November 3, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Monday, December 11th, 2023, 8:35 pm

কারাগারে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

কারাগারের ভেতরে মৃত্যুর সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। গত চার বছরে প্রায় সাড়ে ৩০০ কারাবন্দীর মৃত্যু হয়েছে। প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের বেশ কয়েকজন কর্মীসহ এ বছরই জেল হেফাজতে প্রায় ১০০ জন মারা গেছে। সম্প্রতি মারা যাওয়া বন্দীদের অধিকাংশের বয়স ৪০ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে। কারা কর্তৃপক্ষের দাবি, রিমান্ড ফেরত আসামিদের বেশিরভাগই অসুস্থ অবস্থায় কারাগারে আসেন। এরপর কিছুদিনের মধ্যে তাদের মৃত্যু হয়। আর পুলিশের পক্ষ থেকে হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করা হয়। যদিও কারা কর্তৃপক্ষের দাবি, কারাগারের ভিতর আসামি বা বন্দীদের ওপর নির্যাতন চালানোর কোনো সুযোগ নেই।

তবে মানবাধিকার কর্মীদের মতে কারাগার অথবা পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় ময়নাতদন্ত বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)’র তথ্য অনুসারে, এই বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বরের মধ্যে, ৫৩ জন বন্দী বিচার পর্যায়ে এবং ৪০ জন দোষী সাব্যস্ত হয়ে মারা গেছেন। মৃত্যুর মধ্যে সর্বোচ্চ ৬৩ জন ঢাকা বিভাগের কারাগারে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক ফারুক ফয়সেল বলেন, এত বন্দির মৃত্যু অবহেলার ফল হতে পারে।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের কারাগারগুলো দুর্নীতিতে ভরা, এবং কারা কর্তৃপক্ষের অবহেলা এবং জনাকীর্ণ কারাগারের কারণে এ ধরনের মৃত্যু হতে পারে। আসক-এর তথ্য মতে, জানুয়ারি থেকে নভেম্বরের মধ্যে জেল হেফাজতে ৯৩ জন বন্দির মৃত্যু হয়েছে – সাম্প্রতিক বছরগুলিতে সর্বোচ্চ। অধিকার গোষ্ঠীটি বলেছে যে, ২০২২ সালে জেল হেফাজতে ৬৫ জনের মৃত্যুর হয়েছে, ২০২১ সালে ৮১ জন, ২০২০ সালে ৭৫ জন, ২০১৯ সালে ৫৮ জন, ২০১৮ সালে ৭৪ জন, ২০১৭ সালে ৫৩ জন, ২০১৬ সালে ৭৮ জন এবং ২০১৫ সালে ৬৯ জন জেল হেফাজতে মারা গেছেন। সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে ৭ জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচনের আগে সরকার বিরোধীদের বিরুদ্ধে চলমান অভিযানে মধ্যে ডিসেম্বরে আরও পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই বিএনপি নেতা-কর্মীরা।

সর্বশেষ বৃহস্পতিবার রাজশাহী কারাগারে অসুস্থ হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নাটোরের বিএনপি নেতা এ কে আজাদ সোহেল মারা গেছেন। সোহেল নাটোরের সিংড়া উপজেলার হাতিয়ান্দহ ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। সোহেলের বড়ো ভাই শামীম রেজা বলেন, নাশকতার একটি মামলায় গ্রেপ্তারের পর গত ১৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় সোহেলকে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। “সোহেল কারাগারে থাকা অবস্থায় গত ৩০ নভেম্বর নাটোর আদালত থেকে জামিন পান। আদালতের আদেশ নিয়ে কারাগারে গিয়ে জানতে পারি আমার ভাই সেখানে নেই। জেল থেকে আমাদের বলা হয়, তাকে রাজশাহী মেডিকেলে পাঠানো হয়েছে, সে গুরুতর অসুস্থ।

অথচ আমার ভাই সম্পূর্ণ সুস্থ ছিল,” বলেন শামীম। আটদিন রাজশাহী মেডিকেলে থেকে সোহেল বৃহস্পতিবার মারা যান জানিয়ে তিনি বলেন, “জামিন হলেও আমার ভাইকে কারাগার থেকে মুক্ত করতে পারিনি, সে পৃথিবী থেকেই চলে গেছে।” এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নাটোর জেলা কারাগারের জেলার মো. মোশফিকুর রহমান বলেন, সোহেল ২৯ নভেম্বর সন্ধ্যায় স্ট্রোক করলে প্রথমে নাটোর সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার ডাক্তাররা তাঁকে রাজশাহী মেডিকেলে পাঠান। সেখানে তার মৃত্যু হয়।

এর আগে গত ১ ডিসেম্বর গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২-এ গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান হীরা খান (৪৫) মারা যান। কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে চট্টগ্রাম মহানগরের মোহরা ওয়ার্ড বিএনপির সহ-সভাপতি গোলাপুর রহমান (৬৩) মারা যান তার আগে ২৭ নভেম্বর । তিনি ২৮ অক্টোবর ঢাকায় নয়াপল্টনে বিএনপির সমাবেশে যোগ দিতে এসে গ্রেপ্তার হন। কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২-এর জ্যেষ্ঠ জেল সুপার আমিরুল ইসলাম জানান, ২৭ নভেম্বর সকালে গোলাপের বুকে ব্যথা শুরু হলে তাঁকে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং দুপুর সাড়ে ১২টায় চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

বিএনপির অভিযোগ, ২৪ নভেম্বর ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ওয়ারী থানাধীন ৩৯ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি নেতা ইমতিয়াজ আহমেদ বুলবুলকে অসুস্থ অবস্থায় গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠায় পুলিশ। ৩০ নভেম্বর অসুস্থ অবস্থায় পুলিশ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ইশরাক হোসেন বলেন, ইমতিয়াজকে ২৪ অক্টোবর গ্রেফতারের পর ওয়ারী পুলিশ নির্যাতন করেছে। তার পরিবারের সদস্যদের তাকে জেলে দেখতে দেওয়া হয়নি, এমনকি পুলিশও নিহতের পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করেনি; বরং পুলিশের নিরাপত্তায় ইমতিয়াজকে সমাহিত করা হয়। সম্প্রতি বদলি হওয়া ওয়ারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুস্তাজিজুর রহমান জানান, অক্টোবরে সহিংসতার মামলায় ইমতিয়াজকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা।

সম্প্রতি জেল হেফাজতে মারা যাওয়া বিএনপির লোকজনের পরিবার বলেছে, কারাগারে পাঠানোর আগে ক্ষতিগ্রস্তদের কোনো বড় ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা ছিল না এবং গ্রেপ্তারের পর তাদের হেফাজতে নির্যাতন করা হয়েছে বলে অভিযোগ। গত শনিবার ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী অভিযোগ করে বলেন, কারাগারগুলোতে বিএনপির নেতা-কর্মীদের স্বাভাবিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার হচ্ছে না। এমনকি তাদের সেল থেকে বের হতে দেওয়া হচ্ছে না।

তিনি বলেন, বন্দীদের স্বজনদের বিএনপির লোকজনের সঙ্গে দেখা করতে, প্রয়োজনীয় পোশাক দিতে, এমনকি মোবাইল ফোনে কথা বলতে দেওয়া হয় না। মন্তব্যের জন্য কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এএসএম আনিসুল হককে ফোন করা হলে তিনি মিটিংয়ে আছেন বলে জানান তার আফিস সহকারী।

জেল হেফাজতে মৃত্যুর বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সম্প্রতি বলেছেন, জেল হেফাজতে মৃত্যুর কোনো অভিযোগ তিনি পাননি। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, কারাগারে ক্রমবর্ধমান মৃত্যুর সংখ্যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। শাসক মহলের সমালোচনাকারী রাজনীতিবিদরা কারাগারে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ। সরকারকে এই ধরনের ঘটনা সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে এবং মৃত্যুর তদন্ত শুরু করতে হবে। কারন কারাগারগুলো অন্যতম নিরাপদ স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়।