November 25, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Sunday, July 17th, 2022, 9:30 pm

উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে দেশের গ্যাসকূপগুলোর উৎপাদন

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে দেশের গ্যাসকূপগুলোর উৎপাদন। ৭০টি কূপে আগে যেখানে দৈনিক উৎপাদন হতো ১ হাজার ১৪৫ মিলিয়ন ঘনফুট, এখন হচ্ছে ৮৭০ মিলিয়ন ঘনফুট। কূপগুলো থেকে গড়ে উৎপাদন ২৭৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস কমেছে। এমন অবস্থায় বিশেজ্ঞরা জরুরি ভিত্তিতে স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে বিকল্প ব্যবস্থায় দেশীয় গ্যাসের জোগান বাড়ানোর দিকে তাগিদ দিচ্ছে। তাদের মতে, প্রয়োজন হলে ভোলার অতিরিক্ত গ্যাস কিভাবে জাতীয় গ্রিডে আনা যায় তা নিয়েও চিন্তা-ভাবনা করা প্রয়োজন। পাশাপাশি বাপেক্সের মাধ্যমে পুরোনো কূপগুলো পুনরায় ওয়ার্কওভার তথা পুনর্খনন করেও গ্যাসের জোগান কিছুটা বাড়ানো সম্ভব। পেট্রোবাংলা সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশে এখন প্রতিদিন গ্যাসের উৎপাদন ক্ষমতা (আমদানিসহ) ৩ হাজার ৭৬০ মিলিয়ন ঘনফুট। বিপরীতে সরবরাহ হচ্ছে দুই হাজার ৯৯৬ মিলিয়ন ঘনফুট। আর প্রতিদিন এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট আমদানির কথা থাকলেও মাত্র ৬৮৩ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি হচ্ছে। বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডের তিতাস, হবিগঞ্জ, বাখরাবাদ, নরসিংদী, মেঘনা মিলিয়ে ৪৪টি কূপের দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা ৮৫১ মিলিয়ন ঘনফুট থাকলেও এখন উৎপাদন হচ্ছে ৬৩০ মিলিয়ন ঘনফুট। সিলেট গ্যাস ফিল্ডের সিলেট, কৈলাসটিলা-১ এবং ২, রশিদপুর, বিয়ানিবাজার গ্যাসক্ষেত্রে ১১টি কূপের উৎপাদন ক্ষমতা ১৪৯ মিলিয়ন ঘনফুট হলেও এখন হচ্ছে ৮৭ মিলিয়ন। আর বাপেক্সের সালদা, ফেঞ্চুগঞ্জ, শাহবাজপুর, সেমুতাং, সুন্দলপুর, শ্রিকাইল, বেগমগঞ্জ, রূপগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্রে সব মিলিয়ে ১৫টি কূপ রয়েছে। সেগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা ১৪৫ মিলিয়ন ঘনফুট। তবে বাপেক্স সেগুলো থেকে কিছুটা বেশি ১৫৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস তুলছে। তবে রূপগঞ্জ ক্ষেত্রের একটি কূপের উৎপাদন ক্ষমতা ৮ মিলিয়ন ঘনফুট হলেও কোম্পানিটি তা থেকে গ্যাস তুলছে না। আর দীর্ঘদিন গ্যাস তোলার পর কূপগুলোর সংস্কার করতে হয়। তাতে আবার আগের মতো গ্যাস উৎপাদন করা যায়। কিন্তু দেশীয় খনিগুলোয় ওই সংস্কার সময় মতো হয় না। অথচ কূপ সংস্কারের মাধ্যমে গ্যাস উৎপাদন কিছুটা বাড়নো সম্ভব। কিন্তু তা দিয়ে পুরো সঙ্কট মোকাবিলা সম্ভব নয়। আর গত কয়েক বছরে নতুন কোনো গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয়নি। পাশাপাশি গ্যাস আবিষ্কারে গভীর সাগরে কোনো কাজ হচ্ছে না। অনেক এলাকায় এখনো যাওয়াই হয়নি। মূলত সেখানে যেতে যে প্রযুক্তি ও জনবল প্রয়োজন তা নেই। এমন অবস্থায় সমন্বিত অ্যাকশন প্ল্যান করেই সংকট মোকাবিলা করতে হবে।
সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা পূরণে গ্যাস উৎপাদনকারী বিদেশি কোম্পানিগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ার পাশাপাশি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির দিকেও ঝুঁকছে দেশ। মূলত দেশীয় কোম্পানিগুলো নিজেদের গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে উৎপাদন বাড়ানোয় অনেকাংশেই পিছিয়ে রয়েছে। দেশে গ্যাসের মোট চাহিদার মধ্যে বাপেক্স ১০৫ মিলিয়ন, বিজিএফসিএল ৬৪০ মিলিয়ন আর সিলেট দিচ্ছে ৭৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। ওসব রাষ্ট্রীয় গ্যাসফিল্ড থেকে ৮১৫ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে। আর আন্তর্জাতিক ফিল্ডগুলো যেমন শেভরন দিচ্ছে ১ হাজার ৪১৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। অথচ নিজস্ব সক্ষমতার মাধ্যমে দেশীয় গ্যাস ফিল্ডগুলোর উৎপাদন বাড়াতে পারলে দৈনিক চাহিদা পূরণে আমদানিনির্ভর হতে হবে না। কিন্তু গত আড়াই দশকে বিদ্যমান গ্যাস উৎপাদনের ৬৩ ভাগ বিদেশি কোম্পানিগুলোর দখলে চলে গেছে। আর দেশীয় কোম্পানিগুলো উৎপাদন করছে ৩৭ শতাংশ। অথচ ১৯৯৮ সালের আগ পর্যন্ত দেশীয় কোম্পানিগুলোই শতভাগ গ্যাস উৎপাদন করতো।
সূত্র আরো জানায়, বিগত ২০০৪ সালে গ্যাস উৎপাদনে দেশীয় কোম্পানিগুলোর অবদান ছিল ৭৬ শতাংশ। তখন বিদেশি কোম্পানিগুলো ২৪ শতাংশ গ্যাস উৎপাদন করতো। কিন্তু আড়াই দশকের ব্যবধানে গ্যাস উৎপাদনে দেশীয় কোম্পানিগুলোর অবদান ৩৭ শতাংশে নেমে এসেছে। দেশীয় কোম্পানিগুলোর উৎপাদন কমে যাওয়ায় বাড়তি চাহিদা মেটাতে বিদেশি কোম্পানিগুলোকে অতিরিক্ত গ্যাস উৎপাদন করতে বলা হচ্ছে। ফলে যেখানে উৎপাদন ক্ষমতার ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ উৎপাদন করার কথা, সেখানে কোনো কোনো গ্যাসক্ষেত্র থেকে প্রায় শতভাগ উৎপাদন করা হচ্ছে। ফলে একদিকে বিদেশি কোম্পানিগুলো স্বল্পসময়ে বাড়তি উৎপাদন করে অতিরিক্ত অর্থ তুলে নিচ্ছে, অন্যদিকে গ্যাসের মজুতও দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। যা দেশের জন্য হুমকিস্বরূপ।
এদিকে দেশের গ্যাস খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রাথমিক পর্যায়ে কূপ থেকে সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ গ্যাস উত্তোলন সম্ভব হয়। পরবর্তী আরো দুটি ধাপে উত্তোলন করলে ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত গ্যাস উত্তোলন করা যেতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের কোম্পানিগুলো ওরকম কোনো চেষ্টা কখনো করেনি। এমন পরিস্থিতিতে আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের ৪৬টি গ্যাস কূপ ওয়ার্কওভার তথা পুনর্খনন, অনুসন্ধান ও উন্নয়নের মাধ্যমে দৈনিক ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। ওই কূপগুলো থেকে এখন দিনে ৮৬৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হচ্ছে। বর্তমানে দেশের সব গ্যাসক্ষেত্র থেকে দিনে ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হয়। আর দেশে গ্যাসের দৈনিক চাহিদা ৩ হাজার ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তবে পেট্রোবাংলা সর্বোচ্চ ৩ হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করে থাকে। চাহিদার বাকি ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করে পূরণ করা হচ্ছে। কিন্তু স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় উৎপাদন বৃদ্ধি করা গেলে এলএনজি আমদানি অনেক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী বাপেক্স ২০টি কূপ, বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লিমিটেডের (বিজিএফসিএল) ১২টি কূপ এবং সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেডের (এসজিএফএল) ১৪টি কূপ ওয়ার্কওভার ও ড্রিলিংয়ের কাজ করা হবে। নিজস্ব ২০টি কূপসহ বিজিএফসিএলের ১২টি কূপ ওয়ার্কওভার ও ড্রিলিংয়ের কাজ করবে বাপেক্স। এসজিএফএলের ১৪টি কূপ ওয়ার্কওভার ও ড্রিলিংয়ের কাজ করবে বাপেক্স এবং বাংলাদেশে তেল, গ্যাস অনুসন্ধান ও উন্নয়নে নিয়োজিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি শেভরন।
অন্যদিকে জ¦ালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের সব পুরোনো কূপ ওয়ার্কওভার এবং ছাতক গ্যাসক্ষেত্রের উন্নয়ন করা গেলে আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে দৈনিক অতিরিক্ত প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব হবে। তাতে এলএনজির ওপর চাপ কমার পাশাপাশি দেশে গ্যাসের যে সংকট আছে তাও অনেকাংশ কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। পেট্রোবাংলা এবং দেশীয় কোম্পানিগুলো উদ্যোগ নিলেই ধীরে ধীরে গ্যাস উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। কিন্তু বারবার উদ্যোগ নিতে বলা হলেও রহস্যজনক কারণে নেয়া হচ্ছে না। রশিদপুর গ্যাসক্ষেত্রের একটি কূপ থেকেই ১২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া সম্ভব। এজন্য সেখানে একটি আড়াই কিলোমিটার ও আরেকটি তিন কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপন করতে হবে। গত ৪ বছরেও এই হুক-আপ লাইন করা যায়নি। এমন আরো অনেক ক্ষেত্র আছে যেখানে কাজের সুযোগ আছে।
এ প্রসঙ্গে বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ আলী জানান, গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে বাপেক্স নিজেদের কাজগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন গ্যাসফিল্ডের কাজগুলোও চুক্তিভিত্তিক করে যাচ্ছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৫ সালের মধ্যে বাপেক্সের নিজস্ব কূপের পাশাপাশি বিজিএফসিএল এবং এসজিএফএলের কূপ ওয়ার্কওভার ও ড্রিলিংয়ের কাজ করা হবে।
একই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান জানান, সরকার দেশীয় গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধির পরিকল্পনা নিয়েছে। যদি তা করা যায় তাহলে ভবিষ্যতে দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন আশানুরূপভাবে বৃদ্ধি পাবে। এর মাধ্যমে এলএনজি আমদানি কমানো সম্ভব হবে।