April 26, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Wednesday, June 22nd, 2022, 8:51 pm

কুলাউড়ায় রেল লাইনেও উঠছে বন্যার পানি, অর্ধ শতাধিক স্কুল কলেজ বন্ধ

এম. মছব্বির আলী, মৌলভীবাজার :
গত কয়েকদিনের প্রবল বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় হাকালুকি হাওরসহ ফানাই, গোগালী নদীতে বন্যার পানি হু হু করে দিন দিন বেড়েই চলছে। এতে কুলাউড়া পৌর শহরসহ উপজেলার ৮টি
ইউনিয়নের ৬৬টি গ্রামের অর্ধলক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বুধবার ভোরে উপজেলার বরমচাল ইউনিয়নের ফানাই-আনফানাই নদী এলাকায় ফানাই ব্রিজের মধ্যবর্তীস্থানে রেল সড়কে বন্যার পানি উঠেছে। এছাড়াও কুলাউড়া শহরতলী
এলাকার আশপাশেও কয়েকটি স্থানে পানি উঠতে শুরু করেছে। স্থানীয় বাসিন্দার জানান বরমচালের ফানাই-আনফানাই নদীর মধ্যবর্তী এলাকার ওই স্থানের প্রায় ২শ ফুট রেললাইনে সোমবার বিকেল থেকে পানি উঠতে শুরু করে। এখন সময় যতই যাচ্ছে
ততই বাড়ছে পানি। ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে ওই স্থানের রেললাইন। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান ওই স্থানে যে ভাবে বন্যার পানি বাড়ছে তাতে এখন গতি কমিয়ে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। তবে পানি বাড়তে থাকলে সারাদেশের সাথে সিলেট অঞ্চলের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয় বাসিন্দাসহ সংশ্লিষ্টরা। পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় উপজেলা দুর্যোগ
ব্যবস্থাপনা শাখা ইতোমধ্যে ৩৩টি আশ্রয় কেন্দ্র খুলেছেন। পানিবন্দি লোকজন গবাদিপশুসহ বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্র ও নিরাপদ আশ্রয়ে ঠাঁই নিচ্ছেন। বন্যার পানি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঢুকে পড়ায় উপজেলার ৫২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। উপজেলা পরিষদ ভবনের নিচতলায় পানি প্রবেশ করায় দাপ্তরিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে বেশ কয়েকটি কার্যালয়ের। গেল কয়েক দিন থেকে টানা ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে হাকালুকি হাওরের তীরবর্তী কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলার অধিকাংশ এলাকা বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। কম বেশি বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল এখনো
অব্যাহত থাকায় নতুন নতুন এলাকার ঘরবাড়িতে উঠছে পানি। প্লাবিত হচ্ছে বিভিন্ন এলাকা। বৃদ্ধি পাচ্ছে হাওরের পানি। এমতাবস্তায় রেললাইনের ওই স্থানসহ কুলাউড়ার বিভিন্ন স্থানের রেললাইনে পানি উঠায় নতুন করে দুশ্চিন্তায় ফেলছে স্থানীয় বাসিন্দাসহ রেল যাত্রী ও সংশ্লিষ্টদের। বরমচাল ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের সদস্য মো: সাজ্জাদ আলী সাজু ও মিজানুর রশিদ সুমন
জানান ফানাই-আনফানাই নদী এলাকায় ওই স্থানটিতে বন্যার পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
গতকালের তোলনায় পানি বুধবার দুপুর পর্যন্ত অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা বলেন এভাবে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে ওই স্থানটি দিয়ে ট্রেন চলাচল ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কুলাউড়া রেলওয়ে জংশন স্টেশনের সহকারী স্টেশন মাস্টার হরিপদ সরকার জানান, গেল ৩ দিন থেকে ওই স্থানটিতে বন্যার পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ওই স্থানে রেল লাইনের ১ ইঞ্চি উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
পানির রাতে কম থাকায় গতি কমিয়ে ট্রেন চলাচল অব্যাহত রয়েছে। তবে আর পানি রাতে বাড়লে ট্রেন চলাচল অব্যাহত রাখা যাবে কিনা তা আশঙ্কা রয়েছে। তিনি জানান রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগের সংশ্লিষ্টরা জায়গাটি পরিদর্শন করছেন।
তাদের পরামর্শনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে গেল কয়েক দিনের পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টি কারণে কুলাউড়া থেকে সমশেরনগর ও কুলাউড়া থেকে মাইজগাঁও পর্যন্ত গতি কমিয়ে ট্রেন চলাচলের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সরেজমিনে উপজেলার বন্যাকবলিত এলাকা ঘুরে ও উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, হাকালুকি হাওর তীরবর্তী উপজেলার কাদিপুর-ভূকশিমইল-বরমচাল আঞ্চলিক সড়ক, পুষাইনগর-নবাবগঞ্জ সড়কের বেশ কয়েকটি স্থানে দুই থেকে তিন ফুট পানি।
এসব এলাকার বেশিরভাগ বাড়িতে পানি ঢুকে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন মানুষ।
শনিবার সন্ধ্যা থেকে ঘরের ভিতর পানি প্রবেশ করায় অনেকেই বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্র ও অন্যত্র আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। অনেকে নিজেদের একমাত্র সম্বল গরু-ছাগল, হাঁস-মোরগ নিয়ে আশ্রয় নিচ্ছেন নিরাপদ স্থানে।
মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত প্রায় তিন শতাধিক মানুষ বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন।
উপজেলার কর্মধা, রাউৎগাঁও ও ব্রাহ্মণবাজার ইউনিয়ন দিয়ে প্রবাহিত ফানাই নদী ও জয়চন্ডী, কুলাউড়া সদর, পৌরসভা দিয়ে প্রবাহিত গোগালী নদীতে পাহাড়ি ঢলে নদী উপচে পানি কৃষি জমি এবং হাজার হাজার মানুষের বাড়ি প্লাবিত হয়ে
গেছে। শুক্রবার সন্ধ্যায় ফানাই নদীর কর্মধার মহিষমারা এলাকায় বাঁধ ভেঙে প্রায় ৫টি গ্রামের ফসলী জমি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। শনিবার পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় লোকজন বাঁধ মেরামত করলে রাতে আবার পানির রাতে বাঁধ ভেঙে ফের প্লাবিত হয় এলাকাগুলো। বন্যার পানিতে উপজেলার সাড়ে তিন হাজার হেক্টর ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। পানিবন্দি রয়েছে অর্ধলক্ষাধিক মানুষ।
এদিকে প্রবল বৃষ্টিতে শনিবার দুপুর থেকে পৌর শহরের ১, ৩ ও ৪ নং ওয়ার্ডের
বাসাবাড়ি ও উপজেলা পরিষদের ভবনের নিচতলায় পানি প্রবেশ করেছে। উপজেলা সড়কে প্রায় তিন ফুট পানি রয়েছে। রোববার বিকেল পর্যন্ত পানি আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।
পৌর এলাকার ১০ সহস্রাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়, উপজেলা হিসাবরক্ষণ কার্যালয়, এলজিইডি কার্যালয় এবং কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয়, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কার্যালয়ের সামনে পানি প্রবেশ করায় দাপ্তরিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
উপজেলার ৬৬টি গ্রামের প্রায় ৮০ হাজার মানুষ পানি বন্দি হয়ে পড়েছেন। এসব এলাকার সবকটি গ্রামীণ রাস্তা পানিতে তলিয়ে গেছে। উপজেলার ৪৪ টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৮টি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং দুটি কলেজে পাঠদান বন্ধ রয়েছে পানি প্রবেশ করায়। বন্যা পরিস্থিতি সামাল দিতে উপজেলা প্রশাসন ৮ ইউনিয়ন ও পৌর এলাকায় ৩৫টি আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছে। রেসকিউ টিম পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধার করে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে ৩ শতাধিক পরিবার ও গবাদি পশু আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি অধ্যক্ষ্ এ কে এম সফি আহমদ সলমান, প্রধানমন্ত্রীর প্রটোকল অফিসার
মোহাম্মদ আবু জাফর রাজু, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এটিএম ফরহাদ চৌধুরীর নেতৃত্বে কর্মকর্তারা বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্র ও পানি বন্দি এলাকা পরিদর্শন করছেন এবং ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রেখেছেন। পানিবন্দি মানুষকে ত্রাণ সহায়তা প্রদানের জন্য ইয়াকুব তাজুল মহিলা ডিগ্রি কলেজ, রাবেয়া আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভূকশিমইল ইউনিয়নের ভৈরবগঞ্জ বাজার, ভূকশিমইল স্কুল এন্ড কলেজ বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র, মির্জাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্রে প্রায় তিন শতাধিক মানুষের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া হাকালুকি হাওর তীরের সাদিপুর, ভূকশিমইল, ঘাটেরবাজার এলাকায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে পান্দিবন্দি মানুষের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ করেন। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি অধ্যক্ষ্ এ কে এম সফি আহমদ সলমান মঙ্গলবার সকাল থেকে রাত অবধি বন্যাকবলিত ভূকশিমইল
ইউনিয়নে। এই ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ ৬টি আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থিত প্রায় ১২০০ মানুষের মধ্যে তিনি ত্রাণ বিতরণ করেন। চিলারকান্দি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্র, কালেশার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্র, ভুকশিমইল স্কুল এন্ড কলেজ আশ্রয়কেন্দ্র, কাইরচক সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্র, গৌড়করন নুরুল আম্বিয়া দাখিল মাদ্রাসা
আশ্রয়কেন্দ্র ও ঘাটের বাজারে বন্যাদূর্গত পানিবন্ধি মানুষের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেন তিনি। ত্রাণসামগ্রীর মধ্যে ছিলো চিড়া, মুড়ি, গুড়, বিস্কুট, মোমবাতি, দেয়াশলাই, বিশুদ্ধ পানি, পানি বিশুদ্ধকরণ টেবলেট, খাবার স্যালাইন এবং জরুরী ঔষধ। এসয় উপস্থিত ছিলেন ভুকমিইল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান মনির, কুলাউড়া উপজেলা ছাত্রলীগ সভাপতি নিয়াজুল তায়েফ, সমাজসেবক আলী হায়দার সোহেল ও সাপ্তাহিক কুলাউড়ার ডাক পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি রাসেল আহমদ প্রমুখ।