November 17, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Monday, October 9th, 2023, 3:03 pm

ক্বিনব্রিজ সংস্কার কাজের সময় বর্ধিত

জেলা প্রতিনিধি, সিলেট :

সিলেটের ঐতিহ্যবাহী ক্বিনব্রিজের চলমান সংস্কার কাজ শেষ করে চলতি মাসের ১৫ তারিখ খুলে দেয়ার কথা ছিলো। দুই মাসে কাজ সম্পূর্ণ না হওয়ায় লোকবল দ্বিগুণ করে সময় আরো ১৫দিন বর্ধিত করা হয়েছে। আগামী নভেম্বরের আগে জনসাধারণের জন্য ব্রিজ খুলছে না বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

ব্রিটিশ আমলে নির্মিত লোহার এই ব্রিজটি মুক্তিযুদ্ধকালে উত্তর অংশ ভেঙ্গে পড়লে স্বাধীনতার পর প্রথমবার মেরামত করা হয়। তার পর বেশ কয়েকবার বেশি ক্ষতিগ্রস্ত অংশ সংস্কার করা হয়। কেটে বাদ দেয়া হয় ব্রিজের মধ্যভাগের দুইপাশে দাঁড়ানোর স্থান। বিগত করোনার আগে একটি বেসরকারি টেলিকম কোম্পানি ব্রিজের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য বাহারি আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করে। ফলে পর্যটকদের কাছে আরো আকর্ষণীয় হয়ে উঠে ব্রিজটি। সিলেটে আসা পর্যটকরাও ব্রিজটি পরিদর্শন করে ভ্রমণের পূর্ণতা নিয়ে ফিরেন।

সিলেটবাসীর ঐতিহ্য প্রাচীনতম ব্রিজটি টিকিয়ে রাখতে সরকারি অর্থায়নে আবারো সংস্কার কাজের উদ্যোগ নেয়া হয়। গত ১৬ আগস্ট থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত দুই মাস ব্রিজ ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে নোটিশ লাগিয়ে দেয় রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল প্রকৌশল বিভাগ। ১৭ আগস্ট থেকে রেলওয়ের সেতু বিভাগ ব্রিজের সংস্কার কাজ শুরু করে। শুরুতে কম লোকবল, বৃষ্টি ও বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কারনে কাজ ধীরগতিতে চললেও বর্তমানে লোকবল দ্বিগুণ করে চলছে শেষ পর্যায়ের কাজ।

সোমবার (০৯ অক্টোবর) ব্রিজ পরিদর্শনকালে দেখা যায় তিনভাগে বিভক্ত হয়ে কাজ করছে শ্রমিকরা। ব্রিজ নির্মাণের পর এবারই প্রথম ক্ষতিগ্রস্ত পাটাতন (ডেই প্লেট) ও লোহার বড় স্পাত (জয়েছ) বদল করছে শ্রমিকরা। ক্বিনব্রিজের উত্তর প্রান্ত অত্যাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সেখানে কাজ বেশি হতে দেখা যায়। পাটাতনের ওপর নির্মিতি কংক্রিটের ঢালাই ৪টি ইলেকট্রিক হাইড্রোলিক ড্রিল দিয়ে ভাঙ্গার কাজ করছিল শ্রমিকদের একটি দল। মরিচা ধরা ১০ ফিট লম্বা ও সাড়ে ৩ ফিট চওড়া ১০ মিলির টেউ প্লেট বা পাটাতন বদল করার কাজ করছিলো আরেকটি দল। তারা গতকাল পর্যন্ত ৬০টি টেউ প্লেট স্থাপন করে। আরো প্রায় ৪০টি টেউ প্লেট স্থাপনের কাজ চলছে। টেউ প্লেটগুলোর জোড়ায় ৩২টি জয়েছ যুক্ত করা হয়েছে। আরো ২৮টি জয়েছ যুক্ত করা হবে। যার প্রত্যেকটার ওজন ৫০০ কেজি মত বলে জানিয়েন শ্রমিকরা।

আরো দেখা যায়, শ্রমিকদের বড় একটি দল সম্পূর্ণ ব্রিজের পুরাতন রং মেশিনের সাহায্যে তোলে পরিষ্কার করে সৌন্দর্যবর্ধন ও মরিচা প্রতিরোধে মেরুন কালারের রং লাগাতে ব্যস্ত থাকে। কাজের তদারককারী সুমন আহমদ জানান, পুরা ব্রিজ একবার রং করার পর ফাইনালি দ্বিতীয়বার করা হচ্ছে। হিসেবের চেয়ে বেশি স্পাত লাগায় ব্যয়ভার আরো বাড়তে পারে বলে তিনি মনে করেন।

পাটাতনের ভাঙ্গা অংশের সাথে আরো কিছু অংশ তোলে সিলেট সড়ক ও জনপদ (সওজ) কর্তৃপক্ষ পুনরায় ঢালাই দিয়ে চলাচলের উপযোগী করে তুলবে বলে জানা গেছে। তার পর ব্রিজ ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। তবে পূর্ণাঙ্গ কাজ শেষ হতে আরো কয়েক মাস লাগবে।

জানা যায়, এই বার ক্বিনব্রিজের সংস্কার কাজের দায়িত্ব পায় রেলওয়ে বিভাগের সেতু বিভাগ। ক্বিনব্রিজের মূল কর্তৃপক্ষ সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ। দেখভালের দায়িত্বে রয়েছে সিলেট সিটি কর্পোরেশন প্রকৌশল বিভাগ। ক্বিনব্রিজ সংস্কারের বিষয়ে ২০২০ সালে বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সমন্বয় সভায় আলোচনা করা হয়। সেখানে ব্রিজ সংস্কারের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে সওজের পক্ষ থেকে সেতুটি সংস্কারের জন্য মন্ত্রণালয়ের কাছে অর্থ বরাদ্দ চেয়ে আবেদন করা হয়। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ২ কোটি ১৫ লাখ টাকা বরাদ্দ পায় সওজ সিলেট অফিস। ওই বছরের জুনে বরাদ্দের টাকা রেলওয়ের সেতু বিভাগকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। করোনা মহামারিসহ নানা কারণে দুই বছর সময় ব্যয় করে গত ১৭ আগস্ট ক্বিনব্রিজের সংস্কার কাজ শুরু করে রেলওয়ের সেতু বিভাগ।

অভিযোগ উঠেছে, ক্বিনব্রিজের মূল কর্তৃপক্ষ সড়ক ও জনপথ বিভাগের এবং দেখভালের দায়িত্বে থাকা সিলেট সিটি কর্পোরেশন প্রকৌশল বিভাগের কোনো কর্মকর্তাকে সংস্কার কাজের সময় দেখা যায়নি। কাজের স্থলে গিয়ে খোঁজখবর নিলে কাজ যেমন আরো টেকসই হত তেমনি বর্ধিত সময়ের হওয়তো প্রয়োজন হত না। পক্ষান্তের জনসাধারণের কষ্ট কিছুটা লাঘব হত। আর সঠিক সময়ে ব্রিজের কাজ সমাপ্ত হতে পারতো বলে সচেতন মহল মনে করছে।

ক্বিনব্রিজের সংস্কার কাজের প্রধান মিস্ত্রি আক্তার হোসেন বাবু বলেন, এই ব্রিজের কাজ পূর্বে যতবার হয়েছে কখনো টেউ প্লেট বদল করা হয়নি এবং রং তোলে রং দেয়া হয়নি। এবারই প্রথম সম্পূর্ণ টেউ প্লেট ও জয়েছ লাগানো হয়। সম্পূর্ণ রং মেশিন দিয়ে তোলে দুবার রং করা হচ্ছে।

সড়ক ও জনপদ (সওজ) সিলেট বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোস্তাফিজুর রহমানকে কয়েকবার ফোন দিলে তিনি সাড়া দেননি।

ক্বিনব্রিজের সংস্কার কাজের দায়িত্বে থাকা রেলওয়ে বিভাগের পূর্বাঞ্চলের সেতু বিভাগের প্রকৌশলী জিসান দত্ত জানান, জনসাধারণের কথা চিন্তা করে চলতি মাসে ব্রিজ খুলে দেয়া হবে। তবে ব্যয়ভার বাড়বে না বলে তিনি জানান।

প্রসঙ্গতঃ আসাম প্রদেশের গভর্নর মাইকেল ক্বিন সিলেট সফরে আসার জন্য সুরমা নদীর ওপর ব্রিজ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কারণ, তখন আসামের সাথে সিলেটের যোগাযোগের মাধ্যম ছিল ট্রেন। ফলে, ব্রিটিশ সরকারের অর্থায়নে রেলওয়ে বিভাগ ১৯৩৩ সালে সুরমা নদীর ওপর ব্রিজ নির্মাণের উদ্যোগ নেয় এবং নির্মাণ শেষে ১৯৩৬ সালে ব্রিজটি আনুষ্ঠানিকভাবে জনসাধারণের জন্য খুলে দেয়া হয়। আসাম প্রদেশের গভর্নর মাইকেল ক্বিন এর নামনের সাথে মিল রেখে ব্রিজটি নামকরণ ক্বিনব্রিজ রাখা হয়। আব্দুল মজিদ কাপ্তান মিয়া, তৎকালীন আসাম সরকারের এক্সিকিউটিভ সদস্য রায় বাহাদুর প্রমোদ চন্দ্র দত্ত এবং তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদ ব্রিজটি নির্মাণের ক্ষেত্রে অবদান রাখেন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ডায়নামাইট দিয়ে ব্রিজটি উত্তর পাশের একাংশ উড়িয়ে দেয়। যা স্বাধীনতার পর কাঠ ও বেইলী পার্টস দিয়ে মেরামত করা হয় ও হালকা যান চলাচলের জন্য ব্যবহৃত হয়। পরে ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ রেলওয়ের সহযোগিতায় ব্রিজের বিধ্বস্ত অংশটি লোহা ও কংক্রিট দিয়ে পুনঃনির্মাণ করা হয়। এরপর আর বড় ধরনের সংস্কার হয়নি। এবারই প্রথম মরিচায় ক্ষতিগ্রস্ত হাওয়া পাটাতন তোলে ফেলে নতুন পাটাতন যুক্ত করার কাজ হয়।