নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেশে ব্যাংক খাতের অন্যতম বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে খেলাপি ঋণ। প্রতিনিয়ত বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে না ঋণ আদায়ের হার। খেলাপি ঋণের সিংহভাগই অনাদায়ী রয়ে যায়। আবার খেলাপি ঋণ নামের বিপদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে প্রভিশন ঘাটতি। ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় এর বিপরীতে সংস্থান রাখার মতো যথেষ্ট মুনাফা হচ্ছে না। এতে আর্থিক খাতে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। তাই গত অক্টোবরের শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে এক বৈঠকে খেলাপি ঋণের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশের সঙ্গে এর প্রতিকার বিষয়েও জানতে চেয়েছিল আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটি জানতে চায়- ব্যাংকখাতে কেন খেলাপি বাড়ছে। খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য কী কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব ঋণখেলাপিদের শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে কিনা ইত্যাদি বিষয়ে। আন্তর্জাতিক মানদ- মতে, খেলাপি ঋণের হার সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ পর্যন্ত সহনীয়। বাংলাদেশে এ হার ৯ শতাংশ। সরকারি ব্যাংকে ২০ শতাংশের বেশি। এ বিষয়ে প্রশ্ন তুলে উদ্বেগ জানায় আইএমএফ। সন্দেহজনক লেনদেন ও অর্থপাচার নিয়েও উদ্বেগের কথা জানায় সংস্থাটি। আইএমএফের এসব প্রশ্নের জবাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়- সাধারণত খেলাপি ঋণের হিসাব দুইভাবে করা হয়। এর একটি গ্রস এবং অপরটি নিট। গ্রস হিসাবে খেলাপি ঋণ বেশি হলেও নিট হিসাবে কম। যা ৩ থেকে ৪ শতাংশের মধ্যেই রয়েছে। এ কারণে করোনাকালীন সময়ে খেলাপি ঋণ কিছুটা বেড়েছে। দেশের বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে নানা উদ্যোগ হাতে নেওয়া হয়েছে। তবে, সরকারি ব্যাংকে কিছু সীমাবদ্ধতা থাকায় একটু অসুবিধা হচ্ছে। কারণ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে- সরকারি ব্যাংকের শতভাগ নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে নেই।
এর আগে খেলাপি ঋণ সংকট কাটাতে এবং আর্থিক খাতকে স্থিতিশীল রাখতে গত জুলাইয়ে পরিশোধের সময়সীমা বাড়িয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে অর্থ জমার পরিমাণ কমানো হয়। নতুন নিয়ম অনুযায়ী, আড়াই থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ অর্থ জমা দিলেই খেলাপি ঋণ নিয়মিত করা যাচ্ছিল, যা আগে ছিল ১০ থেকে ৩০ শতাংশ। সে সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, করোনার দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ও বহির্বিশ্বে সাম্প্রতিক যুদ্ধাবস্থা প্রলম্বিত হওয়ায় বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অস্থিতিশীলতা চলছে। আর তাই নতুনভাবে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ও শ্রেণিকৃত ঋণের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার স্বার্থে ঋণ পুনঃতফসিলকরণ সংক্রান্ত নতুন নীতিমালা জারি করা হয়। নীতিমালায় বলা হয়, খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে এখন আড়াই থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ অর্থ জমা দিলেই হবে। এসব ঋণ পরিশোধ করা যাবে ৫ থেকে ৮ বছরে। আবার নতুন করে ঋণও নেওয়া যাবে। আগে এ ধরনের ঋণ পরিশোধে সর্বোচ্চ দুই বছর সময় দেওয়া হতো। কিন্তু গত আগস্টের শুরুতে ভিন্ন এক নির্দেশনা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে ছাড় কমানো হয় খেলাপি ঋণে। ওই দিন জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, পুনঃতফসিলের পর আরোপিত সুদ প্রকৃত আদায় ছাড়া ব্যাংকের আয় খাতে স্থানান্তর করা যাবে না। মন্দ মানে শ্রেণিকৃত ঋণ তৃতীয় ও চতুর্থবার পুনঃতফসিল করার ক্ষেত্রে প্রকৃত আদায় ছাড়া সংরক্ষিত প্রভিশন ব্যাংকের আয় খাতে নেওয়া যাবে না।
তথ্য মতে, বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নির্দেশনা আসার পর চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরের আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করে ব্যাংকগুলো। নিয়ম অনুযায়ী, প্রতি তিন মাস পর পর আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হয় শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে। এরই আলোকে তালিকাভুক্ত ৩৩টি ব্যাংক চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরের পাশাপাশি প্রকাশ করেছে জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ের প্রতিবেদন। ব্যাংকগুলোর প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) ১৫টি ব্যাংকের মুনাফা গত বছরের তুলনায় কমেছে। এর মধ্যে দুটি ব্যাংক লোকসানে রয়েছে। ১৯টি ব্যাংকের ক্যাশ-ফ্লো ঋণাত্মক অবস্থায় রয়েছে। সম্পদমূল্য কমে গেছে ৭টি ব্যাংকের।
জানা গেছে, করোনা পরবর্তী সময়ে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েই চলছে। এ ছাড়া করোনায় অর্থনীতির গতি ধরে রাখতে যে এক লাখ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে, তারও বড় একটা অংশ খেলাপি হয়ে পড়েছে। এ কারণে এখন ছাড় দিয়ে খেলাপি ঋণের লাগাম টেনে ধরতে চাইছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু ঋণ পরিশোধে ব্যবসায়ীদের জন্য বিশেষ ছাড় দিয়েও কমছে না ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ। উল্টো আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।
সূত্রমতে, গত সেপ্টেম্বর মাসের শেষে মোট ঋণের মধ্যে খেলাপির হার দাঁড়িয়েছিল ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। তিন মাস আগে অর্থাৎ জুন শেষে এ হার ছিল ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ। সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। তিন মাস আগে এ পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। এদিকে এ খাতের দৈন্যদশার কারণ হিসেবে ম্যানেজম্যান্টের দুর্বলতাকে চিহ্নিত করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তাঁর মতে, ব্যাংক খাতের ম্যানেজমেন্ট খুব একটা যে ভালো না, আর যে কয়টা ব্যাংক ভালো সেগুলোর নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সার্বিকভাবে ব্যাংকের যে চিত্র দেখা যাচ্ছে, সেটা খুব একটা ভালো লক্ষণ নয়। খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের ছাড় দেওয়াকে ভুল পদ্ধতি এবং ভুল বার্তা হিসেবে দেখছেন তিনি। তাঁর মতে, এতে বার্তা যাচ্ছে ঋণ পরিশোধ করা লাগে না। সার্বিকভাবে দেশের ব্যাংক খাত খুব একটা ভালো অবস্থানে নেই বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, সুদের হার ৬-৯ বেঁধে দেওয়ার কারণে একদিকে ব্যাংকের মুনাফার সক্ষমতা কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে ক্যাশ-ফ্লোতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। আবার খেলাপি ঋণের বিষয়ে নানান ধরনের ছাড় দেওয়ার কারণে ঝুঁকি বাড়ছে। সার্বিকভাবে খেলাপি ঋণ, মুনাফা, ক্যাশ-ফ্লো, সম্পদ মূল্যের যে চিত্র, তাতে বোঝাই যাচ্ছে দেশের ব্যাংক খাত ভালো অবস্থানে নেই। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য দ্রুত আন্তর্জাতিক বেস্ট প্র্যাকটিস অনুসরণ করতে হবে। দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে সামনে ব্যাংক খাতের অবস্থা আরও খারাপ হবে।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ