November 22, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Wednesday, August 25th, 2021, 12:13 pm

খেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে ব্যাংকের বিপুল টাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক:

দেশের ব্যাংকিং খাতে কমছেই না খেলাপি ঋণের পরিমাণ। বরং উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৫ হাজার কোটি টাকা। আর জুন প্রান্তিকে তা লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমানে বিপুল অঙ্কের ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ রয়েছে। এমন ঋণের পরিমাণ প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। খেলাপি হওয়ার আগের ধাপে থাকা ওসব ঋণগ্রহীতা যদি সময় মতো কিস্তি পরিশোধ না করে, তাহলে তা খেলাপি ঋণের হিসাবে যুক্ত হয়ে যাবে। আর তা হলে ব্যাংকিং সেক্টরসহ পুরো অর্থনীতির জন্য বড় দুঃসংবাদ বয়ে আনবে। ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশের ব্যাংকিং খাতে মাত্র ৩ মাসের ব্যবধানে স্পেশাল মেনশন অ্যাকাউন্টে (এসএমএ) ঋণের অঙ্ক বেড়েছে আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি। যে কারণে ওই ঋণের অঙ্ক প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া শিল্প খাতে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণও লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ব্যাংক খাতের নিয়মানুযায়ী কোনো ঋণের ৮টি কিস্তি অনাদায়ি থাকলে ওই ঋণকে এসএমএ হিসাবে গণ্য করা হয়। আর যে ঋণের কিস্তি নির্ধারিত তারিখে পরিশোধ করা হয় না, ওই ঋণকে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ বলা হয়। মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে এমন ধরনের ঋণ ৯ মাস থাকার সুযোগ রয়েছে। ওই সময়সীমা অতিক্রম করলেই খেলাপি হবে। বর্তমানে নানা ধাপে দেড় লাখ কোটি টাকা বকেয়া পড়ে যাওয়ার বিষয়টি ঋণখেলাপির আগের ধাপ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর স্পেশাল মেনশন অ্যাকাউন্টে (এসএমএ) ঋণের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ৪৭ হাজার ১০৪ কোটি টাকা, যা ৩ মাস আগে অর্থাৎ গত ডিসেম্বরে ছিল ৪৪ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা। ওই হিসাবে ৩ মাসের ব্যবধানে এসএমএ মানের ঋণ বেড়েছে ২ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা। আর ২০২০ সালের মার্চে ছিল ৪৬ হাজার ৮৩২ কোটি টাকার এসএমএ ঋণ। বছরের ব্যবধানে এসএমএ ঋণ বেড়েছে ২৭২ কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত শিল্প খাতে ৯৮ হাজার ৯০৪ কোটি টাকা মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়েছে। যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৮৫ হাজার ৭৫৪ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে শিল্প খাতে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ বেড়েছে ১৩ হাজার ১৫০ কোটি টাকা বা ১৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ। আর ৩ মাসের হিসাবে ওই অঙ্ক আরো বেশি। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে শিল্পে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ ছিল ৭০ হাজার ৬০৪ কোটি টাকা। ওই হিসাবে মাত্র ৩ মাসে শিল্প খাতে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ বেড়েছে ২৮ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে শিল্প খাতে ৯০ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ হয়েছে। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বিতরণ কমেছে ৬৯৫ কোটি টাকা বা শূন্য দশমিক ৭৬ শতাংশ। তার মধ্যে ৭৩ হাজার ৪২ কোটি টাকা বা ৮০ দশমিক ২৯ শতাংশ বড় শিল্পে বিতরণ হয়েছে। মাঝারি শিল্পে বিতরণ হয়েছে ৯ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা বা ১০ দশমিক ৫৪ শতাংশ, আর ক্ষুদ্র শিল্পে বিতরণ করা হয়েছে মাত্র ৮ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ। গত মার্চ পর্যন্ত বিতরণ করা ওসব ঋণের মধ্যে মেয়াদি ঋণের অঙ্ক ছিল ১৭ হাজার ৩৭৯ কোটি এবং আর চলতি মূলধন খাতে বিতরণ করা হয়েছে ৭৩ হাজার ৪৩ কোটি টাকা।
সূত্র আরো জানায়, মার্চ পর্যন্ত শিল্পঋণে বকেয়া পড়েছে ৫ লাখ ৯৬ হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা। তার মধ্যে শিল্পের আকার অনুযায়ী বৃহৎ শিল্প, মাঝারি শিল্প ও ক্ষুদ্র শিল্পে বকেয়ার হার যথাক্রমে ৭৭ দশমিক ৬৯, ১৪ দশমিক ২৭ এবং ৮ দশমিক ০৪। ওই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে শিল্পঋণে বকেয়ার অঙ্ক ৮ দশমিক ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর খাতভিত্তিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, বৃহৎ, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পে যথাক্রমে ৫ দশমিক ৯৮, ২৭ দশমিক ০৭ ও ১ দশমিক ১১ শতাংশ বকেয়া বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০ সালের মার্চ শেষে মেয়াদি শিল্পঋণের বকেয়া স্থিতি ছিল ২ লাখ ৬৬ হাজার ৭১৫ কোটি টাকা। এক বছর পর অর্থাৎ চলতি বছরের মার্চে তা ১২ দশমিক ১২ শতাংশ বেড়ে ২ লাখ ৯৯ হাজার ৪৯ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি চলতি মূলধন ঋণে বকেয়া ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ বেড়ে ২ লাখ ৯৭ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ৯৫ হাজার ৮৫ কোটি টাকা। তার প্রায় অর্ধেকই শিল্প খাতের। গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি বেড়েছে ৬ হাজার ৮০২ কোটি টাকা। তবে চলতি বছরের মার্চ শেষে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় খেলাপি বেড়েছে ২ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা।
এদিকে একজন গ্রাহকের মেয়াদি ঋণের ৬টি মাসিক কিস্তি অপরিশোধিত থাকার পর আরো ৩ মাস অনাদায়ি থাকলে সেটা নি¤œমান খেলাপি হিসাবে বিবেচিত হয়। পরিশোধের প্রথম ৬ মাস পার হওয়ার পর ৩ থেকে ৯ মাস পর্যন্ত তা নি¤œমান ধরা হবে। আর ব্যাংক কোম্পানি আইনে যেহেতু ৬ মাস মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ খেলাপি বিবেচিত হয়, ফলে প্রকৃতপক্ষে ওই ধরনের একটি ঋণ ১২ থেকে ১৫ মাস পর্যন্ত নি¤œমান বিবেচিত হয়। তবে মেয়াদি ঋণ বাদে অন্যসব ঋণ ৩ থেকে ৯ মাস পর্যন্ত মেয়াদোত্তীর্ণ থাকলে তা নি¤œমান খেলাপি। আর ৯ থেকে ১২ মাস মেয়াদোত্তীর্ণ হলে তা সন্দেহজনক মানের খেলাপি। একই সঙ্গে ১২ মাসের বেশি অনাদায়ি থাকলে ক্ষতিজনক বা মন্দ মানের খেলাপি বিবেচনা করা হয়।
অন্যদিকে বিদ্যমান পরিস্থিতি প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদরা জানান, খেলাপি ঋণ আদায়ের খুব বেশি সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। কারণ খেলাপির বেশির ভাগ টাকাই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। ধরতে চাইলেই ওসব ঋণখেলাপি বিদেশে পালিয়ে যায়। কারণ তারা সেখানে বাড়ি-গাড়ি. অট্টালিকা গড়েছে। ওসব প্রভাবশালী ঋণখেলাপি থেকে প্রচলিত আইনে টাকা আদায় করা যাবে না। তাদের ধরতে হলে আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে এবং প্রতিটি ব্যাংকের শীর্ষ ১০ খেলাপিকে গঠিত ট্রাইব্যুনালের আওতায় বিচার করতে হবে। তাদের সম্পদ ক্রোক করতে হবে। তাদের কোনো ধরনের আপিলের সুযোগ দেয়া যাবে না। করোনা মহামারীর কারণে এখন হয়তোবা বিনিয়োগ নেই। পাশাপাশি ব্যাংকে টাকাও আছে। তাই আসল সংকটটা বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু বিনিয়োগ পরিবেশ ফিরে এলে খেলাপি ঋণ গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে। দেখা দেবে মহাসংকট।
এ প্রসঙ্গে জ্যেষ্ঠ ব্যাংকার মোহাম্মদ নূরুল আমিন জানান, খেলাপি হওয়ার আগের ধাপের ঋণগুলোর গন্তব্য সাধারণত দুই ধরনের। তবে বড় একটি অংশ খেলাপির দিকে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। বিশেষ করে সাম্প্রতিককালের কিছু ঘটনা ও পরিসংখ্যান এমনই ইঙ্গিত বহন করে। তাই যদি হয় সেক্ষেত্রে এখনই বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন বা ঋণ তদারকির বিষয়টি কার্যকরভাবে নিশ্চিত করা জরুরি।