April 20, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Saturday, July 17th, 2021, 12:34 pm

করোনা মহামারীতে ওষুধ বিক্রিতে বড় কোম্পানিগুলোর পোয়াবারা

নিজস্ব প্রতিবেদক :

করোনা মহামারীতে দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলোর পোয়াবারো। দিন দিন ওষুধ কোম্পানিগুলোর বিক্রি বেড়েই চলেছে। গত এক বছরে দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলোর মোট বিক্রয় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৭ শতাংশেরও বেশি। অর্থমূল্যে তার পরিমাণ ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। আর বড় কোম্পানিগুলো কভিডকালে ওষুধের এমন বর্ধিত চাহিদার সুফল সবচেয়ে বেশি পেয়েছে। ওসব প্রতিষ্ঠানের কোনো কোনোটির বিক্রিতে প্রবৃদ্ধি ৩০ শতাংশও ছাড়িয়ে গেছে। মূলত নগরায়ণের চাপ ও পরিবেশ দূষণের কারণে মানুষের বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ফলে স্বাস্থ্য খাতে জনসাধারণেরও ব্যয় বাড়ছে। তাছাড়া দেশের অর্থনীতি ও জনসংখ্যার আকারও বাড়ছে। ওই দুয়ের প্রভাবেই যে কোনো পণ্য বিক্রিতে প্রবৃদ্ধি হওয়ার কথা। কভিড-১৯ মহামারী তার সঙ্গে ওষুধ ও সাপ্লিমেন্টের চাহিদায় ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। ওসব কিছু মিলিয়েই ওষুধ কোম্পানিগুলোর বিক্রয় প্রবৃদ্ধিতে বড় ধরনের উল্লম্ফন দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতি (বাপি) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিগত ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত এক বছরে দেশের বাজারে ২৭ হাজার ২৬২ কোটি টাকার ওষুধ বিক্রি হয়েছে। তার আগে গত বছরের মার্চ পর্যন্ত এক বছরে বিক্রির পরিমাণ পরিমাণ ছিল ২৩ হাজার ২৫৯ কোটি টাকা। ওই সময়সীমা বিবেচনায় ওষুধ বিক্রিতে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ১৭ দশমিক ২১ শতাংশে। সব মিলিয়ে গত পাঁচ বছরের গড় প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৬ শতাংশে। কভিডের কারণে গত এক বছরে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধিকারী সাপ্লিমেন্টের চাহিদা ব্যাপক হারে বেড়েছে। বিশেষ করে ভোক্তা পর্যায়ে ভিটামিন সি ও ডি সাপ্লিমেন্টের চাহিদায় বড় ধরনের ঊর্ধ্বগতি দেখা গেছে। ফলে কোম্পানিগুলোও বাজারে ওসব সাপ্লিমেন্টের সরবরাহ ও বিক্রি বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে ওষুধ কোম্পানিগুলোর কভিডকেন্দ্রিক বিক্রিতে প্রবৃদ্ধি শুধু সাপ্লিমেন্টে আসেনি। ওই সময় রেমডিসিভির, অ্যাজিথ্রোমাইসিন, আইভারমেকটিন জাতীয় ওষুধ বিক্রিও বেড়েছে।
সূত্র জানায়, ওষুধ কোম্পানিগুলোর বিক্রয় ও বিপণন ব্যবস্থাপনা ওষুধ বিক্রি বাড়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে। কারণ বড় প্রতিষ্ঠানগুলো চিকিৎসকদের আস্থা ধরে রাখার পাশাপাশি কভিডকেন্দ্রিক বাজার ব্যবস্থাপনায়ও মনোযোগ দিয়েছে। তাছাড়া মহামারীর প্রভাবে বেশকিছু ওষুধের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। কোম্পানিগুলো ওই চাহিদা সঠিকভাবে মেটাতে সক্ষম হয়েছে। ফলে মহামারীর মধ্যেও ওষুধ কোম্পানিগুলো নিজ নিজ সক্ষমতা অনুযায়ী সরবরাহ ব্যবস্থাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পেরেছে।
সূত্র আরো জানায়, দেশের মোট ওষুধের প্রায় ৭১ শতাংশই বিক্রি করে শীর্ষ ১০ প্রতিষ্ঠান। ওসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এক বছরে দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলোর মধ্যে বিক্রয় প্রবৃদ্ধির দিক থেকে শীর্ষে ছিল হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। গত বছরের এপ্রিল থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি ১ হাজার ৮০৯ কোটি টাকার ওষুধ বিক্রি করেছে। বিক্রয় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩০ দশমিক ৩৭ শতাংশ। তবে ওই সময় মোট বিক্রির দিক থেকে প্রতিষ্ঠানটি চতুর্থ অবস্থানে ছিল। বিক্রয় প্রবৃদ্ধির দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস। এক বছরে প্রতিষ্ঠানটি ২ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকার ওষুধ বিক্রি করেছে। বিক্রি বেড়েছে ২৮ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। তবে মোট বিক্রির তালিকায় বেক্সিমকোর অবস্থান তৃতীয়। আর দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলোর মধ্যে গত বছর সবচেয়ে বেশি বিক্রি করেছে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। যদিও বিক্রয় প্রবৃদ্ধির দিক থেকে প্রতিষ্ঠানটি তৃতীয় অবস্থানে ছিল। এক বছরে প্রতিষ্ঠানটি ৪ হাজার ৭১৫ কোটি টাকার ওষুধ বিক্রি করেছে। বিক্রয় প্রবৃদ্ধির হার ২৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ। আর বিক্রয় প্রবৃদ্ধিতে চতুর্থ অবস্থানে ছিল এসকায়েফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। করোনার এক বছরে প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদিত ওষুধ বিক্রির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ১৬৯ কোটি টাকা। ওই সময় প্রতিষ্ঠানটির বিক্রি বেড়েছে ২২ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। তবে মোট বিক্রির দিক থেকে এসকায়েফের অবস্থান ছিল সপ্তম। তাছাড়া গত মার্চ পর্যন্ত এক বছরে বিক্রয় প্রবৃদ্ধিতে পঞ্চম অবস্থানে ছিল অপসোনিন। কোম্পানিটির ওষুধ বিক্রিতে ওই সময় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ। মোট বিক্রির পরিমাণ ১ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা। সেদিক থেকেও কোম্পানিটির অবস্থান ছিল পঞ্চম। তবে বিক্রিতে দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও বিক্রয় প্রবৃদ্ধির দিক থেকে ষষ্ঠ স্থানে ছিল ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত এক বছরে প্রতিষ্ঠানটি ৩ হাজার ১৩৫ কোটি টাকার ওষুধ বিক্রি করেছে। বিক্রিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ। আর ১৫ দশমিক ৬০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিক্রয় সম্প্রসারণের দিক থেকে সপ্তম ছিল রেনাটা। অষ্টম অ্যারিস্টোফার্মার প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১৪ দশমিক ৬২ শতাংশ। ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ বিক্রি বাড়ানোর মধ্য দিয়ে নবম স্থানে ছিল এসিআই। ওই তালিকায় দশম ড্রাগ ইন্টারন্যাশনালের বিক্রি বেড়েছে ৩ দশমিক ১৫ শতাংশ।
এদিকে ওষুধ কোম্পানিগুলোর বিক্রয় খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশের বড় ওষুধ কোম্পানিগুলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) অনুমোদিত ওষুধগুলো বাংলাদেশে দ্রুততম সময়ের মধ্যে তৈরি করে গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দিতে সমর্থ হয়েছে। উৎপাদনের পাশাপাশি মাঠপর্যায়ের জনবলের সঙ্গে সমন্বয়ের ভিত্তিতে বাজারে পরিকল্পিতভাবে ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। ফলে মহামারীকালেও ওষুধ কোম্পানিগুলোর কাজের গতি শ্লথ হয়ে পড়েনি। এ বিষয়ে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের মার্কেটিং ডিরেক্টর আহমেদ কামরুল আলম জানান, গত এক বছরে কভিডের প্রভাবে বাজারের যে ভিন্নতা ছিল বিপণন ও প্রচারণামূলক কর্মকা-ে তার প্রতিফলন দেখা গেছে। বিশেষ করে চিকিৎসকের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাতের বিষয়গুলো ডিজিটাল ব্যবস্থা কাজে লাগিয়ে করতে হয়েছে। এক বছরে ওষুধ বিক্রিতে প্রবৃদ্ধির যে হার, তা অনেক দিন পরে হয়েছে। এ পর্যায়ের প্রবৃদ্ধি চার-পাঁচ বছর আগে হয়েছে। নিকট অতীতে কোম্পানিগুলোর এতো ভালো প্রবৃদ্ধি দেখা যায়নি। চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যয় স্বাভাবিকভাবেই মানুষকে অনেক বেশি করতে হয়েছে। ব্যাপক প্রবৃদ্ধির জন্য কভিডের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা দক্ষতা সমানভাবে কাজে লেগেছে। তবে স্বাভাবিকভাবেই কভিডকেন্দ্রিক ওষুধের চাহিদা বেশি ছিল, যা যাচাই করে ওই পণ্যগুলো বেশি তৈরি করার মতো বিষয়গুলোর দক্ষতাও ভালো ছিল। তাছাড়া দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও এখন বাড়ছে। ১০ বছর আগেও মানুষ অর্থাভাবে যে রোগের জন্য চিকিৎসকের কাছে যেত না, ক্রয়ক্ষমতা বাড়ায় সে রোগের চিকিৎসার জন্য মানুষ এখন নিজ থেকেই চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছে। কিছু চিকিৎসার জন্য আগে দেশের বাইরেও যেতে হতো, এখন মানসম্পন্ন হাসপাতাল হওয়ায় ওসব চিকিৎসা দেশেই পাওয়া যাচ্ছে। এর সবকিছুই ওষুধের বাজার বিস্তৃত করতে সাহায্য করেছে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির (বাপি) সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল মুক্তাদির জানান, ওষুধ খাতের সম্ভাবনা ব্যাপক। কভিডের সময়েও ওষুধ খাত কাজ করেছে। জনগণকে ওষুধ পৌঁছাতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে। এ কাজে সফলও হয়েছে। চলমান সময়ে ওষুধ শিল্পের বড় অবদান ছিল। যেসব ওষুধ অনেক দেশে পাওয়া যায়নি সেগুলো বাংলাদেশে পাওয়া গেছে। মানুষ সেগুলো পেয়ে লাভবান হয়েছে। শুধু বাংলাদেশের মানুষই নয়, এদেশের ওষুধে পুরো লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, মিয়ানমারসহ পৃথিবীর বহু দেশ উপকৃত হয়েছে।