নিজস্ব প্রতিবেদক:
সাঁড়াশি অভিযান শুরুর তিন বছরের মধ্যে দেশে মাদক উদ্ধার ও জব্দের পরিসংখ্যান অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। গত বছরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে দেশে ইয়াবা, বিদেশি মদ, হেরোইন, গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদকের ব্যবহার ও চোরাচালান বেড়েছে অনেক। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, যে পরিমাণ মাদক জব্দ হয়, তা দেশে ঢোকা মাদকের দশ শতাংশ। বাকি নব্বই শতাংশই ধরা পড়ে না। আন্তর্জাতিকভাবে এভাবেই হিসাব করা হয়। ২০১৮ সালের মে থেকে পরের বছরজুড়ে দেশের সবকটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান একযোগে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ‘বন্দুকযুদ্ধে’ প্রাণহানী হয় অনেকের। দেশ-বিদেশে এই অভিযান নিয়ে সমালোচনাও কম হয়নি। তবে এরপরও কাক্সিক্ষত ফল আসেনি। অভিযানের দুই-তিন বছর পর মাদক উদ্ধারের পরিসংখ্যান দিচ্ছে সেই ইঙ্গিত।
পুলিশ, কোস্ট গার্ড, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), র্যাব ও মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর মিলে গত বছর (২০২১ সালে) ইয়াবা উদ্ধার করে ৫ কোটি পিসেরও বেশি যা ২০২০ সালে ছিল সাড়ে তিন কোটি পিস, ২০১৯ সালে ছিল তিন কোটি পিস। এদিকে শুধু বিজিবি’র ২০২১ সালে (জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত) দেশের সীমান্ত এলাকাসহ অন্যান্য স্থানে চালানো অভিযানে উদ্ধার হয় ২ কোটি ২৪ লাখ ৪০ হাজার ৯ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, ৩ লাখ ৩১ হাজার ৭৮৫ বোতল ফেনসিডিল, ২ লাখ ১৩ হাজার ৯৮৯ বোতল বিদেশি মদ, ৩ হাজার ২৬৮ লিটার বাংলা মদ, ১ লাখ ৩১ হাজার ৮৯৯ ক্যান বিয়ার, ১৯ হাজার ৪৯২ কেজি গাঁজা, ১৩৯ কেজি হেরোইন, ২ লাখ ২৪ হাজার ৬৫৭টি নেশা জাতীয় ও উত্তেজক ইনজেকশন, ২ লাখ ৩৭ হাজার ৫০৬টি এ্যানেগ্রা/সেনেগ্রা ট্যাবলেট, ৬৮ হাজার ৪৭টি ইস্কাফ সিরাপ, ৭ হাজার ১৬৯টি এমকেডিল/কফিডিল, এবং ৬ লাখ ৯২ হাজার ১৮৪টি অন্যান্য ট্যাবলেট।
মাদকের চোলাচালন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতাও। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), র্যাপিড একশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডÑএ সব সংস্থা ২০২১ সালে মাদকের বিরুদ্ধে প্রায় ৮৭ হাজার অভিযান চালিয়েছে। গড়ে প্রতি মাসে প্রায় আট হাজার অভিযান চালানো হলেও কমানো যাচ্ছে না মাদকের আনাগোনা। এর মাঝে বেড়ে চলেছে গাঁজা ও ইয়াবার আমদানি। নতুন করে মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে আইস তথা ক্রিস্টাল মেথ। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলোর সূত্রে জানা গেছে, গত বছর মাদকবিরোধী অভিযানে উদ্ধার করা হয় ৪ কোটি ৮৩ লাখ ৮৩ হাজার ৯০৬ পিস ইয়াবা, ৪১৫ কেজি হেরোইন, দেড় কেজি কোকেন, ৬৯ কেজি আফিম, ৭৫ হাজার ৯৮০ কেজি গাঁজা, ৫ লাখ ৩২ হাজার ৭৩০ বোতল ফেনসিডিল, ২ লাখ ৫ হাজার ৩১৪ বোতল বিদেশি মদ ও ৮৯ হাজার ৭৪টি ইনজেকটিং ড্রাগ। র্যাবের অভিযানে এখন পর্যন্ত ১৯ কেজি আইস উদ্ধার হয়েছে। কোস্টগার্ড উদ্ধার করেছে ১ কেজি আইস। ২০২১ সালে প্রায় ১৩ কেজি আইস তথা ক্রিস্টাল মেথ উদ্ধার করেছে বিজিবি। এ ছাড়া মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর উদ্ধার করেছে ৪ কেজি আইস।
সূত্রমতে, ২০২১ সালে ৮৬ হাজার ২৮৪টি অভিযানে গ্রেফতার হয় ১ লাখ ১২ হাজার ৬০৩ জন। ২০২০ সালে ৮৫ হাজার ৭১৮টি অভিযানে গ্রেফতার ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৪৩ জন। ২০১৯ সালে ১ লাখ ২৪ হাজার ৯৮টি অভিযানে গ্রেফতার হয় ১ লাখ ৬২ হাজার ৮৪৭ জন। ২০২১ সালে ইয়াবা উদ্ধার হয় ৪ কোটি ৮৩ লাখ ৮৩ হাজার ৯০৬ পিস। ২০২০ সাথে উদ্ধার ছিল ৩ কোটি ৬৩ লাখ ৮১ হাজার ১৭ পিস। ২০১৯ সালে ৩ কোটি ৪ লাখ ৪৬ হাজার ৩২৮ পিস। ২০২১ সালে হেরোইন উদ্ধার হয় ২১৬ কেজি। ২০২০ সালে ২১১ কেজি। ২০১৯ সালে ৩২৪ কেজি। ২০২১ সালে গাঁজা উদ্ধার হয় ৭৫ হাজার ৯৭৯ কেজি। ২০২০ সালে ৫০ হাজার ৭৯ কেজি। ২০১৯ সালে ৩২ হাজার ৬৫৭ কেজি। ৫ লাখ ৩২ হাজার ৭৩০ বোতল ফেন্সিডিল উদ্ধার হয় ২০২১ সালে। ২০২০ সালে ১০ লাখ ৭ হাজার ৯৭৭ বোতল ও ২০১৯ সালে উদ্ধার হয় ৯ লাখ ৭৬ হাজার ৬৬৩ বোতল।
অভিযানের পরও মাদক ব্যবহারের ঊর্ধ্বগতির কারণ সম্পর্কে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মো. আবদুর রশীদ বলেন, আমরা মাদক চোরচালানারে চেইনটি ভাঙতে পারিনি এখনও। পাশের দেশ মিয়ানমারও আমাদের সহযোগিতা করছে না। তাদের বাহিনীর কর্মকর্তারাও মাদক চোরাচালানের মাধ্যমে লাভবান হয়। সেখানকার বিচ্ছিন্ন গ্রুপগুলোও আয় করছে। তারা সবাই বাংলাদেশে ইয়াবা পাচার করার চেষ্টা করে। চোরাকারবারিদেরও সহযোগিতা করে। সঙ্গে আমাদের দেশের সরবরাহকারীরাও তৎপর। তাই মাদকের বাজার ঊর্ধ্বমুখী। তার মতে, আমরা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছি। তবে মাত্রাতিরিক্ত নয়। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
২০১৮ সালের ৩ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান শুরু হয়। এসব অভিযানে বিপুল পরিমাণ মাদক উদ্ধার করা হয়। পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর দেশজুড়ে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে। ২০১৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মাদকের বিরুদ্ধে তীব্র অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ সময় ‘ক্রসফায়ারে’ মারা যায় ৪৯৬ মাদক ব্যবসায়ী। এর মধ্যে পুলিশের সঙ্গে ২৮৬ জন, র্যাবের সঙ্গে ১৪১ জন, বিজিবির সঙ্গে ৪১ জন, গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে ২৩ জন এবং অজ্ঞাতদের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যায় ৫ জন। সম্প্রতি মাদকের বিরুদ্ধে আবারও বড় অভিযান নিয়ে ভাবছে সরকার।
এসব বিষয়ে মাদক দ্রব্য অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আবদুস সবুর মন্ডল জানান, মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের জিরো টলারেন্স নীতি অব্যাহত রয়েছে। নাগরিকদের নিয়ে গণআন্দোলন ও সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা করছি। মাদক আমাদের নতুন প্রজন্মের শত্রু। এটিকে প্রতিহত করতেই হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশ পুলিশ সদর দফতরের গণমাধ্যম শাখার এআইজি মো. কামরুজ্জামান বলেন, মাদক নিয়ন্ত্রণ একটি চলমান প্রক্রিয়া। এর বিরুদ্ধে আমরা জিরো টলারেন্স নীতিতে চলি। কারবারিরা যতই কৌশল নিয়ে থাকুক গোপন তথ্যের ভিত্তিতে তাদের গ্রেফতার করছি। এদিকে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, র্যাব মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার পাশাপাশি সচেতনতামূলক কার্যক্রমও চালিয়ে আসছে। কারবারিদের ওপর নজরদারিও অব্যাহত আছে। আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদক নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সীমান্তে নজরদারি বাড়াতে। তা না হলে নানা ফাঁকফোকর দিয়ে দেশে মাদক ঢুকবেই। মাদক নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। শুধু বাহককে ধরে মাদক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। পেছনে যারা জড়িত তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে হবে।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ