April 26, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Monday, January 3rd, 2022, 8:45 pm

কাঁচামাল সংকটে মুখ থুবড়ে পড়েছে উৎপাদন খাত

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

উৎপাদন বৃদ্ধির মূল অনুঘটক হলো কাঁচামাল। কাঁচামাল হলো অনেকটা বিক্রিয়কের মতো। বিক্রিয়ক যতো বেশি হবে, উৎপাদও ততো বেশি হবে। উৎপাদন ভালো মানের হওয়ার জন্যও ভালো কাঁচামাল সরবরাহ করা আবশ্যক। বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশের উৎপাদন বৃদ্ধি না পাওয়ার প্রধান কারণ হলো কাঁচামাল ঘাটতি।
দেশে কাঁচামালের সহজপ্রাপ্যতার অভাব একটি বড় সমস্য। শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামালের দাম ক্রমাগত বাড়তে থাকায় সংকটে পড়েছে বাংলাদেশের উৎপাদন খাত। গত কয়েক মাসে এমন কোনো পণ্য নেই, যার দাম বাড়েনি। কাঁচামালের জন্য চীনের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতার কারণে সংকট আরো বেড়েছে।
উৎপাদকরা বলছেন, কাঁচামালের নিশ্চয়তা না পাওয়ার কারণে তারা অনেক অর্ডার ফেরত দিচ্ছেন অথবা আংশিক অর্ডার নিচ্ছেন। গত কয়েক দিনে বাংলাদেশের বেশ কয়েক জন উৎপাদকের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। তারা জানান, নির্মাণশিল্প, তৈরি পোশাক, অটোমোবাইল, ওষুধশিল্পের কাঁচামাল, কাগজ, নিত্যপণ্য কিছুই বাদ যায়নি দাম বাড়ার তালিকা থেকে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অতিরিক্ত জাহাজ ভাড়া। গত কয়েক মাসে পণ্য পরিবহনে সামুদ্রিক জাহাজের ভাড়া কোনো কোনো ক্ষেত্রে দ্বিগুণ হয়েছে।
বাংলাদেশ কাঁচামালে সমৃদ্ধ না হওয়ায় উৎপাদন খরচও ক্রমাগত বাড়ছে। বাংলাদেশকে বিভিন্ন দেশ থেকে উৎপাদন কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশে যদি কাঁচামাল যোগান দেওয়া সম্ভব হতো তাহলে উৎপাদন খরচ বহুলাংশে হ্রাস পেতো। ফলে নীট মুনাফা বৃদ্ধি পেতো।কিন্তু বিদেশেও মহামারী করোনার কারণে কাঁচামাল সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে উৎপাদন খরচ আরও বেড়ে গেছে। এক হিসাবে দেখা গেছে, সারা বিশ্বে দৈনন্দিন যে পণ্য লাগে, তার ২৮ শতাংশ উৎপাদন করে চীন। নিজের দেশের চাহিদা মিটিয়ে বাকিটা তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে। সম্প্রতি চীনের কারখানাগুলোতে বিদ্যুৎ রেশনিং করা হচ্ছে। আগে যেখানে চীনের কারখানাগুলো ২৪ ঘণ্টা চলত, সেখানে এখন চলছে আট ঘণ্টা করে। এতে করে পণ্য সরবরাহে চাপ বেড়েছে। ব্যবসায়ীদের মতে, কাঁচামাল ও তৈরি অনেক পণ্যের ক্ষেত্রে চীনের ওপর নির্ভরতা বেশ বেড়েছে। যেসব ব্যবসায়ী চীন থেকে কাঁচামাল এনে পণ্য রপ্তানি করত, তারা পড়েছে সংকটে। পর্যাপ্ত অর্ডার থাকলেও তারা তা নিতে পারছে না। এর সঙ্গে দাম বাড়ার বিষয়টি আছেই।
সরবরাহকারীদের কমিটমেন্ট থাকলেও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর এ ক্ষেত্রে কমিটমেন্ট নেই বলে অভিযোগ তুলেছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁদের দাবি, এলসি খোলার পরও তারা নির্ধারিত সময়ে তা সরবরাহ করে না। এ কারণে অনেকে কাঁচামালের জন্য চীনের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। চীনের কারখানাগুলো দিনের অধিকাংশ সময় বন্ধ থাকায় সংকট সামনে আরো বাড়বে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। এদিকে, একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম জানিয়েছে, এ বছর চীনের নববর্ষের ছুটির মেয়াদ বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে দেশটির সরকার। এর আগে প্রতি বছর এই ছুটি ২৫ দিন থাকত। এবার এটি বাড়িয়ে ৫০ দিন করা হতে পারে। বিশেষ করে করোনা ভাইরাস দ্রুত ছড়ানোর কারণে এমন সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে চীনা কর্তৃপক্ষ। জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ কিংবা ফেব্রুয়ারির শুরু থেকে এই ছুটি শুরু হতে পারে। চীনের কারখানাগুলো ৫০ দিন টানা বন্ধ থাকলে বিশ্বের শিল্প খাতের জন্য একপ্রকার বিপর্যয় নেমে আসবে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। তবে বিদ্যুৎ রেশনিং ও নববর্ষের ছুটি বাড়ানোর পেছনে চীনের অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলেও মনে করেন তারা।
জানা যায়, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের অনেক উদ্যোক্তাই চীন থেকে কাঁচামাল আমদানি করে। তাঁরা জানায়, গত কয়েক মাস ধরে চীনের সরবরাহকারীরা চাহিদামতো পণ্য দিতে পারছেন না। যে কারণে ইউরোপের অনেক অর্ডার আমরা ফেরত দিচ্ছি। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে ব্যবসা করা খুবই মুশকিল। অনেক সময় তারা সময়মতো কাঁচামাল সরবরাহ করে না, যে কারণে চীনের ওপর আমাদের নির্ভরতা বাড়ছে। কিন্তু এখন চীনের আচরণও রহস্যজনক। এদিকে, ক্রমাগত কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশের নিত্যপণ্য, সিমেন্ট, স্টিলসহ সব খাতে তীব্র চাপ পড়েছে। ইতোমধ্যে সিমেন্টের উৎপাদন ও বিক্রি কমে গেছে।
উদ্যোক্তাদের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায় বাজার র্প্যবেক্ষণ করলে। সূত্র জানায়, এখন প্রতি মাসে সিমেন্ট উৎপাদকেরা ৩০০ কোটি টাকা লোকসান দিচ্ছেন। এটি স্পষ্ট যে, এভাবে চলতে থাকলে ৩০ শতাংশ কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। এদিকে, স্টিল মিলগুলোতে কাঁচামালের দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে তীব্রভাবে। এই খাতে ব্যবহৃত স্ক্র্যাপ প্রতি টনে ২০ হাজার করে বেড়েছে। এজন্য উৎপাদিত রডের দামও বেড়েছে। শিল্পে ব্যবহৃত তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদনের খরচ আরো বেড়েছে। এদিকে শুধু শিল্পপণ্য নয়, মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহার করা নিত্যপণ্যের দামও বেশ বেড়েছে গত কয়েক মাসে। ভোজ্যতেল, চাল, ডাল, চিনি থেকে শুরু করে এমন কিছু নেই যার দাম বাড়েনি। এই মূল্যবৃদ্ধির হার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। এতে করে দেশের বিশাল ভোক্তাশ্রেণির ওপর এর চাপ বেড়েছে।
জাতিসংঘের খাদ্য কর্মসূচি ফাওয়ের পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম বাড়তে থাকে। চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, গম, বার্লি, বিভিন্ন ডেইরি পণ্য, মাছ, মাংস সবকিছুর দাম বেড়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পণ্যগুলোর উৎপাদন কমে যাওয়া, আবার কোনো ক্ষেত্রে দেশগুলোর অতিরিক্ত মজুতদারি বাড়ানোর কারণে দাম বেড়েছে।
বাংলাদেশে করোনা ছোবল হানে ২০২০ সালের মার্চে। করোনার কারণে তখন থেকে কাঁচামাল সরবরাহ বিঘিœত হয়। কেননা, বিশ্বের শক্তিশালী রপ্তানিকারক দেশ যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়। ফাওয়ের বাংলাদেশ অফিসও একই তথ্য দিচ্ছে। তাঁদের মতে, করোনা শুরু হওয়ার পর বাংলাদেশের সরবরাহব্যবস্থা একেবারেই ভেঙে পড়ে। বিশেষ করে লকডাউনের সময় এই সরবরাহব্যবস্থা নিরবচ্ছিন্ন ছিল না। এ কারণে পণ্যের দামে যে ঊর্ধ্বগতি ছিল, তা এখনো অব্যাহত রয়েছে। এদিকে, লকডাউনের সময় সাধারণ জনগণের মধ্যে পণ্য মজুতের প্রবণতা শুরু হয়। যার ফলে লকডাউনের প্রথম সপ্তাহে বাজারে পণ্যমূল্য ১৬ শতাংশ বেড়ে যায়। এর পরে তা আরো বেড়ে ২০ শতাংশে উন্নীত হয়।