নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেশজুড়েই ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব। প্রতিদিনই আক্রান্ত হচ্ছে বিপুলসংখ্যক মানুষ। প্রাণহানিও ঘটছে। আক্রান্তরা নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ছুটছে। কিন্তু জেলাপর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীর পর্যাপ্ত চিকিৎসা মিলছে না। মূলত জরুরি চিকিৎসা সেবার অপ্রতুলতা এবং চিকিৎসকদের পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ফলে রোগীর অবস্থা জটিল হলেও বিশেষায়িত কোনো মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের বিশেষায়িত মেডিজেল কলেজ হাসপাতালগুলো রোগীর আধিক্য সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, চলতি বছর ইতিমধ্যে দেশে প্রায় অর্ধলক্ষ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। তবে তুলনামূলকভাবে ঢাকাতেই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি। সরকার সর্বশেষ ২০১৯ সালে সর্বোচ্চ ডেঙ্গু রোগী শনাক্তের কথা জানিয়েছিল। ওই বছরে ডেঙ্গুতে ১৭৯ জনের মৃত্যু হয়েছিল। চলতি বছর ইতোমধ্যে ওই সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে। এবার এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে প্রায় ২শ জনের মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে রাজধানীতেই মারা গেছে ১১৬ জন আর বাকিরা রাজধানীর বাইরের রোগী। অবশ্য সরকারের দেয়া কোনো তথ্যেই জেলা পর্যায়ের বেসরকারি হাসপাতাল ও বাড়িতে থাকার রোগী ও মৃত্যু অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় মৃত্যুর সংখ্যা আরো অনেক বেশি বলেই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
সূত্র জানায়, দেশে চলতি বছর ডেঙ্গু ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বিগত সময়ে ডেঙ্গু রোগী রাজধানীতে সীমাবদ্ধ থাকলেও এ বছর তা নতুন নতুন জেলায় শনাক্ত হয়েছে। কিন্তু ঢাকার বাইরের চিকিৎসকরা ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসায় অনভিজ্ঞ। ঢাকার বাইরে যেসব এলাকায় ডেঙ্গুতে মৃত্যু বেশি ওসব এলাকায় রোগটির যথাযথ চিকিৎসা হচ্ছে না। অথচ ডেঙ্গু রোগীর প্রতিটি মুহূর্তই গুরুত্বপূর্ণ। সেবা দিতে অভিজ্ঞ চিকিৎসক প্রয়োজন। একই সঙ্গে দরকার আধুনিক জরুরি চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ব্যবস্থাপনা। কিন্তু জেলা হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সেবার অপ্রতুলতায় জটিল রোগীদের ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহরের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে পাঠানো হচ্ছে। কারণ অনেক সময়ই ওসব রোগীকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রেখে চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।
সূত্র আরো জানায়, ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলো থেকে আসা রোগীদের যে স্যালাইন দেয়া হচ্ছে তা পরিমাণে অতিরিক্ত। স্যালাইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে মাত্রা ও সময়ে ব্যাপ্তির সমন্বয় হয়নি। একই সঙ্গে কোনো রোগীর ক্ষেত্রে প্লাটিলেট লাগলে তাকে প্লাটিলেট দেয়া জরুরি। সেক্ষেত্রে রক্ত থেকে প্লাটিলেট আলাদা করে দিতে হয়। জেলা পর্যায়ে ওসব সুবিধার অভাব রয়েছে। আবার অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে চিকিৎসকরা ডেঙ্গু রোগীকে রক্ত দিচ্ছেন। ফলে রোগীর শরীরে আরো জটিলতা দেখা দিচ্ছে। শিরায় যে স্যালাইন দেয়া হয় সেটাই হলো আইভি ফ্লুইড। সেটি দেয়ার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট পরিমাপ ও বিধি রয়েছে। অতিরিক্ত স্যালাইন দেয়া হলে সেটা হৃদযন্ত্র, কিডনি, ফুসফুসসহ দেহের বিভিন্ন অংশে প্রবেশ করতে পারে। তাতে রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন হয়। আবার ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে রক্তে প্লাটিলেট কমে যায়। তাতে রক্তক্ষরণ হতে পারে। তবে প্লাটিলেট কমে গেলেও তা ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রে আপনাআপনিই ঠিক হয়ে যায়। অথচ উপজেলা ও জেলার চিকিৎসকরা ওসব রোগীর দেহে রক্ত পুশ করছে, যা রোগীর জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে।
এদিকে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, জরুরি বা যে কোনো রোগীকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে জেলা হাসপাতালে পাঠানো হয়। জেলা হাসপাতাল থেকে আবার পাঠানো হয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তার মধ্যে উপজেলা হাসপাতালগুলোর বহির্বিভাগের সেবা পরিপূর্ণভাবে চলছে না। একই সঙ্গে জরুরি সেবাও সন্তোষজনক নয়। ভর্তি রোগীদের চিকিৎসার জন্য যে পদক্রমের চিকিৎসক প্রয়োজন সেসবও সেখানে নেই। আবাসিক চিকিৎসক, মেডিকেল অফিসার যারাই থাকে তারা নবীন। ফলে তাদের অভিজ্ঞতাও কম। অথচ ডেঙ্গু রোগীর জটিলতাকে গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসা দিতে হয়। প্রয়োজন হয় বিভিন্ন চিকিৎসা সুবিধাও। তবে ওসবের ঘাটতির সঙ্গে সঙ্গে অভিজ্ঞতার ঘাটতি চিকিৎসায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে দুপুরের পর প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা হয় না। নেই প্যাথলজিস্টও। অনেক ক্ষেত্রে জেলা-উপজেলায় রোগীর রক্তচাপ, নাড়ি পরীক্ষার বাইরে জরুরি চিকিৎসায় আর কিছুই করার থাকে না। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য নিয়মিতভাবেই চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। সারা দেশে উপজেলা ও জেলা হাসপাতালে বাড়ানো হয়েছে চিকিৎসা সুবিধা। একই সঙ্গে ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য ক্লিনিক্যাল গাইডলাইনও প্রকাশ করেছে সরকার। ওই অনুযায়ীই চিকিৎসা দিচ্ছে সব পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. এইচএম সাইফুল ইসলাম জানান, জেলা ও উপজেলার হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু শনাক্ত হলেই ওই রোগীদের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। রোগীরাও ওসব হাসপাতালে থাকতে চাচ্ছে না। আবার জেলা পর্যায়ের চিকিৎসকরাও কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম জানান, শুধু ডেঙ্গুর জন্যই জেলা পর্যায়ের মানুষজন ঢাকায় চিকিৎসা নিতে আসছে তা সঠিক নয়। যে কোনো রোগের জন্যই রোগী ঢাকায় আসছে। হাতের কাছে সঠিক চিকিৎসা থাকার পরও বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার মানুষ ঢাকায় এসে ভিড় করে।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক