September 25, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Thursday, July 20th, 2023, 3:33 pm

কালের সাক্ষী জীবন্ত পৃথিমপাশার জমিদার বাড়ি

মো: মছব্বির আলী, মৌলভীবাজার:

চকচকে দালান মসজিদ আর ইমামবাড়া। বিশাল দিঘীতে শান বাধানো ঘাট। আন্দরমহলে প্রবেশ করলে প্রাসাদগুলোতে ফুঠে উঠছে কোথায় পারস্যে, কোথায় মুঘল, বৃটিশ আমলের দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যকীর্তি। জমিদারী প্রথা না থাকলেও পূর্ব সিলেটের তৎকালীন জমিদার নবাব আলী আমজাদ খাঁনের ঐতিহাসিক জমিদার বাড়িটি আজও দেশের মধ্যে কালের জীবন্ত সাক্ষী হয়ে আছে। ৩৫ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত পৃথিমপাশা জমিদারবাড়ি আজও সাজানো-গোছানো। মৌলভীবাজার জেলা সদর থেকে প্রায় ৪৭ কিলোমিটার পূর্বে পৃথিমপাশা জমিদার বাড়ির অবস্থান। পঞ্চদশ শতাব্দীতে সুদূর পারস্যে থেকে ধর্মপ্রচারের জন্য এই অঞ্চলে আগমন ঘটলেও ধর্মীয় প্রচার, জমিদারী, সমাজসেবা, শিক্ষার প্রসার, কখনো জনপ্রতিনিধি অনেক কিছুই রয়েছে জমিদার বাড়ির ঐতিহ্যকে ঘিরে। জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হলেও মানুষের কল্যাণে কাজ করে মন্ত্রী থেকে শুরু করে এমপি ও চেয়ারম্যানসহ নানা পদে বিচরণ ছিল নবাব পরিবারের উত্তরসূরিদের। নবাব আলী আমজাদ খাঁনের উত্তরসূরিরাই বাড়িটি দেখাশোনা করেন।

জমিদার বাড়ির ঐতিহ্য: জমিদার বাড়ির ঐতিহ্য ধরে রাখতে নবাব আলী আমজাদ খাঁন মৌলভীবাজার ও কুলাউড়ায় বিভিন্ন স্কুল-কলেজ এবং সুপেয় পানির জন্য দীঘি খনন করেন। জমিদার বাড়ির চিত্র চোখের সামনে ফুটে উঠতেই মনে হয় অনেক অনেক দিন আগের ভাঙাচোরা পলেস্তার খসে যাওয়া দেওয়াল, কোনো লোকের বসবাস নেই, দেওয়ালের গা বেয়ে গজিয়ে উঠেছে বটগাছ ইত্যাদি। কিন্তু পৃথিমপাশা জমিদার বাড়ি পুরানো হলেও আজও অবধি বাড়িটি সাজানো গোছানো রয়েছে। প্রায় তিনশত বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে গৌরবের সাথে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে পৃথিমপাশা জমিদার বাড়ি (নবাব বাড়ি)। বাড়ির কারুকার্যময় আসবাবপত্র, মসজিদের ফুলেল নকশা, ইমামবাড়া, সুবিশাল দীঘি যেকোনো ভ্রমণপিপাসুকে আকৃষ্ট করতে যথেষ্ট। তবে জমিদার বাড়ির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে এখানকার ইমামবাড়া। জমিদারের পাশাপাশি এতদ অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে পৃথিমপাশার নবাববাড়ি। বর্তমানে হোছেনী দালান মসজিদ এবং বড় একটা দিঘী অবস্থিত। জমিদার বাড়ীতে হাতীর পিলখানা, বাঘ, হরীণ, ময়ূর ইত্যাদি ছিল।

জমিদারদের ইতিহাস: ১৪৯৯ সালে মোগল সম্রাট আকবরের সময়কালে ইরান থেকে ধর্ম প্রচারের জন্য ভারতবর্ষে আসেন সাকি সালামত খান। ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যেই তাঁর ছেলে ইসমাইল খান ১৫৫৬ সালে পৃথিমপাশায় আসেন। ইসমাইল খান ছিলেন উড়িষ্যার গভর্ণর। ইসমাইল খানের ছেলে শামসুদ্দিন খান। শামসুদ্দিন খানের ছেলে রবি খান। যার নামে ১৭৫৬ সালে রবিরবাজার প্রতিষ্ঠা করা হয়। রবি খাঁনের ছেলে আলী আহমদ খাঁন সিলেটের তৎকালীন কাজী (বিচারক) ছিলেন। নবাব আলী আহমদ খানের ছেলে নবাব আলী আমজাদ খাঁন। যিনি মাত্র ৩৪ বছর বয়সে মারা যান। পূর্ব বাংলার সময়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে মামলা করেন নবাব আলী আমজাদ খাঁন। ১৮৯৭ সালে গৌছ আলী খান পৃথিমপাশায় নবাবী লাভ করেন। গৌছ আলী খান হলেন সিলেটের তৎকালীন কাজী আলী আহমদ খান। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের সময় গৌছ আলী খানের সময়কালে চট্টগ্রাম থেকে অস্ত্র লুণ্ঠন করে বড়লেখা শাহবাজপুর যাবার পথে পৃথিমপাশায় আশ্রয় নেন সিপাহীরা। সে সময় সিপাহীদের আশ্রয় দেবার কারণে নবাব গৌছ আলী খানের উপর ব্রিটিশরা রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা করেন। বৃটিশদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় বৃটিশরা গৌছ আলী খানকে ফাঁসি দেবার চেষ্ঠায় লিপ্ত হয়। কিন্তু সেই সময় সিলেট থেকে পৃথিমপাশা পর্যন্ত মানুষের লাইন পড়ে। বিচারক তখন গৌছ আলী খানের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দেখে শাস্তি হিসেবে ফাঁসি না দিয়ে জরিমানা করেন।

খ্যাতিমান জমিদার নবাব আলী আমজাদ খানের দুই উত্তরাধিকারী হলেন নবাব আলী হায়দর খান ও নবাব আলী আজগর খান। আলী হায়দর খান আসাম রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী ছিলেন। নবাব আলী আজগর খান ১৯৪৬ সালে মুসলিমলীগের দিল্লী কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে এমএলএ নির্বাচিত হন। নবাব আলী হায়দর খানের দুই উত্তরাধিকারী হচ্ছেন নবাব আলী ছফদর খান (রাজা সাহেব) ও নবাব আলী সারওয়ার খান (চুন্নু নবাব)। নবাব আলী ছফদর খান আওয়ামী মুসলিম লীগ দিয়ে রাজনীতি শুরু করেন। তিনি তৎকালীন মৌলভীবাজার মহকুমা আওয়ামীলীগের সভাপতি ছিলেন। এরপর আ’লীগ ভেঙ্গে গেলে ন্যাপ গঠন হলে তিনি মাওলানা ভাসানীর সাথে ন্যাপের রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৬৫-৬৬ সালে কুলাউড়ার লস্করপুরে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক পূর্ব-পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের কৃষক সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সভাপতিও ছিলেন। ১৯৭৩ সালে সংসদে ভাসানীর নেতৃত্বে ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ন্যাপের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ছিলেন এবং জমিদার ঘরে জন্ম নিয়েও জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত আন্দোলনে মাওলানা ভাসানীর সাথে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।

জমিদার পরিবার থেকে যারা জনপ্রতিনিধি ছিলেন: ভারতবর্ষে আসাম প্রদেশের কৃষিমন্ত্রী ছিলেন নবাব আলী হায়দর খান। নবাব আলী আজগরের পুত্র নবাব আলী ইয়াহর খান পৃথিমপাশা ইউনিয়ন পরিষদের প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন। এরপর নবাব আলী হায়দর খানের পুত্র নবাব আলী ছফদর খান স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম (১৯৬৫ সাল) পৃথিমপাশা ইউপির চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়া ১৯৭০ এবং ১৯৭৩ সালে এমপি নির্বাচিত হন নবাব আলী হায়দরের কনিষ্ঠ পুত্র নবাব আলী সারওয়ার খান। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান প্রণেতা কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন। এরপর নবাব পরিবার থেকে তিন বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন নবাব আলী ছফদর খানের উত্তরসূরি নবাব আলী আব্বাছ খান। তিনি ১৯৮৮ সালে চতুর্থ সংসদ, ১৯৯১ সালে পঞ্চম সংসদ ও ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদে এমপি নির্বাচিত হয়ে কুলাউড়ায় চমক দেখান। তাছাড়া নবাব আলী আব্বাছ খানের ভ্রাতা নবাব আলী নকী খান দুইবার ও নবাব আলী বাকর খান একবার পৃথিমপাশা ইউপির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।

 

 

 

যেভাবে পৃথিমপাশায় আগমন: সম্রাট আকবর ও সম্রাট দাউদ শাহের মধ্যেকার যুদ্ধে দাউদ শাহের পতনের পর ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে ইসমাইল খান ওরফে খান জাহান আলীর নেতৃত্বে ধর্ম প্রচারের জন্য পৃথিমপাশায় আগমন ঘটে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, এলাকাটি এক সময় ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।