জেলা প্রতিনিধি, মৌলভীবাজার:
মুরইছড়া নদী। এটি মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার দক্ষিণ পূর্ব সীমান্তবর্তী কর্মধা ও পৃথিমপাশা ইউনিয়নের মধ্যে দিয়ে ভারত-বাংলাদেশের আর্ন্তজাতিক সীমানা নির্ধারণকারী একটি পাহাড়ি নদী। কর্মধা ইউনিয়নের ষাড়েরগজ পাহাড়ের ভিতরে অবস্থিত নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক ঝর্ণা হলো মুরইছড়া ঝর্ণা। উজানে ভারতের পাহাড় থেকে ১৮৪২ সীমানা পিলার এলাকা দিয়ে নেমে আসা জলধারা মিলিত হয়েছে বড় কালাইগিড়ি পাহাড়ের পশ্চিম পাদদেশের লুথিটিলায় অবস্থিত মুরইছড়া ঝর্ণায়। লুথি পাহাড়ের টিলায় অবস্থিত মুরইছড়া ঝর্ণা ও উজানের পাহাড়ি জলধারা নেমে এসেছে মুরইছড়া নদী দিয়ে।
ভারত-বাংলাদেশ সীমানা নির্ধারণকারী মুরইছড়া নদীটি পাহাড় থেকে নেমে এওলাছড়া পুঞ্জি হয়ে সমতলের মুরইছড়া নতুন বস্তি, শিকড়িয়া, কমলা টিলার ডেমা বিল হয়ে আলীনগরের বেলরতল এলাকা দিয়ে মনু নদীতে গিয়ে মিলিত হয়েছে। মনু নদীর বেলরতল পয়েন্ট থেকে ষাড়েরগজ পাহাড়ের লুথি টিলার উৎপত্তিস্থল পর্যন্ত প্রায় ১০-১২ কিলোমিটারের আঁকাবাকা বহমান সীমান্তবর্তী মুরইছড়া নদী আংশিক বিলুপ্ত। এ নদীর উৎপত্তিস্থল কর্মধা ইউনিয়নের লুথি টিলা থেকে এওলাছড়া পুঞ্জি পর্যন্ত গড়ে ১০-১২ ফুট প্রস্ত থাকলেও নিম্নাঞ্চলের সমতল এলাকা মুরইছড়া নতুন বস্তি, শিকড়িয়া, কমলা টিলা থেকে আলীনগর বেলরতল মনু নদী পর্যন্ত বহমান অংশের বেশিরভাগ স্থানে বিলুপ্ত হয়েছে মুরইছড়া নদীটি।
সম্প্রতি নদী দিবস উপলক্ষে নদী, জলভূমি ও প্রাণী সম্পদ বিষয়ক স্বেছাসেবী সংগটন রিভারাইন পিপলের প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য মতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দাপ্তরিকভাবে স্বীকৃত ৫৪ টি আন্তঃসীমান্ত নদীর বাইরেও এ পর্যন্ত আরো ৬৯টি নদী চিহ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে কুলাউড়ার সীমান্তবর্তী মুরইছড়া নদীটিও একটি হারিয়ে যাওয়া নদী। দেশ স্বাধীনের আগে ভরা যৌবন থাকলেও কালের বিবর্তনে আজ নদীটি বিলুপ্তির পথে।
জানা যায়, মুরইছড়া ঝর্ণা ও মুরইছড়া নদীর নামেই ওই এলাকার নামকরণ হয় মুরইছড়া। পর্যটন বিকাশে এই মুরইছড়া ঝর্ণাকে কেন্দ্র করে সরকার ২০০১ সালে মুরইছড়া ইকো পার্ক প্রকল্পের ভিত্তি প্রস্থর স্থাপন করলেও আজও আলোর মুখ দেখেনি মুরইছড়া ইকো পার্ক প্রকল্পটি। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রেকর্ডে গড়ে ১২-১৬ ফুট প্রস্থ থাকলেও ভরাটসহ নানা কারণে কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে মুরইছড়া নদীটি।
সরেজমিনে স্থানীয়দের সাথে আলাপকালে জানা যায়, হারারগজ পাহাড় থেকে মুরইছড়া নদীর সাথে উপড়িছড়া, উগারছড়া, এওলাছড়াসহ কয়েকটি পাহাড়ি ছড়া পৃথিমপাশা ইউনিয়নের আলীনগরের কমলা টিলা এলাকায় অবস্থিত ডেমা বিলে গিয়ে মিলিত হয়েছে। ডেমা বিল থেকে দুই কিলোমিটার পশ্চিমে মনু নদীর বেলরতলে মিলিত হয়েছে পাহাড়ি মুরইছড়া নদী। সেচ প্রকল্প ও বোরো ধান চাষাবদের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড ১৯৮২ সালে আলীনগর গ্রামের ডেমা বিলের পশ্চিম পাশে মনু নদীর সাথে সংযুক্ত মুরইছড়া নদীতে একটি সুইচ গেইট নির্মাণ করে। কালের বিবর্তনে সমতলের বিভিন্ন এলাকায় নদীর খনন না করায় মুরইছড়া নদীটি ভরাট হয়ে আজ বিলুপ্তের পথে। কোথাও কোথাও নদীটি ২-৪ ফুট প্রস্থ থাকলেও পাহাড়ি এলাকায় এখনও ১০-১২ ফুট প্রস্থ বিদ্যমান রয়েছে। বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ি ছড়াগুলোসহ মুরইছড়া নদীতে বৃদ্ধি পাওয়া পানিতে সমতলের ফসলাদি ডুবিয়ে দেয় আর শুকনো মৌসুমে পানি না থাকায় মরা নদীতে পরিণত হয় নদীটি। মনু নদীর বেলরতল থেকে হারারগজের লুথিটিলা পর্যন্ত আঁকাবাকা পাহাড়ি মুরইছড়া নদীটি সীমানা পিলার ঘেষে বয়ে গেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা কৃষক আব্দুল আহাদ, কয়ছর আলী, সোহেল আহমদ জানান, মুরইছড়া নদী খনন করে মনু নদী থেকে সুইচ গেইটের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করলে সারা বছর আমরা কৃষিসহ বিভিন্ন ফসলি জমি চাষাবাদ করতে পারতাম। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষন করছি।
স্থানীয় আমিন নাজিম উদ্দিন বাবুল বলেন, মুরইছড়া নদীটি পাহাড় থেকে এসে সমতলে মনু নদীতে মিলিত হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় শাখা নদীর সাথে মিলিত হয়। রেকর্ডে নদীটি ১৫-১৬ ফুট প্রস্থ রয়েছে এবং এটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১০-১২ কিলোমিটার।
কর্মধা ইউনিয়নের ইউপি সদস্য সিলভাস্টার পাঠাং বলেন, মুরইছড়া নদীকে স্থানীয়ভাবে উপলিয়াছড়া বলা হয়। কারণ পাহাড়ি এই ছড়াটির বাঁধ না থাকায় বর্ষার মৌসুমে পানি আশেপাশে উপচে পড়ে। খাসিয়া, গারো, চা বাগান শ্রমিকরা এই নদীর পানি নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করে থাকেন। নদীর পানি দিয়ে পাহাড়ে পান জুমসহ অন্যান্য কৃষি কাজ করা হয়। শুকনা মৌসুমে এই নদীর পানি শুকিয়ে যায়।
পৃথিমপাশা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান কমরেড আব্দুল লতিফ বলেন, দীর্ঘদিন থেকে খনন না করায় মুরইছড়া নদীটি একটি মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় কৃষকরা মনু নদী থেকে মুরইছড়া নদী দিয়ে পানি সরবরাহ করে বোরো ধানসহ অন্যান্য চাষাবাদ করতে পারতেন সুইচ গেইট সংস্কার ও নদী খননের মাধ্যমে।
কর্মধা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুহিবুল ইসলাম আজাদ বলেন, পাহাড় থেকে মুরইছড়া নদীসহ কয়েকটি ছড়া নেমে এসেছে সমতলে। ছড়া ও নদীগুলোতে খনন করে বাঁধ নির্মাণ করলে আশেপাশের মানুষের উপকার হতো।
এ বিষয়ে মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ জাবেদ ইকবাল বলেন, কালের বিবর্তনে অনেক নদী হারিয়ে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড মনু নদী থেকে মুরইছড়া নদীর সংযোগস্থলের ডেমা বিল নামক এলাকায় ১৯৮২-৮৩ অর্থবছরে একটি সুইচ গেইট নির্মাণ করে। সরেজমিন পরিদর্শন করে কৃষি কাজের সুবিধার জন্য প্রয়োজনে আরো সুইচ গেইট নির্মাণ ও নদী খননের বিষয়ে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করব।
আরও পড়ুন
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি