নিজস্ব প্রতিবেদক:
লেকের পচা পানির দুর্গন্ধ আর মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী ও বারিধারার বাসিন্দারা। যে লেককে সৌন্দর্যবর্ধনের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে মনে করা হতো, গুলশান-বনানী-বারিধারার বাসিন্দারা যাকে নিয়ে গর্ব করতেন, সেই লেক এখন ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে রূপ নিয়েছে। গুলশান লেকের পঁচা পানির দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে চারিদিকে। পানির ওপর ভাসছে প্লাস্টিকের বোতল, পলিথিনের প্যাকেট, কৌটা, মনুষ্যবর্জ্য ইত্যাদি। দুর্গন্ধ থেকে মুক্তি পেতে বাসা-বাড়ির বাসিন্দারা লেকপাড়ের জানালা-দরজা বন্ধ করে রাখছেন। মশার প্রজনন ক্ষেত্রেও পরিণত হয়েছে লেকটি। গুলশান-বনানী-বারিধারা লেক ঘুরে এমন বেহাল চিত্র চোখে পড়েছে। এর দূষিত পানির মধ্যেই করা হচ্ছে মাছ চাষ। ময়লা-আবর্জনাযুক্ত বিষাক্ত পানির কারণে মারাও যাচ্ছে মাছ । ২০ ফুট গভীর প্রায় ৪০ একর জয়গায় আবদ্ধ এই লেকটিতে অধিকাংশ মাছের গায়ে, পেটে ও লেজে ঘা ও পঁচন রোগ ধরেছে। যা আশ-পাশের বাজারে বিক্রিও হচ্ছে। এই দূষিত পানির মাছ স্বাস্থ্যের জন্য কতটুকু যে ক্ষতিকর তা বলে শেষ করা যাবে না।
দি নিউ নেশনের প্রতিনিধি সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখেন, লেকের ভেতরে গড়ে উঠেছে গ্যারেজ, টং দোকান ও বস্তি। কয়েকটি স্থানে ঘেরাও করে মাছ চাষও হচ্ছে। গরু-মহিষের নাড়িভুঁড়ি ফেলা হচ্ছে মাগুর মাছের খাবার হিসেবে। এ থেকেও উৎকট দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। অনেক সময় সিটি করপোরেশনের বর্জ্যও ফেলা হচ্ছে। কয়েকটি স্থানে লেক ভরাট করে চলছে শাক-সবজির চাষ। লেকের পাশের অনেক বাসিন্দাও গৃহস্থালির বর্জ্য লেকে ফেলছেন। কয়েকটি স্থানের উন্মুক্ত ড্রেন লেকের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। বৃষ্টি হলেই ড্রেন দিয়ে আশপাশের বর্জ্য লেকের ভেতরে পড়ছে। এতে পানি দূষিত হচ্ছে। বর্জ্যে ভরাট হয়ে পড়ছে লেক।
সম্প্রতি এ বিষয়ে মেয়র আতিক বলেন, আজকে বারিধারার লেক, গুলশান লেক, উত্তরা লেক, বনানী লেকে মাছের চাষের পরিবর্তে মশা চাষ করা হচ্ছে। খাল- লেকগুলোর পাশে দাঁড়ানো যায় না তীব্র গন্ধের জন্য। বিভিন্ন রিজেকশনের জন্য মাছ চাষ করা যাচ্ছে না।আজকে বারিধারার লেক, গুলশান লেক, উত্তরা লেক, বনানী লেকে মাছের চাষের পরিবর্তে মশা চাষ করা হচ্ছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকায় নিরাপদ ও টেকসই পয়ঃবর্জ্য পরিষেবার রোডম্যাপ বাস্তবায়নে আয়োজিত দুই দিনব্যাপী কর্মশালার প্রথম দিনে এমন মন্তব্য করেন তিনি।
কোনো মেগা সিটির মধ্যে এ ধরনের বিশালাকৃতির লেক থাকা সৌভাগ্যের ব্যাপার। রাজধানীর বিশাল এলাকায় ছড়িয়ে আছে ধানমণ্ডি, হাতিরঝিল ও গুলশান-বনানী-বারিধারা লেক। ধানমণ্ডি ও হাতিরঝিলের দিকে কিছুটা নজর থাকলেও গুলশান-বনানী-বারিধারা লেকের দিকে মোটেও লক্ষ্য নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।
গত বছরের নভেম্বরের শেষের দিকে, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) গুলশান, বনানী ও বারিধারা লেকের উন্নয়ন এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তিন বছরের জন্য দেওয়া হয়েছে গুলশান সোসাইটিকে। চুক্তি অনুযায়ী রাজউকের অনুমতি ছাড়া এই লেকপাড়ে কোনো ধরনের বাণিজ্যক কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে না। চুক্তি অনুযায়ী রাজউকের অনুমতি ছাড়া লেকপাড় বা লেকের পানিতে মাছ চাষ, নৌকা পরিচালনা, রেস্টুরেন্ট পরিচালনা ও সাইনবোর্ড স্থাপনসহ কোনো ধরনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না। এ ছাড়া পানিতে কচুরিপানাসহ সব ধরনের ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কারকরণ, ময়লা না ফেলা, লেকের পাড়ে মৌসুমি ফুলের গাছ লাগানো ও পরিচর্যা, পাড়ের গাছের মালিকানা দাবি না করা, লেকে ভ্রমণকারীদের জন্য প্রচার, উদ্বুদ্ধকরণ ও বিনোদনমূলক কর্মকান্ডের উদ্যোগ গ্রহণ করবে গুলশান সোসাইটি। কিন্তু বাস্তবচিত্র সম্পূর্ণ ভীন্ন।
এসব পরিবেশ বিরোধী কার্যকলাপ নিঃসন্দেহে জলজ দেহের পরিবেশগত স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে। দুর্গন্ধযুক্ত পানি ও আবর্জনা প্রতিনিয়ত এলাকার বিশুদ্ধ বাতাস নষ্ট করে দিচ্ছে যেখানে মানুষ নাক ঢেকেও দুর্গন্ধ থেকে মুক্তি পেতে পারে না। আবর্জনা এবং বর্জ্য দ্বারা দূষিত দুর্গন্ধযুক্ত বায়ুর কারণে লেকের পাশে সকালে হাঁটতে এবং জগিং করতে দেখা যায় এমন লোকেরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এলাকাটি কূটনৈতিক অঞ্চলে আবদ্ধ থাকায়, এই ধরনের অবাধ দূষণ দেশের ভাবমূর্তিকেও কলঙ্কিত করছে যেখানে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এখনও দুর্বল। এলাকার কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, লেকের গুরুত্ব নিয়ে কর্তৃপক্ষের তেমন গুরুত্ব নেই। কঠোরতা এবং ক্রমাগত তদারকি ছাড়া, এই দূষণ অব্যাহত থাকবে এবং লেকটি একদিন মারা যাবে, তারা বলেছেন।
উল্লেখ্য, গুলশান-বারিধারা লেককে অবৈধ দখল-দূষণ থেকে রক্ষা করতে ২০১০ সালে সরকার ৪১০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প হাতে নেয়। এ প্রকল্পের আওতায় ৮৭ একর জমি অধিগ্রহণের কথা ছিল রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের। জমি অধিগ্রহণ করতে না পারায় প্রকল্পের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতিও হয়নি। ফলে নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে না পারায় এর ব্যয় বেড়ে গেছে নির্ধারিত বাজেটের কয়েকগুণ বেশি। সেই সময় প্রকল্পটির প্রস্তাবিত ব্যয় ধরা হয়েছিল চার হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা, যার মধ্যে জমি অধিগ্রহণের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছিল দুই হাজার কোটি টাকা। বাকি দুই হাজার ৮৮৬ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হয়েছিল অন্যান্য অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক