ইসরায়েলের বোমাবর্ষণ, হামলা ও অবরোধের মুখে গাজায় গত কয়েক মাস ধরেই দুর্ভিক্ষের সতর্কতা দেওয়া হচ্ছিল। এবার সেখানে শিশু মৃত্যুর হার বাড়তে শুরু হয়েছে।
বিশেষ করে বিচ্ছিন্ন উত্তর গাজায় দীর্ঘ সময় ধরে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ থাকায় তীব্র আকার ধারণ করেছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, উত্তরের কামাল আদওয়ান ও শিফা হাসপাতালে অপুষ্টি ও পানিশূন্যতার কারণে কমপক্ষে ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। নিহতদের অধিকাংশই শিশু – যাদের বয়স ১৫ বছরের মধ্যে আর একজন ৭২ বছর বয়সী পুরুষ।
অন্যদিকে দক্ষিণ গাজায় সাহায্য মিললেও দুর্বল শিশুরা মারা যেতে শুরু করেছে।
গত পাঁচ সপ্তাহে অপুষ্টিজনিত কারণে ১৬টি শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে বার্তা সংস্থা এপিকে জানিয়েছে রাফাহর এমিরাতি হাসপাতালের একজন জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক।
এই সপ্তাহের শুরুতে ইউনিসেফের মধ্যপ্রাচ্য প্রধান অ্যাডেল খোদর এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আমরা যে শিশু মৃত্যুর আশঙ্কা করছিলাম তা শুরু হয়ে গিয়েছে।’
ইউনিসেফের শিশু পুষ্টি বিশেষজ্ঞ অনুরাধা নারায়ণ বলেন, বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশনের অভাবে গাজায় ডায়রিয়াজনিত রোগ বাড়ছে যার ফলে অনেকেই ক্যালরি ধরে রাখতে পারছে না।
এপির প্রতিবেদনে জানা যায়, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় বাসিন্দারা। কিছু দোকানে মিললেও দাম অনেক বেশি।
বেশিরভাগ লোক ‘খুবাইজা’ নামে লতা-পাতা সিদ্ধ করে খেয়ে বেঁচে থাকছে। উত্তর গাজায় দুই ছেলে এবং তাদের সন্তানদের সঙ্গে বসবাসকারী ৭০ বছর বয়সী ফাতিমা শাহীন বলেন, সিদ্ধ খুবাইজা তার প্রধান খাবার এবং খুব হিসাব করে খাবার তৈরি করতে হচ্ছে।
শাহীন বলেন, আমরা এক টুকরো রুটির জন্য মরছি।
গাজার উত্তরাঞ্চলের আরেক বাসিন্দা ইউরো-মেড হিউম্যান রাইটস মনিটরের গবেষক এবং অর্থনৈতিক সাংবাদিক কামার আহমেদ জানান, তার ১৮ মাস বয়সী মেয়ে মীরা বেশিরভাগ সেদ্ধ লতা-পাতা খায়। তার বয়সের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো খাবার নেই।
কামাল আদওয়ান হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত প্রধান ডা. হুসাম আবু সাফিয়া এপিকে বলেন, তার কর্মীরা বর্তমানে দিনে ৩০০ থেকে ৪০০ শিশুর চিকিৎসা করেন এবং তাদের মধ্যে ৭৫ শতাংশই অপুষ্টিতে ভুগছে।
আবু ইউসুফ নাজ্জার হাসপাতালের শিশুদের জরুরি বিভাগের প্রধান ডা. জাবর আল-শায়েরের মতে, খাবারের অভাবে শিশুদের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়াও হাসপাতালে আরও অপুষ্টির শিকার ৮০ শিশু রয়েছে।
এমিরাতি হাসপাতালের নার্সারি ইউনিটের ডেপুটি হেড ডক্টর আহমেদ আল-শাইর বলেন, অকাল শিশুদের মৃত্যুর মূল কারণ মায়েদের মধ্যে অপুষ্টি। অপুষ্টির কারণে কম ওজনের শিশুর জন্ম ও মৃত্যু হচ্ছে। যুদ্ধের সময় এ মৃত্যু বেড়েছে বলে জানান চিকিৎসকরা।
চিকিৎসক আল-শাইর বলেন, হাসপাতালে ফেব্রুয়ারিতে ১৪টি এবং মার্চে এ পর্যন্ত আরও দুটি শিশু মারা গেছে। বর্তমানে হাসপাতালের ওয়ার্ডে ১০ দিনের কম বয়সী ৪৪টি শিশু রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা এখন তাদের চিকিৎসা করি কিন্তু ভবিষ্যৎ কী হবে আল্লাহ জানেন।’
গত ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর গাজায় পাল্টা আক্রমণ চালায় ইসরায়েল। এরপর থেকে খাবার-পানি-ওষুধসহ সব ধরনের নিত্য প্রয়োজনীয় সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। শুধু দক্ষিণে দুটি ক্রসিং দিয়ে দুই-একটি সাহায্যকারী ট্রাক প্রবেশের অনুমতি দেয়।
গাজায় ক্রমবর্ধমান ক্ষুধার জন্য জাতিসংঘের এজেন্সিগুলোকে দায়ী করে ইসরায়েল বলেছে, গাজা ক্রসিংয়ে তারা সাহায্য দ্রব্যগুলো বিতরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ প্রসঙ্গে গাজায় জাতিসংঘের বৃহত্তম সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ জানায়, ইসরায়েল কিছু পণ্য প্রবেশের অনুমতি দেয় না আর জটিল নিয়ম আরোপ করে যে কারণে ত্রাণ প্রবেশের গতি কমে যায়।
এছাড়াও গাজায় বিতরণ ব্যবস্থা প্রায় পঙ্গু হওয়ার পথে। যেসব সাহায্য বহনকারী ট্রাকগুলো ইসরায়েলি বাহিনী ফিরিয়ে দেয়। সেগুলো ফেরার সময় তারা কোনো নিরাপত্তা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। যার ফলে ফেরার পথে ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিরা ট্রাকে হামলা চালিয়ে সাহায্য ছিনিয়ে নেয়।
এছাড়াও খাবার বিতরণকালে সাহায্যের অপেক্ষায় থাকা ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি বাহিনী গুলি চালায়, যার ফলে ১২০ জনের মৃত্যু হয়। ইসরায়েল দাবি করে খাদ্য বিতরণকারী ট্রাকগুলোতে ফিলিস্তিনিরা হামলা করছিল তাই আত্মরক্ষার্থে গুলি চালানো হয়।
তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ইসরায়েল জানিয়েছে, শিগগিরই উত্তর গাজায় সাহায্যের জন্য ক্রসিং খোলা হবে এবং সমুদ্রপথে চালান আসার অনুমতি দেওয়া হবে।
—-ইউএনবি
আরও পড়ুন
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি
গাজায় গত একদিনে নিহত ৫২