নিজস্ব প্রতিবেদক:
চলতি বছর বাংলাদেশ দ্বিগুণ বিদেশী ঋণ পরিশোধ করতে হবে। ২০২১ সালে সুদসহ দেশের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ১১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। আর ২০২২ সাল শেষে বিদেশী ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ২৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার দাঁড়াবে। তার মধ্যে প্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলার দেশের বেসরকারি খাতকে পরিশোধ করতে হবে। বাকি ৫ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করবে সরকার। তবে আগামী দুই বছর বিদেশী ঋণ পরিশোধের চাপ কিছুটা কমবে। ওই সময়েও বাংলাদেশকে প্রতি বছর সুদসহ ২০ বিলিয়ন ডলার বিদেশী ঋণ পরিশোধ করতে হবে। আগামী বছর শেষে বাংলাদেশের বিদেশী ঋণের পরিমাণ ১১৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে। আর ২০২৪ সাল শেষে বিদেশী ঋণের পরিমাণ ১৩০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, চলতি বছরের শুরুতেই দেশে বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কট শুরুর পূর্বাভাস পাওয়া গিয়েছিল। জানুয়ারিতে ব্যাংকগুলোর খোলা আমদানি ঋণপত্রের (এলসি) পরিমাণ দাঁড়ায় ৮৬২ কোটি ডলারে। ফেব্রুয়ারিতে এলসি খোলা কিছুটা কমলেও মার্চে তা ৯৮০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। এক মাসেই প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের আমদানি এলসি খোলা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের টনক নড়ে। আমদানি কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগ সক্রিয় হয়। গত বছর বাংলাদেশের রেকর্ড ১৭ বিলিয়ন ডলারের বিদেশী ঋণ তৈরি হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি উভয় খাত ওই ঋণ নিয়েছে। রেকর্ড ওই বিদেশী ঋণের ৫৭ শতাংশই বৈদেশিক বাণিজ্যের দায় বিলম্বের কারণে তৈরি হয়েছে। ওই সময় বাংলাদেশ ব্যাংক নভেল করোনা ভাইরাসসৃষ্ট বৈশ্বিক দুর্যোগের কারণে আমদানি দায় পরিশোধের সময় বাড়িয়ে দিয়েছিল। তাতে ২০২১ সালের মোট আমদানি দায়ের ৩০ শতাংশ বিদেশী ঋণে রূপ নেয়। আমদানি দায় অপরিশোধিত থাকার কারণে স্বল্পমেয়াদি ওই বিদেশী ঋণ সৃষ্টি হয়েছে। করোনার আগের ৫ বছর দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির গড় ছিল ৭ শতাংশ। জিডিপির ওই প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সরকার ধারাবাহিকভাবে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। রাজস্ব থেকে অর্থের সংস্থান না হওয়ায় দেশী-বিদেশী বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নিয়েও ওই সময়ে বিনিয়োগ করা হয়। ফলে দেশের জাতীয় সঞ্চয় ও বিনিয়োগের মধ্যে বড় ধরনের ব্যবধান তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় সঞ্চয় ২৫ দশমিক ৩ শতাংশ হলেও বিনিয়োগ হয়েছে ৩১ শতাংশ। জাতীয় সঞ্চয় ও বিনিয়োগের বড় এ ব্যবধানই দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে ভারসাম্যহীনতার দিকে ঠেলে দিয়েছে।
সূত্র জানায়, গত ৫ বছরে বিদেশী উৎস থেকে বাংলাদেশের ঋণ দ্বিগুণ হয়েছে। সরকারের নেয়া ঋণের চেয়েও ওই সময়ে বেসরকারি খাতে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিদেশী উৎস থেকে দেশের মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৫ দশমিক ৮১ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ৫৮১ কোটি ডলার। চলতি বছরের জুন শেষে সরকারি-বেসরকারি খাত মিলিয়ে বিদেশী ঋণের পরিমাণ ৯৫ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন (৯ হাজার ৫৮৫ কোটি) ডলার ছাড়িয়ে যায়। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী বাংলাদেশী মুদ্রায় ওই ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি, যা দেশের মোট জিডিপির প্রায় ২২ শতাংশ। বিপুল অংকের ওই ঋণের সরকারেরই ৭৩ শতাংশ আর বাকি ২৭ শতাংশ ঋণ নিয়েছে দেশের বেসরকারি খাত। অথচ ৫ বছর আগে দেশের বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণের পরিমাণ ছিল ১২ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু চলতি বছরের জুন শেষে বিদেশী ওই ঋণের পরিমাণ ২৫ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৫৯৫ কোটি ডলারে গিয়ে ঠেকেছে। বাংলাদেশী মুদ্রায় বেসরকারি খাতে বিদেশী ওই ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ২ লাখ ৭২ হাজার কোটি টাকারও বেশি। বিপুল অংকের ওই ঋণের অন্তত ১০ বিলিয়ন ডলার করোনা মহামারীর দুই বছরে নেয়া হয়েছে। ব্যক্তি খাতের কোম্পানিগুলোর নেয়া বিদেশী ঋণের ৬৮ শতাংশই স্বল্পমেয়াদি।
সূত্র আরো জানায়, রেকর্ড এলসি দায় পরিশোধের পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি বিদেশী ঋণের কিস্তি পরিশোধ নিয়ে দেশের ব্যাংক খাত দিশেহারা পরিস্থিতি পার করছে। বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে তীব্র ডলার সংকটের কারণে অনেক ব্যাংক চাইলেও যথাসময়ে এলসি দায় পরিশোধ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। আবার বিদেশী ঋণের কিস্তির ডলার সংস্থান করতে পারছে না কিছু ব্যাংক। এমন অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রতিনিয়ত বাজারে ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে। গত অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিক্রি করেছে প্রায় ৭৫০ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের এখন পর্যন্ত প্রায় ৪০০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অব্যাহতভাবে ডলার বিক্রি করায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। অথচ গত বছরের আগস্টে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার। দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে অস্থিরতার কারণে গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার প্রায় ২৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়েছে।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত কয়েক বছর কৃত্রিম উপায়ে ডলারের বিপরীতে টাকার শক্তিশালী অবস্থান ধরে রেখেছিল। চলতি বছরের এপ্রিলে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৫ টাকা। যদিও দেশের অর্থনীতিবিদরা অনেক আগে থেকেই ডলারের বিনিময় হারকে মুদ্রাবাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। চলতি বছরের এপ্রিলের বাজার বিশ্লেষণ করে মুদ্রানীতি বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়, এ সময় নমিনাল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেটের (এনইইআর) ভিত্তিতে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল ৯৭ টাকা ৭২ পয়সা। আর রিয়েল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেটের (আরইইআর) ভিত্তিতে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল ১১৬ টাকা ৩৮ পয়সা। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক ওই সময়ে ডলারের বিনিময় মূল্য ৮৫ টাকায় নির্ধারণ করে রেখেছিল। চলতি বছরের শুরুতেই দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে সংকটের আভাস মিলছিল। ওই সময় সরকারসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে সতর্কও করা হয়েছিল। কিন্তু বিষয়টিকে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়নি।
অন্যদিকে এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র জিএম আবুল কালাম আজাদ জানান, প্রতিনিয়তই মুদ্রাবাজারের গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের স্থিতিশীলতা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব সময়ই সতর্ক।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ