May 19, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Thursday, January 4th, 2024, 9:24 pm

চামড়া শিল্পে লক্ষ্য বড়, বাস্তবায়ন সক্ষমতা কম

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

দেশের চামড়া শিল্প সম্ভাবনাময় শিল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম। এজন্য রয়েছে বিশাল লক্ষ্যও, কিন্তু পূরণের সক্ষমতা সে তুলনায় কম। জানা গেছে, বর্তমানে এ খাতের রপ্তানি আয় ১ বিলিয়ন ডলার। ২০৩০ সালের মধ্যে চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি ১০ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্য রয়েছে সরকারের। দেশের তৈরি পোশাক শিল্প থেকে রপ্তানি নির্ভরতা কমিয়ে রপ্তানি পণ্য বহুমুখীকরণেই এই পদক্ষেপ। তবে বিশ্ববাজারে দেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বরে) ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যে আয় হয়েছে ৪২ কোটি ৭০ লাখ ডলার। এই আয় গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২০ দশমিক ৫৫ শতাংশ কম। ওই সময় আয় হয়েছিল ৫৩ কোটি ৭৫ লাখ ডলার। চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৩৫ কোটি ডলার। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, চামড়াশিল্পের রপ্তানি আয়ে বড় বাধা আন্তর্জাতিক সনদ।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন মনে করে, ১০-১২ বিলিয়ন ডলার আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা সরকার নির্ধারণ করেছে, তা অর্জন করা সম্ভব। কারখানাগুলোকে কমপ্লায়েন্ট করতে হবে। সরকারের নীতি সহায়তারও প্রয়োজন হবে। সংগঠনটির সভাপতি শাহিন আহমেদ বলেন বলেন, বিদেশি ক্রেতা আকৃষ্টে লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের সার্টিফিকেট গুরুত্বপূর্ণ। তবে কারখানাগুলো পুরোপুরি কমপ্লায়েন্ট না হলে এই সার্টিফিকেট পাওয়া সম্ভব নয়। আর বিদেশি ক্রেতা ও পণ্যের দাম বেশি পেতে এটা অবশ্যই প্রয়োজন।

তিনি জানান, কমপ্লায়েন্স ঠিক না থাকায় বিদেশিরা এখন কম দামে চামড়া কিনছে। কমপ্লায়েন্ট হলে এই পণ্যের দাম হবে আর রপ্তানি আয়ও বাড়বে বলে জানান তিনি। তবে বাংলাদেশের মাত্র তিনটি প্রতিষ্ঠান এই সার্টিফিকেট পেয়েছে। বড় অংশই কমপ্লায়েন্ট না হওয়ায় সার্টিফিকেট পায়নি, যা এই খাতে রপ্তানি বৃদ্ধির অন্যতম অন্তরায় বলছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। মন্ত্রণালয় ও চামড়াখাতের ব্যবসায়ীরা জানান, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য শিল্প অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। এই খাতে প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ৬ লাখ ও পরোক্ষভাবে আরও তিন লাখ মানুষের কর্মসংস্থান। বাংলাদেশের মোট রপ্তানিতে চামড়া শিল্পের অবদান প্রায় ৪ শতাংশ আর দেশের মোট জিডিপির ০.৫ শতাংশ।

বিশ্বে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে এখন শীর্ষ দেশ চীন। বাংলাদেশের চামড়া রপ্তানির বড় বাজার ইতালি, স্পেন, হংকং। এছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়। রপ্তানি পণ্য বহুমুখীকরণে নীতি সহায়তা পেলে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে এইক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা। কারণ বৈশ্বিক বাজারে রপ্তানি বাড়ানোর মূল নিয়ামক হিসাবে কাজ করে চামড়াখাতের পণ্যগুলোর কমপ্লায়েন্স। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি কমছে। বর্তমানে এই রপ্তানির পরিমাণ ১ বিলিয়ন ডলারের কম।

মূলত কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাবে সাম্প্রতিক সময়ে চামড়া রপ্তানি ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। যদিও সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ১৮ শতাংশ। আর চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসের রপ্তানির প্রবৃদ্ধি প্রায় ৩০ শতাংশ। বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, চামড়াশিল্পে সম্ভাবনার বড় জায়গা এর কাঁচামাল। এই সম্পদের যথাযথ ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে বৈশ্বিক বাজারের বিশাল সুযোগ কাজে লাগানো যাচ্ছে না। তাই এই খাতের উন্নয়নে বড় বিনিয়োগ খুঁজতে হবে।

খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, চামড়াশিল্পে রপ্তানি আয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে প্রধান বাধা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা। সাভারের চামড়াশিল্প নগরীর কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) কার্যকর নেই, কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও ঠিকভাবে হচ্ছে না। এ কারণে শিল্পনগরীর কোনো প্রতিষ্ঠান ট্যানারিশিল্পের মান সনদ প্রদানকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডাব্লিউজি) থেকে স্বীকৃতি পাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক সনদের অভাবে একদিকে ব্যবসার পরিধি ছোট হয়ে আসছে, একই সঙ্গে কমছে রপ্তানি আয়ও।

এমন অবস্থায় সাভার চামড়া শিল্পনগরীতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বড় উদ্যোগ নেওয়ার আহবান জানিয়েছেন তাঁরা। উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, ট্যানারির কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধানাগার ঠিক না হওয়ায় এই সনদ পাওয়া যাচ্ছে না। এর ফলে শুধু ট্যানারিই নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশ, ট্যানারি সংশ্লিষ্ট কর্মসংস্থান এবং কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া কেমিক্যাল ব্যবসায়ী, বায়িং এজেন্ট, দেশের আর্থিক খাতও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

বাংলাদেশ ট্যানার অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) তথ্য অনুসারে দেশে ট্যানারি আছে ১৪৬টি, এর মধ্যে সাভার শিল্প নগরীতে ১৪০টি। সেই হিসাবে বৈশ্বিক এ সনদ পাওয়ার হার ৪ শতাংশ মাত্র। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাভারের চামড়াপল্লীতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সংকট মোকাবেলা করা গেলে আগামী পাঁচ-ছয় মাসের মধ্যে ৫ থেকে ১০টি কারখানায় এলডাব্লিউজি সনদ পাওয়া যাবে। সেই সঙ্গে বছরে ৫০০ থেকে ৭০০ কোটি টাকা আয়ও বাড়াবে। আর এলডাব্লিউজি সনদ পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় অকার্যকর সিইটিপি ও কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা।

অন্যদিকে উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, দেশে উচ্চমূল্যস্ফীতির কারণে কাঁচামালের দাম বেড়েছে। শ্রমিককেও মজুরি বেশি দিতে হচ্ছে। কিন্তু বিদেশি ক্রেতারা সে অনুপাতে পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে না। এটিও রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অন্যদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ইউরোপের অঞ্চলগুলোতে অর্থনীতি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে।

এ অবস্থায় ইউরোপের বাজার থেকে ক্রমাগত রপ্তানি আদেশ হ্রাস পাচ্ছে। গ্লোবাল বিজনেস ডাটা প্ল্যাটফরম প্রেসিডেন্সি রিসার্চের তথ্য অনুসারে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বিশ্ববাজার ৪২৪ বিলিয়ন বা ৪২ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের। বার্ষিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস হলো ৬ শতাংশের বেশি। সেই হিসাবে ২০৩০ সালে এই বাজারের আকার হবে ৭২৪ বিলিয়ন ডলার। প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করা গেলে বাংলাদেশ এই বিশাল বাজার থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারবে বলে মত খাত সংশ্লিষ্টদের।