March 29, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Tuesday, October 26th, 2021, 7:53 pm

কৃষি খাতের পূর্ণতা ও অপূর্ণতা

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

আজকের বাংলাদেশ কয়েক দশক আগে এমন ছিল না। এইতো পাঁচ দশক আগে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে অনেক বড় সংকট হয়ে দেখা দিয়েছিল খাদ্যনিরাপত্তার অভাব। সে সময় খাদ্যশস্যের উৎপাদনশীলতা ছিল অনেক কম। তবে এখন পুরোপুরি ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে। দেশের কৃষি খাত এখন অনেকটাই এগিয়েছে। শস্যের ফলনশীলতা বেড়েছে কয়েক গুণ। খাদ্য উৎপাদনও হয় বেশি। একই সঙ্গে এগিয়েছে শস্যের বহুমুখীকরণও। খাদ্যশস্যের বার্ষিক উৎপাদন এখন স্বাধীনতা-পরবর্তীকালের তুলনায় প্রায় চার গুণ বেশি। সাফল্য এসেছে ফল ও সবজি উৎপাদনেও। এ ক্ষেত্রে কৃষকের পাশাপাশি কৃতিত্বের দাবিদার কৃষিবিজ্ঞানী ও সম্প্রসারণকর্মীরা। এ সময়ে কৃষিতে সরকারি উদ্যোগের সঙ্গে এগিয়ে এসেছে বেসরকারি খাতও।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দেশের কৃষি খাতের সাফল্য ও অপূর্ণতার নানা দিক নিয়ে রোববার ‘বাংলাদেশের ৫০ বছর: কৃষির রূপান্তর ও অর্জন’ শীর্ষক সম্মেলনের আয়োজন করে বাংলাদেশ কৃষি সাংবাদিক ফোরাম (বিএজেএফ)। রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনের দুই অধিবেশনে জড়ো হন দেশের কৃষি গবেষণা, সম্প্রসারণ ও বিপণনসংশ্লিষ্টদের অনেকেই।
সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনে প্রধান অতিথি ছিলেন কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক। বিশেষ অতিথি ছিলেন ইউএসএআইডি বাংলাদেশের মিশন ডিরেক্টর ক্যাথরিন ডেভিস স্টিভেন্স ও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বাংলাদেশের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ রবার্ট ডি সিম্পসন।
দেশের কৃষি খাতের প্রতিটি ক্ষেত্রে উন্নতির কথা উল্লেখ করে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক বলেন, বাংলাদেশ এখন খাদ্যে অনেকটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ। ফলে কভিড-১৯ মহামারীর সময়ও বাংলাদেশে খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়নি
কৃষিমন্ত্রী বলেন, আমরা এখন গর্ব করে বলতে পারি, বাংলাদেশ খাদ্যে অনেকটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ। শুধু আমরা নই, পুরো পৃথিবীই এ কথা বলছে। করোনা মহামারীর সময়ও বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যের কষ্ট হয়নি, কোনো মানুষ না খেয়ে নেই। এখন বাংলাদেশকে পুষ্টিসমৃদ্ধ নিরাপদ খাদ্য দেয়াটাই বড় চ্যালেঞ্জ। এজন্য আমরা আধুনিক কৃষি ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে চাই। বাংলাদেশকে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের দিকে নিয়ে যেতে চাই।
বাংলাদেশের মানুষ অনেক বেশি চাল বা ভাত ভোগ করে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা একেকজন মানুষ প্রতিদিন প্রায় ৪০০ গ্রাম চাল খায়। পৃথিবীর অনেক দেশে এ পরিমাণ ২০০ গ্রামও নয়। আমরা যদি ভাত খাওয়া কিছুটা কমাতে পারি, তাহলে নিজস্ব উৎপাদন দিয়েই প্রয়োজন মেটানো যাবে।
দেশে কৃষি খাতের অবদান তুলে ধরে আবদুর রাজ্জাক বলেন, কৃষি সব সময় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটা বিরাট জায়গাজুড়ে ছিল। কৃষির গুরুত্ব কখনই কমবে না। দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে কৃষিকে গুরুত্ব দিতেই হবে।
কৃষি উদ্ভাবনে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের সফলতার কথা উল্লেখ করেন কৃষিমন্ত্রী। তিনি বলেন, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা অমৃতা প্রজাতির আম উদ্ভাবন করেছেন, যার স্বাদ মোটামুটি ভালো। এর আগে উদ্ভাবন হয়েছে গোরমতি, সেটার স্বাদ হিমসাগর বা অন্যান্য দেশী আমের মতোই। এখন দেশে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে আম পাওয়া যাচ্ছে। কেবল আম নয়, আমরা কৃষির অনেক ক্ষেত্রেই চাষের মৌসুম বাড়াচ্ছি, এটা আমাদের অর্জন।
বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে বাংলাদেশ গত নয় বছরে ২৫ ভাগ এগিয়েছে উল্লেখ করে কৃষিমন্ত্রী বলেন, প্রতিবেশী দুই দেশ পাকিস্তান ও ভারতের চেয়ে এ সূচকে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে আছে। খাদ্যনিরাপত্তার এটিও একটি ভালো নির্দেশক। এর অর্থ হলো আমাদের দেশের মানুষ, শিশুরা ভালো খাবার পাচ্ছে। এ ধারা আমরা অব্যাহত রাখতে চাই। সেজন্য সব ধরনের পদক্ষেপও নিচ্ছে সরকার।
অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি ইউএসএআইডি বাংলাদেশের মিশন ডিরেক্টর ক্যাথরিন ডেভিস স্টিভেন্স বলেন, গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। এ পথচলায় সহযাত্রী হতে পেরে ইউএসএআইডি ও যুক্তরাষ্ট্র সরকার আনন্দিত। বাংলাদেশের কৃষি গবেষণার উন্নয়নেও অংশীদার হতে পেরেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত পাঁচ দশকে ইউএসএআইডি এ দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে খাদ্যসহায়তা, মানসম্পন্ন্ন বীজ উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণে সাহায্য করেছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটকে সূচনালগ্ন থেকে গবেষণায় সহায়তা করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সহযোগিতায় বাংলাদেশে গম গবেষণা বিকশিত হয়েছে। গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট এখন স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা হিসেবে এ দুটি পণ্য উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতা আরো বাড়াতে চায় উল্লেখ করে ক্যাথরিন ডেভিস বলেন, কৃষিতে প্রযুক্তিনির্ভরতা জোরদার করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সরকার প্রতি বছর বাংলাদেশের কৃষি খাতে ৫ কোটি ডলার বিনিয়োগ করে। সরকার, কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, বেসরকারি খাত ও কৃষকদের একসঙ্গে নিয়ে কাজের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিভিন্ন ফসল উৎপাদন করতে সক্ষম হবে বলে আমাদের প্রত্যাশা। এতে সারা দেশের মানুষের খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। গত বছর আমরা সাড়ে ছয় লাখ কৃষককে ২০ কোটি ডলার সহায়তা দিয়েছি। বাংলাদেশের কৃষির উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার এ ধারা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।
অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি এফএও বাংলাদেশের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ রবার্ট ডি সিম্পসন তার বক্তব্যে বলেন, সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে বাংলাদেশ কৃষিতে আমূল উন্নতি করেছে। বাংলাদেশের জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান কৃষির উন্নয়নকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এ পাঁচ দশকে বাংলাদেশ কৃষিতে উন্নয়নের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছে। এ সময়ের মধ্যে এফএও বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে খাদ্য ও পুষ্টি নিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি ও প্রকল্পে কাজ করেছে। কৃষিকাজে বাংলাদেশে প্রযুক্তির উন্নত ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ প্রয়োজনীয় উৎপাদনে সক্ষম হয়েছে।
অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন এসিআই এগ্রিবিজনেসেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. এফএইচ আনসারী। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জিডিপিতে কৃষির অবদান গত ১০ বছরে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। দেশের কৃষিক্ষেত্রে বর্তমানে বেসরকারি খাত উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। কৃষিক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের এ অবদান অব্যাহত রাখতে এ খাতের অংশগ্রহণ আরো বাড়াতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ছে। ফলে কৃষিতে ক্ষতির পরিমাণও বাড়বে। এ ক্ষতি কমাতে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর। মূল প্রবন্ধে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ভঙ্গুর কৃষি ব্যবস্থাপনা থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ কৃষিতে উত্তরণের ক্রমধারা তুলে ধরে বলা হয়, খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টির নিশ্চয়তা নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে। পাহাড়ি এলাকায় কৃষিক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধির জন্য কর্মসূচি চলমান রয়েছে।
উল্লেখ্য, উদ্বোধনী অধিবেশনে আরো বক্তব্য রাখেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক মো. হামিদুর রহমান। সমাপনী অধিবেশনের মাধ্যমে শেষ হয় দিনব্যাপী এ সম্মেলন।