অনলাইন ডেস্ক :
ভারতের জনসংখ্যা এখন ১৪২ কোটি ৫৭ লক্ষ ৭৫ হাজার ৮৫০ ,যা এখন চীনের মূলভূমির জনসংখ্যার থেকেও বেশি, বলছে জাতিসংঘের সবশেষ আনুমানিক হিসেব। খবর বিবিসি। ভারতে প্রতি ১০ বছর পর পর আদমশুমারি হয়। সে হিসেবে সবশেষ আদমশুমারি হবার কথা ছিল ২০২১ সালে, তবে তা বিলম্বিত করা হয়েছে। এ কারণে এ মুহূর্তে ভারতের কোনো হালনাগাদ করা সরকারি জনসংখ্যা উপাত্ত নেই। অন্যদিকে চীনে সবশেষ এবং দেশটির সপ্তম আদমশুমারি করা হয় ২০২০ সালে। ভারত এবং চীনের জনস্যখ্যা এখন কত এবং আগামীতে কত হবে তার ধারণা পাবার জন্য জাতিসংঘ বিভিন্ন ধরনের উপাত্তের ওপর নির্ভর করে।
এর মধ্যে আছে বিভিন্ন রেকর্ড জরিপ ও প্রশাসনিক তথ্য থেকে পাওয়া উর্বরতা, মৃত্যুহার এবং অভিবাসনের স্তর এবং হার। এটা স্পষ্ট যে ভারত এবং চীন, উভয় দেশের জনসংখ্যাই এখন ১৪০ কোটির ওপরে, আর তা ছাড়া গত ৭০ বছর ধরে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশেরও বেশি বাস করে এ দুটি দেশেই।
এমন সম্ভাবনা আছে যে চীনের জনসংখ্যা আগামী বছর থেকে কমতে শুরু করবে। গত বছর চীনে জন্মগ্রহণ করেছে ১ কোটি ৬ লাখ মানুষ, যা দেশটিতে একই বছরের মোট মৃত্যুর সংখ্যা থেকে সামান্য বেশি। এর কারণ চীনে উর্বরতার হার দ্রুত নেমে যাচ্ছে। ভারতেও সাম্প্রতিক দশকগুলোতে উর্বরতার হার বেশ বড় পরিমাণে কমে গেছে। ১৯৫০ সালে দেশটিতে নারীপিছু ৫.৭টি শিশুর জন্ম হতো,আর এখন তা নেমে এসেছে নারীপিছু ২টি শিশুতে। তবে এই হার কমছে খুবই ধীর গতিতে। এটা প্রায় নিশ্চিত যে আগামী আরও কয়েক দশক ধরে ভারতের জনসংখ্যা বাড়তে থাকবে। জাতিসংঘ মনে করছে যে ভারতের জনসংখ্যা সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছাবে ২০৬৪ সাল নাগাদ এবং তারপর তা ক্রমে ক্রমে কমতে থাকবে।
তাহলে, এই যে ভারত বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ হিসেবে চীনকে ছাড়িয়ে গেল, এর অর্থ কী? চীনে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমেছে ভারতের চেয়ে দ্রুতগতিতে চীনের ক্ষেত্রে বলা যায়, দেশটি ১৯৭৩ থেকে ১৯৮৩ এই দশ বছরে তাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২% থেকে কমিয়ে ১.১%-এ নামিয়ে এনেছে, অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক কমিয়ে ফেলেছে। জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞরা বলেন, চীন এটা করতে পেরেছে মানবাধিকারের ওপর জবরদস্তি করে। তারা দুটো পন্থা নিয়েছিল। একটি হলো দম্পতি-পিছু একটি মাত্র সন্তান নিশ্চিত করার অভিযান, আরেকটি হচ্ছে দেরিতে বিয়ে করানো। সন্তানের সংখ্যা কমানো এবং দুই সন্তানের মাঝখানে বিরতি দীর্ঘ করার এ অভিযান চালানো হয় এমন একসময় – যখন চীন প্রধানতঃ গ্রামীণ, অশিক্ষিত এবং দরিদ্র একটি দেশ ছিল। এ ছাড়া জনস্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বিনিয়োগ, নারীদের শিক্ষা, কর্মীবাহিনীতে নারীদের অংশগ্রহণ – এগুলোও ছিল আরো কিছু কারণ যা উর্বরতার হার কমার ক্ষেত্রে ভুমিকা রেখেছে।
স্বাধীনতার পর ভারতের জনসংখ্যা বেড়েছে তিনগুণ : ভারতের স্বাধীনতার পরের ছয় দশকে ভারতের জনসংখ্যা তিনগুণেরও বেশি বেড়েছে। ১৯৫১ সালে দেশটির জনসংখ্যা ছিল ৩৬ কোটি ১০ লাখ – আর ২০১১ সালে তা হয়েছে ১২০ কোটিরও বেশি। গত শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ভারতের জনসংখ্যা বেড়েছে খুবই দ্রুতগতিতে – প্রতি বছর প্রায় ২ শতাংশ করে। ক্রমান্বয়ে সেখানে মৃত্যুহার কমেছে, প্রত্যাশিত গড় আয়ু বেড়েছে, বেড়েছে আয়ও। বিশেষ করে শহরের বাসিন্দারা সহ বহু মানুষের নাগালে পরিষ্কার সুপেয় পানি এবং আধুনিক পয়বর্জ্য নিষ্কাশনের সুবিধা এসেছে। “তার পরও সেখানে জন্মহার ছিল অনেক উচ্চ” – বলছেন লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সের টিম ডাইসন। ভারত ১৯৫২ সালে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি চালু করে, আর প্রথমবারের মত জনসংখ্যা নীতি গ্রহণ করে ১৯৭৬ সালে। চীন ততদিনে সেদেশের জন্মহার কমিয়ে আনার চেষ্টায় ব্যস্ত।
কিন্তু ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থার সময় ভারতে জোরপূর্বক বন্ধ্যাকরণের কর্মসূচি নেওয়া হলে পরিবার পরিকল্পনার বিরুদ্ধে তীব্র বিরূপ সামাজিক প্রতিক্রিয়া হয়। অধ্যাপক ডাইসন বলছেন, এই জরুরি অবস্থা না ঘটলে ভারতে উর্বরতার হার কমানো দ্রুততর হতো, কিন্তু “পরবর্তী সব সরকারই পরিবার পরিকল্পনার ব্যাপারে হুঁশিয়ার হয়ে পা ফেলতে শুরু করে।“ পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশ যেমন দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান এবং থাইল্যান্ড জনসংখ্যা কর্মসূচি শুরু করেছিল ভারতের অনেক পরে। কিন্তু তারা ভারতের অনেক আগেই নিম্ন উর্বরতার হার, শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার কমানো, আয় বৃদ্ধি এবং মানবিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জন করেছে। ভারত এখন আর জনসংখ্যা ‘বিস্ফোরণের’ সম্মুখীন নয় ভারতের জনসংখ্যায় ১৯৪৭ সালের পর থেকে ১০০ কোটিরও বেশি মানুষ যুক্ত হয়েছে। আগামী আরও ৪০ বছর ধরে দেশটির জনসংখ্যা বাড়তেই থাকবে।
তবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার গত কয়েক দশক ধরেই কমছে। ভারত জনসংখ্যার কারণে একটা বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে যাচ্ছে এমন যে পূর্বাভাস আগে দেওয়া হতো, তা এখন ভুল প্রমাণিত হয়েছে। জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ কারণেই ভারতের লোকসংখ্যা যে চীনের চাইতেও বেশি তা আর কোন উদ্বেগের ব্যাপার নয়। ভারতে এখন আয় বাড়ছে, স্বাস্থ্যসুবিধা ও শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধির ফলে দেশটির নারীরা আগের চাইতে কম সন্তান নিচ্ছেন। এর ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির উর্ধ্বমুখী রেখাটা অনেকটা আনুভূমিক হয়ে এসেছে। বর্তমানে ভারতের ২২টি রাজ্যের ১৭টিতেই উর্বরতার হার ‘রিপ্লেসমেন্ট স্তরের’ নিচে নেমে এসেছে (রিপ্লেসমেন্ট স্তর মানে হচ্ছে একটা দেশের জনসংখ্যাকে ধরে রাখার জন্য যে পরিমাণ নতুন জন্ম হওয়া দরকার – ভারতের ক্ষেত্রে এটা হচ্ছে নারী প্রতি দুটি শিশু)। পিউ রিসার্চ সেন্টারের মতে ভারতের সবগুলো ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যেই উর্বরতার হারে বড় রকমের অধোগতি দেখা যাচ্ছে। ভারতের ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেল্থ সার্ভে এবং আদমশুমারির উপাত্ত থেকেই এটা স্পষ্ট হয়েছে। এর ফলে ভারতের জনসংখ্যায় ১৯৫১ সালে ধর্মীয় জনগোষ্ঠীগুলোর অনুপাত যেমন ছিল, তাতে খুব বড় কোন পরিবর্তন হয়নি বলে দেখা যাচ্ছে।
ভারতের অধিকতর জনবহুল উত্তরাঞ্চলের তুলনায় দক্ষিণাঞ্চলে জন্মহারের নিম্নগতি দ্রুততর হতে দেখা গেছে। অধ্যাপক ডাইসন বলছেন, “এটা দুঃখের ব্যাপার যে কেনো ভারতের আরও বেশি অঞ্চল দক্ষিণ ভারতের মতো হতে পারেনি। অবস্থা একই রকম হলেও উত্তর ভারতের কিছু অংশে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি জীবনযাত্রার মানের অবনতিতে ভুমিকা রেখেছে। চীনকে জনসংখ্যায় ছাড়িয়ে যাওয়াটা তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে যেমন বলা যেতে পারে যে, জনসংখ্যার দিক থেকে এক নম্বরে উঠে যাওয়ায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী আসন পাবার জন্য ভারতের দাবি এখন জোরালো হয়ে উঠতে পারে।
ভারত জাতিসংঘের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা দেশ এবং তারা অনেক দিন থেকেই নিরাপত্তা পরিষদে তাদের একটি স্থায়ী আসন পাওয়াকে ন্যায়সঙ্গত বলে দাবি করে চলেছে। জাতিসংঘের অর্থনীতি ও সামাজিক বিষয়ক বিভাগের একজন পরিচালকজন উইলমথ বলছেন, বিশ্বের বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ হিসেবে একটি দেশ এরকম দাবি করতেই পারে। মুম্বাইভিত্তিক জনসংখ্যা বিজ্ঞান বিষয়ক আন্তর্জাতিক ইনস্টিটিউটের পরিচালক কে এস জেমস বলছেন, ভারতের জনসংখ্যায় যেসব পরিবর্তন আসছে তা গুরুত্ববহ। অধ্যাপক জেমস বলছেন, নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে ভারত যেভাবে জনগোষ্ঠীর উত্তরণ ঘটিয়েছে, এবং ব্যাপক দারিদ্র্য ও অশিক্ষা সত্ত্বেও গণতন্ত্রের ভেতরে পরিবার পরিকল্পনাকে ব্যবহার করেছে তা কিছু প্রশংসার দাবিদার।
তিনি বলছেন, অন্য অনেক দেশই এটা অর্জন করতে পেরেছে উচ্চ সাক্ষরতা ও জীবনমানের উন্নতি সাধনের পর। আরেকটি ভালো খবর হচ্ছে, পৃথিবীতে ২৫ বছরের কমবয়স্ক প্রতি পাঁচ জনের একজন হচ্ছে ভারতীয় এবং ৪৭% ভারতীয়েরই বয়স হচ্ছে ২৫ এর কম। ভারতের দুই তৃতীয়াংশেরই জন্ম হয়েছে ১৯৯০ দশকের শুরুর দিকে অর্থনীতির উদারীকরণের পর। অর্থনীতিবিদ শ্রুতি রাজাগোপালন বলেন, তরুণ ভারতীয়দের বেশ কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য আছে।
“তরুণ ভারতীয়দের এই প্রজন্মটি জ্ঞান ও নেটওয়ার্কভিত্তিক অর্থনীতির সবচেয়ে ভোক্তা এবং শ্রমশক্তির উৎস। বৈশ্বিক প্রতিভার সবচেয়ে বড় একটি অংশই হবে ভারতীয়। “ভারতের সামনে গুরুতর কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে একটা গুরুতর চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কর্মসংস্থান। ভারতের কর্মক্ষম বয়সের জনগোষ্ঠীর মাত্র ৪০ শতাংশ কাজ করছে বা করতে চায়, বলছে সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি (সিএমআইই) নামে একটি প্রতিষ্ঠান। জনসংখ্যার সুফল লাভ করতে হলে ভারতকে তরুণ কর্মক্ষম তরুণদের জন্য যথেষ্ট সংখ্যক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে।
অভিবাসনও একটি সমস্যা। প্রায় ২০ কোটি ভারতীয় দেশের ভেতরে অভিবাসী হয়েছে, এক রাজ্য বা জেলা থেকে আরেক জায়গায়। বেশির ভাগই কাজের সন্ধানে গ্রাম ছাড়ছে। তাদের সংখ্যা নিশ্চয়ই আগামী দিনগুলোতে বাড়বে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতকে শিশু-বিবাহ, অল্প বয়সে বিবাহও বন্ধ করতে হবে এবং জন্ম ও মৃত্যু যথাযথভাবে নিবন্ধিত করতে হবে। ভারতে যে মেয়ে শিশুর চাইতে ছেলে-শিশু বেশি জন্মাচ্ছে সেটাও একটা সমস্যা। “জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ” নিয়ে রাজনৈতিক কথাবার্তার লক্ষ্য মুসলিমরা (ভারতের বৃহত্তম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়) বলেই মনে হয়। কিন্তু বাস্তবে পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক গবেষণায় দেখা যায়, ভারতের ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সন্তানধারণের হারের পার্থক্য আগের চাইতে অনেক কমে গেছে।
বাড়ছে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা : বিশেষজ্ঞরা বলেন ভারতে বয়স্কদের সংখ্যাবৃদ্ধির দিকে তেমন মনোযোগ দেওয়া হয়না। ১৯৪৭ সালে দেশটির জনসংখ্যার মাত্র ৫% ছিলেন ৬০ এর বেশি বয়সের। এখন সে হার ১০% এর বেশি। জাতিসংঘ অনুমান করছে ২০২৩ থেকে ২০৬০এর মধ্যে চীনে ৬৫ এর বেশি বয়স্ক লোকের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাবে। ভারতের ক্ষেত্রে তা হবে দ্বিগুণেরও বেশি। জাতিসংঘ বলছে, এর ফলে এ দেশগুলোর স্বাস্থ্যসেবা এবং সামাজিক বীমা ব্যবস্থার সক্ষমতার প্রতি বড় রকম চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হবে।
আরও পড়ুন
গাজায় গত একদিনে নিহত ৫২
তীব্রতর হচ্ছে ইসরায়েলি হামলায় লেবাননে যুদ্ধ
হারিকেন হেলেনে যুক্তরাষ্ট্রে অন্তত ৯০ জনের মৃত্যু