আহমেদুজ্জামান,কমলগঞ্জ:
বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের মাগুরছড়া পুঞ্জিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে খাসিদের ঐতিহ্যবাহী “সেং কুটস্নেম” বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। মঙ্গলবার (২৩ নভেম্বর) দিনভর নিজেদের ঐতিহ্যময় কৃষ্টি আর সংস্কৃতি চর্চায় হাসি-আনন্দে পুরাতন দিনগুলিকে বিদায় দিয়ে নতুনকে আহ্বান করে নিলো নৃ-তাত্ত্বিক এই জনগোষ্ঠী।
পাহাড়-টিলার বুকে পান গাছের পরতে পরতে যে নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর জীবনগাঁথা ছড়িয়ে আছে- তারা হলো ‘খাসি’ সম্প্রদায়। এমনি একটি উৎসব “খাসি সেং কুটস্নেম” খাসিয়া সম্প্রদায়ের নিজস্ব বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ উৎসব।ব্রিটিশ শাসন আমল থেকে খাসিয়ারা ভারতের মেঘালয় রাজ্যে ২৩ নভেম্বর খাসি বর্ষবিদায় “খাসি সেঙ কুটস্যাম” উদযাপন করে আসছে।
২৪ নভেম্বর থেকে শুরু হয় খাসি বর্ষবরণ (স্ন্যাম থাইমি)। সেই ধারাবাহিকতায় কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া উদ্যানের ভেতরে মাগুরছড়ায় ২০১২ সাল থেকে খাসিয়া পুঞ্জির হেডম্যানদের উদ্যোগে খাসি বর্ষবিদায় অনুষ্ঠান হচ্ছে।
এ বছরও খাসি সোস্যাল কাউন্সিলের বর্ণাঢ্য আয়োজনে মাগুরছড়া পুঞ্জির টিলাঘেরা উদ্যানে মঙ্গলবার দিনভর আনন্দ উল্লাসের মধ্য দিয়ে এ দিবসটি পালন করা হয় ।
সকাল ১১টায় অনুষ্টানের শুভ শুচনা হওয়ার পর থেকে দিনব্যাপী চলতে থাকে তাদের নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী নানান সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
স্থানীয় ভাবে প্রচলিত বাংলায় ‘খাসিয়া’ হিসেবে পরিচিতি এই জনগোষ্ঠী যুগ-যুগ ধরে বনাঞ্চলে প্রতিকূল পরিবেশের সাথে সংগ্রাম করে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। খাসিদের মূল জীবিকা পান চাষ। খাসিয়াদের প্রধান ফসল এই পান বাজারজাত করনের পূর্ব পর্যন্ত উৎপাদনের প্রক্রিয়াটি মূলত নারীরাই করে থাকেন। তাই ক্রীড়ানুষ্ঠান’ পর্বে আয়োজন করা হয় “পানগুছি খেলা”। গাছ থেকে পান তোলার পর অংশগ্রহনকারীরা বেছে বেছে গুছিয়ে বরজে সাজানো হয় এ খেলায়। সেইসাথে ছিল ঐতিহ্যবাহী তীর নিক্ষেপ প্রতিযোগিতা। বিভিন্ন স্থান থেকে আসা তীরন্দাজরা অংশ নেন বিলুপ্তপ্রায় এ খেলায়। উৎসবে বাড়তি মাত্রা যোগ করে তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে উপরে উঠার প্রতিযোগিতা। অত্যন্ত আকর্ষণীয় এই ইভেন্টে বিভিন্ন বয়সের শিশু-কিশোররা অংশ নেয়। উৎসবে স্থানীয়রা ছাড়াও অন্যান্য উপজেলা থেকে খাসিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন অংশ নেয়। তাদের নিজেদের সংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে একত্রে চর্চা করতে পেরে তারাও ভীষণ আনন্দিত।
স্থানীয় ফুটবল মাঠের এক প্রান্তে বাঁশের খুঁটির উপর প্রাকৃতিক পরিবেশে কলা গাছের পাতার ছাউনি দিয়ে তৈরী আলোচনা সভার মঞ্চ । সেই মঞ্চে বিকেল ৪টায় খাসি সোস্যাল কাউন্সিলের আয়োজনে ঐতিহ্যবাহী “সেং কুটস্নেম” উপলক্ষ্যে জিডিসর প্রধান সুছিয়াং-এর সভাপতিত্বে অনুষ্টিত আলোচনায় অংশ নেন কমলগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো.রফিকুর রহমান । এছাড়া মাঠের চারপাশে ঘিরে ২০টি স্টল নিয়ে বসেছিল মেলা। খাসিদের নিত্যপণ্য ও খাদ্যসামগ্রী,পোষাক, বিভিন্ন জাতের ফলমূল ও জুমচাষের উপকরন সহ বিভিন্ন সামগ্রীর স্টল নিয়ে বসেন উদ্যেক্তারা। বাহারি সাজে সাজানো ছিল প্রতিটি স্টল।
বিভিন্ন খাসিয়া পুঞ্জি থেকে আগত নারী-পুরষ, শিশু-কিশোররা তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করে এসে এসব স্টলে খাসি সম্প্রদায়ের প্রয়োজনীয় সামগ্রী, খেলনা, খাদ্য সামগ্রী, পোশাক ও মশলার সামগ্রী দিনভর কেনাবেচা করেছেন।
উৎসবের মূল আকর্ষণ ছিল ঐহিত্যবাহী খাসি পোশাক পরে মেয়েদের নাচ-গান, দুটি পুকুরে বড়শি দিয়ে মাছ শিকার, গুলতি চালানো ও র্যাফেল ড্র । প্রতিটি আয়োজনে বিজয়ীদের জন্য ছিল আকর্ষণীয় পুরস্কার। খাসিদের এই বর্ষ সমাপনী, নতুন বছর আগমন উপলক্ষ্যে প্রকৃতির রংগের সাথে মিল রেখে উৎসবের সাজসজ্জা ছিল আসলেই মনোমগ্ধকর।
খাসি সোস্যাল কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক এলিসন সুঙ জানান, এ জেলার বিভিন্ন পাহাড়ী অঞ্চলে রয়েছে খাসিয়া সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস। নিজস্ব সংস্কৃতি ধরে রাখতে এ আয়োজন।
আয়োজক ও মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জির মন্ত্রী (হেডম্যান) জিডিশন প্রধান সুচিয়ং জানান, নববর্ষে খাসি জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশা-তাদের বর্ণিল সংস্কৃতির সৌরভ ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বময়; সেইসাথে সাংবিধানিক স্বীকৃতি এবং আদিবাসীদের অধিকার বাস্তবায়নে সরকার উদ্যোগী হবে- এমনটাই প্রত্যাশা।
আরও পড়ুন
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি