April 20, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Tuesday, January 11th, 2022, 12:48 pm

করোনার মন্দার পর বৈদেশিক কর্মসংস্থানে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ

ফাইল ছবি

বৈশ্বিক শ্রমবাজারে বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য স্বাভাবিকতা ফিরে আসার ইতিবাচক লক্ষণ হিসাবে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) থেকে এক মাসে অভিবাসন ছাড়পত্র প্রাপ্ত কর্মীদের সংখ্যা গত এক মাসে (নভেম্বর) এক লাখ ছাড়িয়েছে।

বিএমইটি মহাপরিচালক শহীদুল আলম ইউএনবিকে জানান, ২০২১ সালে নভেম্বর মাসে এক লাখ দুই হাজার ৮৬৩ জন কর্মীকে বিদেশে যাওয়ার জন্য ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে। যেটা কিনা করোনা শুরু হওয়ার পর এক মাসে সর্বোচ্চ।

মহাপরিচালক জানান, ২০১৭ সালের মার্চ মাসে ১ লাখের বেশি কর্মী বিদেশে গিয়েছিলেন। আর ওই বছর মোট বিদেশে গিয়েছিলেন ১০ লাখ ৮ হাজার ৫২৫ জন, যা বাংলাদেশের এযাবৎকালের রেকর্ড। অবশ্য তখন করোনা মহামারি ছিল না। সেই হিসাবে নভেম্বর মাসের এক লাখ কর্মীর বিদেশে যাওয়ার ঘটনা রেকর্ড বলে জানা যায়।

বিএমইটি থেকে জানা যায়, স্বাধীনতার পরপর বছরে মাত্র হাজার পাঁচেক মানুষের বৈদেশিক কর্মসংস্থানের মধ্য দিয়ে বৈশ্বিক শ্রমবাজারে প্রবেশ করে বাংলাদেশ। ১৯৮৯ সালে প্রথমবারের মতো বছরে এক লাখ কর্মীর বিদেশে কর্মসংস্থান ঘটে। এরপর সেটি ২-৩ লাখ হয়ে ২০০৭ সালে ৮ লাখে পৌঁছে যায়। এরপর ২০০৮ সালে বাংলাদেশ থেকে ৮ লাখ ৭৫ হাজার বাংলাদেশির বিদেশে কর্মসংস্থান হয়। এরপর টানা কয়েক বছর গড়ে ৫-৬ লাখ শ্রমিক বিদেশে গিয়েছেন। ২০১৭ সালে বছরে ১০ লাখ কর্মী পাঠানোর রেকর্ড করা হয়। তবে পরের বছর ২০১৮ সালে ৭ লাখ ৩৪ হাজার এবং ২০১৯ সালে ৭ লাখ কর্মী বিদেশে যান।

বিএমইটি জানায়, ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে ৩৫ হাজার ৭৩২, ফেব্রুয়ারি মাসে ৪৯ হাজার ৫১০ এবং মার্চ মাসে ৬১ হাজার ৬৫৩ জন কর্মী বিদেশে গেছেন। তবে দেশে দ্বিতীয় দফায় করোনা মহামারির প্রকোপ বৃদ্ধি পেলে এপ্রিলে আবার লকডাউনের কারণে কর্মী যাওয়া কমে যায়। এই মাসে ৩৪ হাজার ১৪৫, মে মাসে ১৪ হাজার ২০০, জুনে ৪৫ হাজার ৫৬৭, জুলাই মাসে আবার ১২ হাজার ৩৮০ ও আগস্টে ১৯ হাজার ৬০৪ জন কর্মী বিদেশে যান।

শহীদুল আলম বলেন, করোনা পরিস্থিতি কিছুটা ভালো হওয়ার পর সেপ্টেম্বর থেকে ফের কর্মী যাওয়া বাড়তে থাকে। সেপ্টেম্বর মাসে ৪২ হাজার এবং অক্টোবরে ৬৫ হাজার ২৩৩ জন বিদেশে যান।

অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে, সংখ্যাটি আগের মাসের তুলনায় ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে যা বাংলাদেশকে বৈশ্বিক শ্রমবাজারে একটি শক্ত অবস্থান সৃষ্টিতে সহায়তা করেছে।

শহীদুল আলম আরও বলেন, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বিমান চলাচল স্বাভাবিক হওয়ায় আমাদের শ্রমবাজার ঘুরে দাঁড়িয়েছে

তিনি জানান, ২০২১ সালে চার লাখ ৮৫ হাজার ৮৯৫ জন কর্মী বিদেশে গেছেন, তার মধ্যে এককভাবে সৌদি আরবেই গেছেন তিন লাখ ৭০ হাজার ১৪ জন; অর্থাৎ এ বছর বিদেশে যত লোক গেছেন, তার মধ্যে ৭৬ শতাংশই গেছেন সৌদি আরবে।
মহামারির মধ্যে ওমানে ৪০ হাজার ৮৬, সিঙ্গাপুরে ২১ হাজার ৩৩৯, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১৪ হাজার ২৭৪, জর্ডানে ১১ হাজার ৮৪৫, কাতারে ৯ হাজার ৭২৮ ও কুয়েতে ৯৩৬ জন কর্মী গেছেন।

এ বিষয়ে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান ইউএনবিকে বলেন, করোনা পরিস্থিতির মধ্যে প্রায় পাঁচ লাখ কর্মীর বিদেশে কর্মসংস্থানের বিষয়টি অবশ্যই ইতিবাচক।

তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী আয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর শীর্ষ ১০ দেশের একটি। মূলত এক কোটির বেশি প্রবাসী বিদেশ থেকে এই অর্থ পাঠাচ্ছেন।

ফলে ২০২১ সালের ৩ মে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রথমবারের মতো ৪৫ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক ছুঁয়েছে বাংলাদেশ। করোনা মহামারির মধ্যেও রেকর্ড পরিমাণ ২৪ বিলিয়ন ডলারের প্রবাসী আয় পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।

শরিফুল হাসান বলেন, আরেকটু সহজ করে বললে বলা যায়, সারা বিশ্ব মিলিয়ে বাংলাদেশকে এখন যে পরিমাণ ঋণ বা অনুদান দিচ্ছে বা সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের (এফডিআই) যে অর্থ আসছে, তার চেয়ে ৬-১০ গুণ পর্যন্ত বেশি অর্থ পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা।

মহামারির কারণে গত বছর মাত্র ২ লাখ ১৭ হাজার কর্মী বিদেশে যান। একদিকে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ভয়াবহভাবে কমে যাওয়া, অন্যদিকে প্রায় ৫ লাখ বাংলাদেশি বিদেশ থেকে ফেরত আসেন। সবকিছু মিলিয়ে পরিস্থিতি বেশ সংকটাপন্ন ছিল। তবে গত বছরের অক্টোবর থেকেই পরিস্থিতির ইতিবাচকভাবে উত্তরণ ঘটে। এ বছরের শুরু থেকে সেই ধারাই অব্যাহত ছিল।

তিনি বলেন, ২০২০ সালের মার্চে মহামারির প্রথম ধাক্কা পড়ল অভিবাসন খাতে। আমরা বারবার হোঁচট খেয়েছি; কিন্তু থেমে যাইনি। নানা সংকটের মধ্যেও সরকার, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, বিএমইটি, কল্যাণ বোর্ড, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক ও বেসরকারি সংস্থাগুলো একসঙ্গে কাজ করার চেষ্টা করেছে। মহামারির পর সারা বিশ্বে কৃষিসহ বিভিন্ন খাতে শ্রমিকের চাহিদা বাড়ছে।

শরিফুল বলে, ভবিষ্যতে অভিবাসীদের জন্য কোথায় কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হতে পারে সে অনুযায়ী কর্মীদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা দিয়ে প্রস্তুত করতে হবে।

তিনি বলেন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অংশ হিসাবে নতুন পেশার জন্য উপযুক্ত শ্রমিকদের জন্য বৃহত্তর চাহিদার বিষয়ে ইতোমধ্যেই ঐকমত্য রয়েছে।

শরিফুল বলেন, নতুন শ্রমবাজার অনুসন্ধান করাও যেমন গুরুত্বপূর্ণ ঠিক তেমনি দক্ষ জনশক্তি তৈরির উদ্যোগও নিতে হবে।

ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান বলেন, প্রবাসীদের বিক্ষোভের মধ্যেই যথাসময়ে টিকিটের ব্যবস্থা করা, বিদেশগামীদের নিবন্ধন ও টিকার ব্যবস্থা করা, কোয়ারেন্টিনের জন্য ২৫ হাজার করে টাকা, বিমানবন্দরে আরটি-পিসিআর যন্ত্র বসানো, প্রবাসীদের করোনার খরচ সরকারের বহন করা, বিদেশফেরতদের জন্য নানা ধরনের উদ্যোগ এসব মিলিয়েই এই অর্জন।

দেশের জেলা পর্যায়ে বিদেশগামী কর্মী সেবা সহজ করার লক্ষ্যে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে সেবার মান বাড়াতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এজন্য সবকিছু নতুন করে সাজানো হচ্ছে বলে জানান এ কর্মকর্তা।

শহীদুল আলম বলেন, বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাতে করোনাভাইরাসের প্রভাব কাটিয়ে দেশের জনশক্তি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। নতুন নতুন শ্রমবাজার চালু হচ্ছে এতে বিদেশগামী কর্মীদের প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা করতে গণমাধ্যম কর্মীদের এগিয়ে আসতে হবে।

সৌদি আরবে বাংলাদেশি কর্মীদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য প্রতি মাসে বাংলাদেশে থাকা সৌদি দূতাবাসের সঙ্গে একটি করে মিটিং করা হবে।
বিদেশগামী কর্মীদের উদ্দেশ্য করে শহীদুল আলম বলেন, বিদেশ যাওয়ার আগে কারও সাথে লেনদেন করার সময় প্রমাণ রাখতে হবে। প্রয়োজনে কাগজপত্র ও সেই ব্যক্তির ছবি তুলে রাখতে হবে। যেন কোন রকম হয়রানির শিকার হলে সেই প্রমাণ নিয়ে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া যায়।

এদিকে, এই সমস্ত উদ্যোগ সত্ত্বেও বাংলাদেশ প্রবাসী অধিকার পরিষদ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কর্মরত প্রবাসীদের জন্য বিমান ভাড়া কমানোর দাবি জানিয়েছে। ২০২১ সালের শেষের দিকে দাবিটি নিয়ে সোচ্চার হতে দেখা গেছে।

বিভিন্ন মহল থেকে বর্ধিত চাপের মধ্যে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স নববর্ষে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বিমান ভাড়া কমানোর ঘোষণা দিয়েছে, যা ১৬ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে।

বিএমইটি সূত্রে জানা যায়, স্বাধীনতার পরপর বছরে মাত্র হাজার পাঁচেক মানুষের বৈদেশিক কর্মসংস্থানের মধ্য দিয়ে বৈশ্বিক শ্রমবাজারে প্রবেশ করে বাংলাদেশ। ১৯৮৯ সালে প্রথমবারের মতো বছরে এক লাখ কর্মীর বিদেশে কর্মসংস্থান ঘটে। এরপর সেটি ২-৩ লাখ হয়ে ২০০৭ সালে ৮ লাখে পৌঁছে যায়। এরপর ২০০৮ সালে বাংলাদেশ থেকে ৮ লাখ ৭৫ হাজার বাংলাদেশির বিদেশে কর্মসংস্থান হয়। এরপর টানা কয়েক বছর গড়ে ৫-৬ লাখ বিদেশে গিয়েছেন। ২০১৭ সালে বছরে ১০ লাখ কর্মী পাঠানোর রেকর্ড। তবে পরের বছর ২০১৮ সালে ৭ লাখ ৩৪ হাজার এবং ২০১৯ সালে ৭ লাখ কর্মী বিদেশে যান।

২০১৮ সালে প্রায় সাত লাখ ৩৪ হাজার এবং ২০১৯ সালে আরও সাত লাখ শ্রমিক বিদেশে কাজের উদ্দেশে পাড়ি জমিয়েছে।

শহীদুল আলম বলেন, বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাতে শ্রমিকরা করোনার ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সহায়তা করছে। নতুন নতুন শ্রমবাজার চালু করা হচ্ছে।

অভিবাসী শ্রমিকরা যাতে প্রতারণার শিকার না হয় সেই জন্য মিডিয়া কর্মীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

—ইউএনবি