April 24, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Tuesday, September 28th, 2021, 8:29 pm

জাতীয় অর্থনীতির প্রাণপ্রবাহী কর্ণফুলী নদীর মুমূর্ষু অবস্থা

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

দশ হাজার বছরের পুরনো ঐতিহাসিক নদী কর্ণফুলী। প্রাক ইসলামিক যুগে আরব বণিকেরা ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের সাথে ব্যবসাবাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে যে বন্দর ব্যবহার করত, তা ছিল কর্ণফুলী মোহনার চট্টগ্রাম বন্দর। তাই সে সময়ের বিখ্যাত কবি ইমরুল কায়েস তার একটি কসিদায় ‘করণফুল’-এর নাম উল্লেখ করেছেন।
কর্ণফুলী তার অববাহিকার সব মানুষকে বুকে ধারণ করে আছে হাজার হাজার বছর ধরে। সুতরাং কর্ণফুলীর ইতিহাস মানে মানবজাতির ইতিহাস, মানবজাতিকে লালন করার ইতিহাস। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক সব দিক থেকে কর্ণফুলী ঐতিহ্যবাহী। ইতিহাসে কিংবদন্তি।
আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে পাহাড়-পর্বত ও গভীর অরণ্যে ঘেরা মিজোরাম রাজ্যের বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত লুংলেই জেলা। জেলা সদর থেকে ৯৫ কিলোমিটার দূরে পাহাড় ঘেরা থানাটি হচ্ছে টলাবুং (দেমাগ্রি)। টলাবুং বা দেমাগ্রির লুসাই পাহাড় থেকে আন্তর্জাতিক নদী কর্ণফুলীর উৎপত্তি। সেখান থেকে সুউচ্চ পাহাড় শ্রেণী অতিক্রম করে থেগামুখ হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটির বরকল উপজেলার থেগামুখ থেকে বড় হরিণার মুখ পর্যন্ত ছয় কিলোমিটার কর্ণফুলীর ডান পাশে রয়েছে ভারত এবং বাম পাশে বাংলাদেশ। হরিণা মুখের পর থেকে কর্ণফুলী সম্পূর্ণ বাংলাদেশের। উতলা খর¯্রােতা পাহাড়ি নদী কর্ণফুলী বাংলাদেশের সীমান্ত অতিক্রম করে বঙ্গোপসাগরে পতিত হতে ১৮৭ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেছে। উল্লেখ্য, কর্ণফুলীর দৈর্ঘ্য ৩২০ কিলোমিটার। এর মধ্যে বাংলাদেশ অংশের দৈর্ঘ্য ২৭৫ কিলোমিটার। কর্ণফুলীর উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত দীর্ঘ পথজুড়ে দু’কূলে গড়ে উঠেছে নানা জনপদ ও নগরসভ্যতা। এ নদীর মোহনায় সৃষ্টি হয়েছে এক অভূতপূর্ব পোতাশ্রয়ের। চট্টগ্রাম মহানগরী থেকে ১৭ কিলোমিটার এগিয়ে কর্ণফুলী মিশেছে বঙ্গোপসাগরে। একে জাতীয় অর্থনীতির প্রাণপ্রবাহী বলা হয়।
কিন্তু জাতীয় অর্থনীতির প্রাণপ্রবাহী কর্ণফুলি নদী অবৈধ দখলে ছোট হয়ে গেছে কর্ণফুলী নদী। একসময়ের বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু চকবাজার, ঘাটফরহাদবেগ এলাকার পাশ দিয়ে যাওয়া চাক্তাই খালটি এখন নালাসদৃশ। নৌকা নয়, এখানে সব সময় ভাসমান অবস্থায় থাকে আবর্জনা। বেড়েছে নদী ও সংলগ্ন খালের দূষণ। এর দায় যতটা প্রকৃতির, তার চেয়ে বেশি দখলদারদের। উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও নদীর পার পুরোপুরি অবৈধ দখলমুক্ত করা যায়নি। আড়াই বছর আগে উচ্ছেদের উদ্যোগ নিলেও মাঝপথে তা থেমে যায়।
হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের আইনজীবী মনজিল মোরসেদের একটি রিটের পর হাইকোর্ট কর্ণফুলীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ দেন ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট। এর আগের বছর হাইকোর্টের নির্দেশে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন নদীপারের ২ হাজার ১১২টি অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করে প্রতিবেদন দিয়েছিল।
গত ২৬ আগস্ট জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন নদীর সীমানা নির্ধারণ করে চাক্তাই ও রাজাখালী খালের মোহনাসহ কর্ণফুলী নদীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ দিয়েছে। চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কমিশনের সচিব মো. আমিনুল ইসলাম এ নির্দেশনা দেন।
কর্ণফুলী নদীর নামকরণের ইতিহাসঃ কর্ণফুলি নদীর নামের উৎস সম্পর্কে বিভিন্ন কাহিনি প্রচলিত আছে। কথিত আছে যে, আরাকানের এক রাজকন্যা চট্টগ্রামের এক পাহাড়ি রাজপুত্রের প্রেমে পড়েন। এক জ্যোৎস্নাত রাতে তারা দুই জন এই নদীতে নৌভ্রমণ উপভোগ করছিলেন। নদীর পানিতে চাঁদের প্রতিফলন দেখার সময় রাজকন্যার কানে গোঁজা একটি ফুল পানিতে পড়ে যায়। ফুলটি হারিয়ে কাতর রাজকন্যা সেটা উদ্ধারের জন্য পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিন্তু প্রবল ¯্রােতে রাজকন্যা ভেসে যান, তার আর খোঁজ পাওয়া যায় নি। রাজপুত্র রাজকন্যাকে বাঁচাতে পানিতে লাফ দেন, কিন্তু সফল হন নি। রাজকন্যার শোকে রাজপুত্র পানিতে ডুবে আত্মাহুতি দেন। এই করুণ কাহিনি থেকেই নদীটির নাম হয় কর্ণফুলী। মধ্যযুগীয় পুঁথিতে নদীটিকে কাঁইচা খাল লিখা হয়েছে। মার্মা উপজাতিদের কাছে নদীটির নাম কান্সা খিওং এবং মিজোরামে কর্ণফুলীর নাম খাওৎলাং তুইপুই।
ক্রমাগত ছোট হচ্ছে কর্ণফুলীঃ চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন নামে একটি সংগঠন গত বছর কর্ণফুলীর বিভিন্ন স্থানে জরিপকাজ চালায়। তাতে দেখা যায়, শাহ আমানত সেতু এলাকায় জোয়ারের সময় প্রস্থ ৫১০ মিটার। ২০১৪ সালে এডিবির পরিমাপ অনুযায়ী, সেতু এলাকায় নদীর প্রস্থ ছিল ৮৮৬ মিটার। চাক্তাই খালের মুখে প্রস্থ ছিল ৮৯৮ মিটার, পরে কমে হয়েছে ৪৩৬ মিটার। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আলীউর রহমান বলেন, দখল ও দূষণের কারণে নদী ছোট হয়ে আসছে। দখল-উচ্ছেদের জন্য নদী কমিশনে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক ইদ্রিস আলীর কর্ণফুলীর ওপর একটি গবেষণা প্রতিবেদন নর্থ আমেরিকান রিসার্চ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর ভাষ্য, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী দখল ও দূষণে জড়িত। দখলের কারণে দিন দিন নদীর প্রশস্ততা কমেছে। এ ছাড়া অপরিকল্পিত খননও রয়েছে। আর জনগণের সচেতনতার অভাবে পলিথিনের স্তর পড়েছে কর্ণফুলীর তলদেশে।
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথম উচ্ছেদ শুরু হয়। সদরঘাট ও মাঝিরঘাটে ২০ একর জমি উদ্ধার করা হয়। এরপর ২০২০ সালে বন্দর কর্তৃপক্ষ লালদিয়ার চর এলাকায় উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু করে। তাদের উচ্ছেদ কার্যক্রম প্রায় শেষ পর্যায়ে। তবে কর্ণফুলী নদীর তৃতীয় সেতুর আশপাশে জেগে ওঠা চর দখল করে গড়ে ওঠা বস্তিতে বুলডোজার পড়েনি এখনো।
দখলের ব্যাপারে বস্তিবাসীদের অভিযোগ সরকারি দলের কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে।
কর্ণফুলীর বেহাল দশা দেখে চট্টগ্রামবাসীর উদ্বেগ উৎকণ্ঠার সীমা না থাকলেও নির্লিপ্ত প্রশাসন। হাজার হাজার কোটি টাকার বড় প্রকল্প অথবা ব্যাংক থেকে লোপাট হলেও কর্ণফুলী দখলমুক্ত করতে মাত্র এক কোটি ২০ লাখ টাকার বন্দোবস্ত হচ্ছে না। নদীর যেন কোনো মালিক নেই। মানব সৃষ্ট দূষণ, শিল্পকারখানার বর্জ্য এবং অবৈধ দখলাদারিত্বে কর্ণফুলী দিন দিন হচ্ছে শীর্ণ, দেখার কেউ নেই। কর্ণফুলীর প্রাণসঞ্চারণী ১৩টি খালসহ ৫৪টি ছোট-বড় খালের বেশির ভাগই দখল অথবা নানা অত্যাচারে বিলীন হয়ে গেছে। কর্ণফুলীর দুই তীরে গড়ে উঠেছে শিল্পাঞ্চল। শিল্প কারখানাগুলোর ৯০ শতাংশ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইউনিট বা বর্জ্য নিষ্কাশনের পরিবেশবান্ধব কোনো ব্যবস্থা নেই।
ছোট-বড় দুই শতাধিক প্রতিষ্ঠানের বিষাক্ত বর্জ্য কর্ণফুলী ও হালদাতে গড়াচ্ছে। পরিবেশ অধিদফতর বলছে, চট্টগ্রামের টিএসপি সারকারখানা, চন্দ্রঘোনার কর্ণফুলী কাগজ মিল, চট্টগ্রাম শহরের কাছে কালুরঘাট, নাসিরাবাদ, ভাটিয়ারি, বাড়বকু-, পতেঙ্গা, ফৌজদারহাট, কাপ্তাই ও ষোলশহর এলাকায় অবস্থিত ১৯টি চামড়াশিল্প, ২৬টি বস্ত্রকল, দু’টি রাসায়নিক কারখানা, একটি তেল শোধনাগার, পাঁচটি মৎস্য প্রক্রিয়াকরণ কারখানা, একটি ইস্পাত মিল, একটি পেপার রেয়ন মিল, আটটি সাবান কারখানা, চারটি রঙের কারখানা ও দু’টি সিমেন্ট কারখানার বর্জ্য প্রতিনিয়ত কর্ণফুলীকে মারাত্মকভাবে দূষিত করে চলেছে। এসব মিল কারখানার বর্জ্যরে মধ্যে উল্লেখযোগ্য সায়ানাইড, ক্রোমিয়াম, পারদ ও ক্লোরিনসহ নানা প্রকারের এসিড, সিসা, দস্তা, ক্যাডিয়াম, নিকেল, ফসফোজিপসাম, লোহা প্রভৃতি ক্ষতিকারক রাসায়নিক দ্রব্য। এগুলো শুধু মানবদেহ নয়, জীববৈচিত্র্যের জন্যও মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনবে। কিভাবে বা কোথায় এসবের প্রতিবিধান হবে তা কারো জানা নেই। প্রতিদিন ৩০০ টনের বেশি তরল, কঠিন, তৈলাক্ত, ধাতব, পচন ও অপচনশীল অপরিশোধিত বর্জ্য আটটি খালের (রাজাখালি, মহেশখাল, মনোহরখালি, বামুনি, গুপ্ত, গয়না, চাক্তাই, ফিরিঙ্গিবাজার) মাধ্যমে কর্ণফুলীতে গিয়ে পড়ছে। কাপ্তাই নতুন বাজার থেকে মোহনার মাথা পর্যন্ত ৮৮.৫ কিলোমিটার কর্ণফুলী তীরবর্তী ছোট-বড় ৪০টি বাজারের মওসুমি ফল ও ফলের উচ্ছিষ্টসহ খোলা লেট্রিন, হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগলের মল ও মৃতদেহ এককথায় সব ধরনের ময়লা আবর্জনা বিভিন্নভাবে কর্ণফুলীতেই ফেলা হচ্ছে। চট্টগ্রাম শহরের গৃহস্থালির প্রায় ৪০ শতাংশ বর্জ্য ও পাহাড় ধসের মাধ্যমে কর্ণফুলী ভরাট হচ্ছে। দূষিত হচ্ছে নদীটির পানিও।
কর্ণফুলী নদী গবেষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরীয়া ইনকিলাবকে জানান, কর্ণফুলী সুরক্ষায় এ মুহূর্তে দু’টি বিষয় জরুরী। এক. দূষণরোধ এবং দুই. অবৈধ দখলকৃত স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সাবেক একজন প্রধান প্রকৌশলী বলেন, কর্ণফুলী ভরাট করে ভূমির ব্যবসা চলছে। চট্টগ্রাম মহানগরীতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও জমির দাম বৃদ্ধির সুবাদে জমির ব্যবসা লাভজনক হওয়ায় এই অপতৎপরতাও বেড়ে গেছে। এর পরিপ্র্রেক্ষিতে কর্ণফুলী মোহনায় ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ মূল নেভিগেশনাল চ্যানেলে নিয়মিত ড্রেজিং পরিচালনা এবং উজানের দিকে হালদার চর পর্যন্ত অনতিবিলম্বে স্থায়ীভাবে তীর রেখা নির্ধারণ, রিভার ট্রেনিং ওয়াল নির্মাণ করা অত্যন্ত জরুরী। অতীতে কর্ণফুলী ছাড়াও উজানে হালদা নদী পর্যন্ত নিয়মিত ড্রেজিং করা হতো। বন্দরের হাইড্রোগ্রাফি বিভাগ এবং রিভার ট্রেনিং ইনস্টিটিউটকে আরও সক্রিয় করা দরকার।
চট্টগ্রামের বিশিষ্ট পরিবেশবাদীদের মতে, দখল, ভরাট ও দূষণের কবলে পড়ে কর্ণফুলী বিপন্ন অবস্থায় পড়েছে। ১৭০ কি.মি. দীর্ঘ গতিপথের কর্ণফুলী নদীর বিশেষ ভাটিতে অবৈধ দখলের মাত্রা ব্যাপক। অতীতের যাবতীয় ভূমি সংক্রান্ত দলিলাদির ভিত্তিতে কর্ণফুলী নদীর তীর চিহ্নিত করা, প্রয়োজনীয় গাইডওয়াল নির্মাণ অপরিহার্য হয়েছে। তাছাড়া অপরিকল্পিত ও যথেচ্ছ বালি উত্তোলন বন্ধ করে নদীর সুরক্ষা প্রয়োজন।
উল্লেখ্য,কর্ণফুলী শুধু চট্টগ্রামবাসীর নয়, এটি সমগ্র দেশের প্রাণভোমরা। যেকোনো মূল্যে কর্ণফুলীকে দখল-দূষণমুক্ত করে তার প্রবাহ বহমান রাখতে হবে। কর্ণফুলীর ¯্রােত, নাব্যতা ও পানি আমাদের অর্থনীতির প্রাণ। এ নদীর প্রতি দায়িত্বশীল হওয়া, নদীকে জীবন্ত রাখা দেশের সমৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত জরুরি।
পরিশেষে আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ান নেতা জেরেনিমোর অসাধারণ কথাটি উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, ‘যখন শেষ গাছটি কাটা হবে, শেষ মাছটি ধরা হবে এবং শেষ নদীটির পানি বিষাক্ত হবে; তখন আমরা বুঝতে পারব, টাকা খেয়ে বেঁচে থাকা যায় না।’