারণে উন্নয়ন প্রকল্পে প্রতিস্থাপক পরামর্শক নিয়োগ খাতে সরকারের ব্যয় দিন দিন বাড়ছে। আসলে পৃথিবীর অনেক দেশের চেয়ে আমাদের দেশে উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় বেশি। এসব প্রকল্পে সরকারের পাশাপাশি জনগণের উপর ঋণের বোঝা বাড়ছে। তবে এসব প্রকল্পে কত টাকা ব্যয় হচ্ছে এবং পরামর্শক নিয়োগে ব্যয় হচ্ছে তা জনগণকে জানানো প্রয়োজন। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার আওতায় আনার দররকার। জবাবদিহিতা না থাকায় এসব হচ্ছে।
বাংলাদেশে একটি বড় সংকট এই যে এদেশে এখনো শক্তিশালী পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেনি। এই ঘাটতির কারণে বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ লুট করে নিয়ে যাচ্ছে বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলো। দরকার থাক না থাক দেখা যায় প্রকল্প পরামর্শকদের দ্বারস্ত হওয়া হচ্ছে। এর পেছনে হিসেবে অবশ্য অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে বিদেশী ঋণ। বিদেশী ঋণে যেসব প্রকল্পের কাজ চলছে ঋণদানকারী দেশগুলো তাঁদের পরামর্শক নিয়োগ দিতে বাধ্য করছে। এভাবে পরামর্শক সেবার নামে ঋণের বড় অঙ্কের অর্থ বিদেশিদের কাছে ফিরে যাচ্ছে। এতে দেশের জনগণ ঋণ গ্রহণের ফলভোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং তাদের ওপর ঋণের বোঝা বাড়ছে।
জানা যায়, দেশের সিংহভাগ প্রকল্পই এই বিদেশী প্রকল্প পরামর্শক নিয়োগ দিয়ে থাকে, কিংবা দিতে বাধ্য হয়। ২০২০ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন পাওয়া বিদেশি ঋণ ও অনুদানের নতুন এবং সংশোধিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে ২২টির তথ্য বিশ্লেষণ করে পরামর্শক সেবার এমন চিত্র পাওয়া গেছে। ২২টির মধ্যে ২১টি প্রকল্পেই পরামর্শক খাত রাখা হয়েছে। ২১ প্রকল্পের পরামর্শক খাতে খরচ হচ্ছে দুই হাজার ৮১৫ কোটি ১৮ লাখ ১১ হাজার টাকা।
বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গারা এদেশে আশ্রয় নেওয়ার পর এদেশে এক ধরণের সংকট তৈরি হয় উন্নয়ন সহযোগীরা সহায়তা দিয়ে তা নিজস্ব পরামর্শকের মাধ্যমে টাকাগুলো ভিন্নভাবে নিজেরাই নিয়ে নিচ্ছে। বিশ্বব্যাংক অর্থায়িত জরুরি ভিত্তিতে রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবেলায় মাল্টি-সেক্টর শীর্ষক প্রকল্পে শুধু পরামর্শক খাতে ব্যয় হয় ১২৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। স্থানীয় সরকার বিভাগ বলে, বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ অনুযায়ী পরামর্শক খাতে এই ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়।
স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রস্তাবনা তথ্য থেকে জানা যায়, মিয়ানমারের রাখাইন এস্টেটে নিপীড়িন-নির্যাতনের মুখে ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে আগত আট লক্ষাধিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মিয়ানমার সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে আসেন। তারা কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় স্থাপিত শিবিরে আশ্রয় নেয়। তাদের আগমনের কারণে ওই উপজেলার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দ্বিগুণ ছাড়িয়ে যায়। ফলে বিদ্যমান অবকাঠামো, অপ্রতুল সামাজিক সেবা প্রদান ব্যবস্থা, সুপেয় পানি ও স্বাস্থ্য বিধান ব্যবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর অপরিসীম চাপ সৃষ্টি হয়। এতে এলাকাটি বিভিন্ন কারণে অতিমাত্রায় ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। সেসময় আশ্রয় শিবিরগুলোতে মানবিক সহায়তা প্রদানের জন্য বাংলাদেশ সরকারসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা সহায়তা প্রদান করলেও প্রকল্প পরামর্শকদের পকেটে সিংহভাগ ঢুকে পড়ায় তা সেসময় সৃষ্ট সঙ্কট মোকাবেলায় পর্যাপ্ত ছিল না।
ঠিক একইভাবে ঢাকা-সিলেট বিদ্যমান দুই লেন সড়ককে চার লেনে উন্নীত করার প্রকল্পের কথা বলা যেতে পারে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় ২০৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে সড়কটি নির্মাণে খরচ ধরে ১৭ হাজার ১৬১ কোটি টাকা। সে হিসাবে কিলোমিটারপ্রতি খরচ পড়ে ৮২ কোটি টাকা। চার লেনের সড়কটি নির্মাণে পরামর্শক খাতে যে খরচ ধরা হয় তা অযৌক্তিক। এই পরামর্শক ব্যয়ই মূলত প্রকল্পের ব্যয় ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে দেয় এভাবে।
পরিকল্পনা কমিশন বলছে, এই ধরনের প্রকল্পে এত টাকা পরামর্শক খাতে ব্যয় করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। কাজের ধরন পর্যালোচনা করে যেসব পরামর্শক একান্ত প্রয়োজন সেগুলোকে বিবেচনা করা যেতে পারে। আর এই খাতে ব্যয়ও কমিয়ে আনতে হবে। এ ছাড়া বিভিন্ন আইটেমের একক ব্যয় অনেক বেশি ধরা হয়েছে। পূর্ত কাজের একক ব্যয় যৌক্তিকপর্যায়ে আনা দরকার।
এটি স্পষ্ট যে, দেশের অধিকাংশ উন্নয়ন প্রকল্প পরামর্শকের ভারে নুয়ে পড়ছে। ইদানীং পরামর্শক সেবার খোলস পাল্টে নাম দেয়া হচ্ছে পেশাগত সেবা। উন্নয়ন প্রকল্পের এই ন্যুব্জ দশা কাটানোর জন্য পরামর্শক খাতে ব্যয় কমানোর বিকল্প নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু ঋণ নিতে গেলে ঋণের সাথে গলায় পরামর্শক দলও ঝুলিয়ে দেবে দাতা দেশ। এ থেকে উত্তরণের পথ তাহলে কোথায়? প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে আগ্রহী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার: নাহিদ ইসলাম