November 17, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Monday, March 14th, 2022, 9:13 pm

কিছুতেই সুরক্ষিত হচ্ছে না দেশের রেলক্রসিংগুলো

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

রেলওয়ের তথ্যমতে, দেশে ২০১৪ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১ হাজার ১৯৯টি রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। সেসব দুর্ঘটনায় ২০৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে রেলগেটে সংঘটিত দুর্ঘটনাতেই মৃত্যু হয়েছে১৬৫ জনের। আর রেল ক্রসিংয়ে এসব মৃত্যু বেশিরভাগই অসচেতনতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে। জানা গেছে, রেলের অনুমোদিত ১ হাজার ৪৬৮টি লেভেল ক্রসিংয়ের ৯০৪টিতেই নেই গেটম্যান। এর বাইরেও এক হাজার ৩২১টি অবৈধ লেভেল ক্রসিং বিভিন্ন সংস্থা তাদের ইচ্ছেমতো বানিয়েছে। এসব অরক্ষিত ক্রসিংয়ের কারণে প্রতিনিয়তই ঝরছে প্রাণ। মূলত ট্রেনের সঙ্গে যাত্রীবাহী পরিবহনের সংঘর্ষ, লেভেল ক্রসিংয়ের সিগন্যাল না মানা, জনবল কম থাকায় সময়মতো গেট ফেলতে না পারাসহ নানান কারণে প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে রেলপথ আছে ২ হাজার ৯৫৫ কিলোমিটার। এই রেলপথের ওপর দিয়ে কোথাও কোথাও সড়ক চলে গেছে। রেল আর সড়কের এই সংযোগস্থলকেই লেভেল ক্রসিং বলা হয়। দেশে কম-বেশি লেভেল ক্রসিং আছে আড়াই হাজার। এগুলোকে বৈধ-অবৈধ, পাহারাদার আছে (ম্যানড), পাহারাদার নেই (আনম্যানড)-এভাবে শ্রেণীবিন্যাস করে রেল কর্তৃপক্ষ। যেসব ক্রসিংয়ে পাহারাদার আছেন, সেগুলোতে লোহার প্রতিবন্ধক থাকে। পাহারাদার ট্রেন আসার সংকেত পেয়ে প্রতিবন্ধক নামিয়ে অন্য যানবাহনের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করেন। ফলে পাহারাদার ভুল না করলে যানবাহনের সঙ্গে ট্রেনের সংঘর্ষ হওয়ার সুযোগ নেই। পাহারাদার ও প্রতিবন্ধক থাকা রেলক্রসিংয়ে তাই দুর্ঘটনাও খুব কম। পাহারাদার নেই এমন ক্রসিং অরক্ষিত। বর্তমানে রেলে ১ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প চলমান। এর মধ্যে লেভেল ক্রসিং উন্নয়নে প্রকল্প আছে মাত্র ১০০ কোটি টাকার। প্রকল্পটির মেয়াদও শেষ। ক্রসিংয়ে পাহারাদার হিসেবে যাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছিল, তাদের অনেকেই চাকরি ছেড়ে চলে যেতে শুরু করেছেন। রেলের উচ্চপর্যায়ের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, রেল কর্তৃপক্ষের মধ্যে এমন একটা ধারণা জন্মেছে যে রেলক্রসিংয়ে যানবাহন চাপা পড়ে প্রাণহানির দায় তাদের নয়। কারণ বেশির ভাগ সংস্থা সড়ক নির্মাণের সময় তাদের অনুমতি নেয়নি। অথচ রেলের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে নির্মাণ করা বৈধ রেলক্রসিংয়ের ৬১ দশমিক ৫৮ শতাংশই অরক্ষিত। রেলক্রসিং পারাপারের সময় যেসব পথচারী প্রাণ হারান, সেই হিসাব রেল কর্তৃপক্ষ প্রায়শই সংরক্ষণ করে না। জানা গেছে, রেলে এ পর্যন্ত যে বিপুল বিনিয়োগ হয়েছে এবং চলমান যে বরাদ্দ আছে, এর ১ শতাংশের কম বিনিয়োগ করলেও রেলপথ নিরাপদ হয়ে যায়। মানুষের চাহিদার প্রয়োজনে সড়ক ও জনপথ অধিদফতর (সওজ) ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি), সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদসহ বিভিন্ন সংস্থা সড়ক নির্মাণ করেছে। ফলে রেলপথ সুরক্ষার লক্ষ্যে এই খাতে বিনিয়োগ হতেই পারে। কিন্তু রেলের কর্মকর্তাদের এসব প্রকল্পের দিকে মনোযোগ নেই। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) অসীম কুমার তালুকদার বলেন, প্রথম কথা হচ্ছে, প্রতিনিয়ত নিজেদের প্রয়োজনে ব্যক্তিপর্যায় থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধি কিংবা অন্যরা লেভেল ক্রসিং গেট সৃষ্টি করছে, যা অবৈধ। প্রতিনিয়ত এভাবে অবৈধ গেট সৃষ্টি হলে রাতারাতি সেখানে জনবল দেওয়া রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের সম্ভব না। অবৈধ লেভেল ক্রসিং যাতে তৈরি না হয় সে জন্য সবাইকে আন্তরিক হতে হবে। এদিকে যেসব কারণে রেলওয়ের দুর্ঘটনা ঘটছে তার মধ্যে মোবাইল ফোনে কথা বলা বা কানে হেডফোন দিয়ে গান শুনে শুনে রেললাইন দিয়ে হাঁটা। ঘনবসতি এলাকা দিয়ে ট্রেন চলাচলের সময় ট্রেনের হুইসেল শুনতে না পাওয়া। আঁকাবাঁকা পথে ট্রেন দেখতে না পাওয়া। ঝুঁকি নিয়ে ট্রেনের ছাদে ভ্রমণ করা। নেশাগ্রস্ত হয়ে রেললাইনে চলাচল অন্যতম। অরক্ষিত রেল ক্রসিং আর অসচেতনতায় ঢাকাসহ সারাদেশে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর মিছিল ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে। কেউ সেলফি তুলতে গিয়ে ট্রেনের ধাক্কায় মারা যাচ্ছেন। মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে রেললাইন দিয়ে হাঁটার সময় ট্রেনের নিচে প্রাণ যাচ্ছে অনেকের। আবার কেউ হেডফোনে গান শুনতে শুনতে ট্রেনে কাটা পড়ছেন। অসতর্কতাবশত হাঁটতে গিয়ে স্লিপারে পা পিছলে নিহতের ঘটনাও ঘটছে। সময় বাঁচানোর নামে জীবন বাজি রাখতে গিয়ে দুর্ঘটনার মুখে পড়ছেন। এভাবেও অনেকের প্রাণ গেছে। রেলওয়ের সূত্রে জানা গেছে, গত এক যুগে ছোট-বড় সব মিলে প্রায় সাড়ে আট হাজার দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনার পর ৮ হাজার তদন্ত কমিটি হয়েছে। সব কমিটিই প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। কিন্তু ৯০ ভাগ প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। কারণ হিসেবে রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, তদন্তের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়া প্রায় অসম্ভব। কেন না ঘটনার মূলে যারা বসে আছে, তারা সবাই হয় স্থানীয় রাজনীতিতে দলীয়ভাবে প্রভাবশালী না হয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন। এজন্য তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়লেও বাস্তবায়ন রিপোর্ট আলোর মুখ দেখতে পারে না। রেলের বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা, যাত্রী ভোগান্তি কিংবা দুর্ঘটনা তো কমেইনি বরং অভিযোগ অন্তহীন। রেল দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। কোনভাবেই যেন মৃত্যুর মিছিল ঠেকানো যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের লেভেল ক্রসিংগুলো বিজ্ঞানসম্মতভাবে করা হয়নি। নিয়ম অনুযায়ী, লেভেল ক্রসিং হবে রাস্তার সমান্তরাল। কিন্তু দেশের অধিকাংশ লেভেল ক্রসিং হয় উঁচু, নয়তো নিচু। যার কারণে লেভেল ক্রসিং অতিক্রম করার সময় যানবাহন ক্রসিংয়ে আটকে যায় নয়তো বন্ধ হয়ে যায়। ফলে অহরহ ঘটছে দুর্ঘটনা, প্রতিনিয়ত ক্রসিংয়ে ঝরে যাচ্ছে তাজা প্রাণ। তবে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোয় ‘ওভারপাস’ এবং ‘আন্ডারপাস’ তৈরি করা সম্ভব হলে দেশে লেভেল ক্রসিংয়ে মৃত্যুর মিছিল কিছুটা হলেও কমবে। পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. হাদিউজ্জামান বলছেন, রেলের অব্যবস্থাপনার মহাজটে দুর্ঘটনায় সীমাহীন ক্ষতি হচ্ছে রাষ্ট্রের। দুর্ঘটনায় যারা মারা যাচ্ছেন, তাদের বেশির ভাগ ৩০-৪০ বছর বয়সী। যারা আমাদের অর্থনীতিতে আরও অবদান রাখতে পারত। তিনি বলেন, শুধু যে যানবাহনের ক্ষতি হচ্ছে, তা নয়। লোকবল ও বগি বড় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এ ক্ষতিগুলো আমলে নিলে ৫-১০ হাজার কোটিতে গিয়ে ঠেকবে। ট্রেনের লেভেল ক্রসিং নিয়ন্ত্রণে আনতে সনাতন থেকে লাইনে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের পাশাপাশি জনবলের সক্ষমতা বাড়ানোর কথাও বলেন এ পরিবহন বিশেষজ্ঞ।