November 18, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Wednesday, April 3rd, 2024, 9:34 pm

জুড়ী বাজারের বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে হাকালুকি হাওর

জেলা প্রতিনিধি, মৌলভীবাজার:

জুড়ী নদী এখন ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। জুড়ী কামিনীগঞ্জ ও ভবানীগঞ্জ বাজার কোনোটিতেই নেই কোন নির্দিষ্ট ময়লা ফেলার ডাস্টবিন। যার ফলে, বর্জ্য ফেলা হয় নদীতে। এতে নদী তার পরিবেশের ভারসাম্য হারাচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জুড়ী নদী শহরের মধ্যেদিয়ে বয়ে যাওয়ার কারণেই ভবানীগঞ্জ ও কামিনীগঞ্জ বাজার বিভক্ত করেছে। কামিনীগঞ্জ ও ভবানীগঞ্জ বাজার দুটি নদীর দুপাশে অবস্থিত। কোনোটিতেই নেই নির্দিষ্ট ময়লার কোন ডাস্টবিন। যার কারণে শহরের সকল উচ্ছিষ্ট ময়লা, আর্বজনা, প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্রীজের উপর দিয়ে ফেলা হয় নদীতে। এতে করে বৃষ্টির পানিতে ভেসে ময়লা আর্বজনা, প্লাস্টিক ও পলিথিন হাকালুকি হাওরে গিয়ে নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও হুমকির মুখে পড়ছে জীববৈচিত্র্য।

সরেজমিনে দেখা গেছে, হাকালুকি হাওরের প্রবেশ পথ কন্ঠিনালা রাবার ড্রামের পাশে জুড়ী নদীর একটি শাখা। তার এক পাশে চাতলা বিল অন্যপাশে কৃষি ফসলি মাঠ। সেখানে জমা হয়ে আছে বেশ কিছু প্লাস্টিক ও পলিথিনের স্তুপ। আর সেই স্তুপের আশপাশে প্রায় ভেসে উঠে বিভিন্ন ধরণের মরা প্রাণী। এতে চারপাশে দূর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। উজান থেকে ভেসে আসা এসব বর্জ্য প্রতিনিয়ত পরিবেশ দূষণ করছে।

এছাড়াও জুড়ী-ফুলতলা সড়কের উপর নির্মিত ব্রীজের নিচেও রয়েছে ময়লা আবর্জনার একটি বড় স্তুপ। এসব ময়লা আবর্জনা পানিতে ভেসে হাকালুকি হাওরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য রয়েছে হুমকির মুখে।

জানা যায়, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে থেকে জুড়ী নদীর উৎপত্তি। নদীটি ফুলতলা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে উপজেলা সদরের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে হাকালুকি হাওর হয়ে কুশিয়ারা নদীতে গিয়ে মিলেছে।হাকালুকি হাওরের অবস্থান মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলার মোট ৫টি উপজেলার অংশ নিয়ে ১৮১ দশমিক ১৫ বর্গকিলোমিটার জলাভূমি এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। এখানে ছোট বড় ২৭৩ বিল ১০টি নদী ও অসংখ্য খাল রয়েছে। সরকার ১৯৯৯ সালে হাকালুকি হাওরকে পরিবেশগত ভাবে সংকটপূর্ণ এলাকা ঘোষণা করে। তবে হাওরের পরিবেশ বেশ কয়েক বছর থেকে রয়েছে চরম বিপর্যয়ের মুখে। পরিবেশের বিরূপ প্রভাব বিস্তারকারি নানা ধরনের উপাদনের কারণে বর্তমানে হাওরের পরিবেশ এখন প্রায় ধ্বংসের ধার প্রান্তে। দিন যতই গড়াচ্ছে, ততই প্রভাব পড়ছে প্রকৃতির উপর। নানান চাপে এখন পরিবেশ এমন বিপর্যস্ত। এর মধ্যে রয়েছে আবার পরিবেশ ধ্বংসকারি নানান প্রকারের বস্তু যেমন প্লাস্টিক, পলিথিন, পানি শোষণকারী বিদেশি জাতের পরিবেশ ধ্বংসকারি বিভিন্ন রকম গাছ, যেমন ইউক্লিপটাস ও আকাশমণির মতো বিভিন্ন ধরনের গাছ ও কার্বন নিঃসরণকারি নানামুখী প্রকল্প, গাড়ির কালো ধোঁয়াসহ আরও বিভিন্ন উপাদান।

পাথারিয়া বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ টিমের সদস্য ও পরিবেশকর্মী লুৎফুর রহমান শাহান বলেন, দেশে ২০০২ সালে পলিথিন উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বর্তমানে পলিথিনের ব্যবহার দেখলে বুঝার কোন উপায় নেই যে এদেশে পলিথিন নিষিদ্ধ! ভয়ানক এ পলিথিন বর্তমানে আমাদের পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও জলজ প্রাণীর জন্য এক বিপদজনক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করে এর বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি।

জুড়ী নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ী ওসমান গনি বলেন, ময়লা, পলিথিন ও প্লাস্টিক এগুলো নিয়ে আমাদের বাজার কমিটি, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, কারো কোন মাথা ব্যথা নেই। কোনমতে দোকান কিংবা মার্কেটের ময়লা আবর্জনা প্লাস্টিক বর্জ্যগুলো যেখানে সেখানে ফেললেই হল। তাই সবাইকে এখনই সচেতন হতে হবে, দায়িত্ব নিয়ে যেখানে সেখানে ময়লা আর্বজনা ফেলা থেকে বিরত থাকতে হবে।

জুড়ী কামিনীগঞ্জ বাজার ব্যবসায়ী কমিটির সাধারণ সম্পাদক নুরুল আম্বিয়া বলেন, জুড়ী এতো বড় বাজার। কিন্তু ময়লা ফেলার মতো নির্দিষ্ট কোন স্থান নেই। যদি ময়লার ফেলার স্থান থাকতো তাহলে নদীতে ময়লা যারা ফেলতো তাদের আইনের আওতায় আনা যেতো। এটি স্থায়ীভাবে সমাধান না হওয়া পর্যন্ত এভাবে ময়লা ফেলা ছাড়া আর বিকল্প রাস্তা দেখছি না। আগে আমাদের বাজারবাসীকে বাজারের বর্জ্য ফেলার মতো নির্দিষ্ট একটি স্থান করে দেয়া হোক।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এ আজিজ বলেন, প্লাস্টিক পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। কারণ এটি সহজে মাটির সাথে মিশে না। ফলে মাটির গুনাগুন মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় পলিথিন জলাশয় বা নদীর তলদেশ জমা হতে থাকে।

তিনি বলেন, গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, পলিথিন দীর্ঘ সময়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণায় পরিণত হয়ে নানা প্রাণীর মধ্যে প্রবেশ করছে। জলাশয়ের মাছের মধ্যে এগুলো প্রবেশ করে। এভাবে এক সময় মানুষের শরীরেও চলে আসে। বর্ষাকালে এই নদীতে জমা হওয়া পলিথিন হাওর এলাকায় চলে যাবে, হাওরের ইকোসিস্টেমে বিরূপ প্রভাব পড়বে। তিনি আরো বলেন, মানুষকে সচেতনতার পাশাপাশি প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে করে পলিথিন কোন ভাবেই জলাশয়ে মিশতে না পারে।

পরিবেশ অধিদপ্তর মৌলভীবাজার জেলার সহকারি পরিচালক মাঈদুল ইসলাম বলেন, এগুলো তো উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ এবং বাজার কমিটির দেখার বিষয়। উনারা বিষয়টা জোর দিয়ে দেখলেই সমাধান হয়ে যায়।

জুড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লুসিকান্ত হাজং বলেন, জুড়ী উপজেলার ২টি বাজার কামিনীগঞ্জ ও ভবানীগঞ্জ বাজারের মধ্যে কামিনীগঞ্জ বাজারটি সরকারিভাবে ইজারাভুক্ত। প্রশাসনের পক্ষ থেকে কমিটিকে এ বিষয়ে জানানো হয়েছে একাধিকবার। যদি এসব ক্রমাগত এভাবে পরিবেশ বিপর্যয় করতে থাকে ঈদের পরে উচ্ছেদ সহ আরো কঠোর অবস্থানে যাবে প্রশাসন । তবে ভবানীগঞ্জ বাজারটি ইজারাভুক্ত না হওয়ায় এদিক থেকে তাদেরকে চাপ সৃষ্টি করা না গেলেও প্রশাসনিকভাবে এ বিষয়ে জোরদার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাছাড়া কাজের সুবিধার্থে দুটি বাজারকেই এক করে একসাথে লিজ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।