April 25, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Friday, November 25th, 2022, 2:07 pm

ঠাকুরগাঁওয়ে নবান্ন: বাঙালির জীবনের সচ্ছলতার উৎসব

আবহমানকাল থেকেই প্রকৃতির প্রাণধারা বহমান রেখেছে বাঙালির জীবনধারাকে। তাই প্রকৃতির উদার আনুকূল্যে সে যেমন বাঁচে, তেমনি এর রুদ্ররোষেও হয়ে পড়ে বিপন্ন। প্রকৃতি তাকে অপার দাক্ষিণ্যে পূর্ণ করে, আবার আঘাতে আঘাতে করে নিঃস্ব-সর্বশান্ত। তারপরেও মনে হয়, বাঙালির স্বপ্ন-প্রেম, তার বাঁচার ইচ্ছা, তার জীবনধারণ ও জীবনযাপনের সবকিছুই ওই প্রকৃতির দানে প্রাপ্ত। প্রকৃতি ঘনিষ্ঠ যে জীবন ও জীবনের কলরব, তাতেই বাঙালির উৎসব।

অন্যভাবে বলা যায়, প্রকৃতির উৎসবই বাঙালির উৎসব। ঋতুর আনুকুল্যে তার আশ্চর্য প্রণোদনায় এই উৎসব বর্ধিত ও পল্লবিত হয়। প্রকৃতির পালাবদলে তার ষড়ঋতুর বৈচিত্র্যে চারদিক অপরূপ হয়ে ওঠে। ঋতুভিত্তিক কিংবা প্রকৃতিকেন্দ্রিক উৎসব পার্বনগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ‘নবান্ন’।

আর এই নবান্ন হলো হেমন্তের উৎসব। তাই সমৃদ্ধির ঋতু হেমন্ত যখন আসে বাংলায়, তখন তা নিয়ে আসে ফসলের প্রাচুর্য। গ্রাম বাংলার কুটির থেকে প্রান্তর, পাকা ধানের গন্ধে আমোদিত হয়ে ওঠে। ফসল তোলার আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠে সকলে। হেমন্তে আয়োজন করা হয় প্রাণের উৎসব, জীবনের সচ্ছলতার উৎসব ‘নবান্ন’।

অগ্রহায়ণের নবান্ন নিয়ে আসে খুশির বার্তা। নতুন ধান ঘরে তুলতে এখন ব্যস্ত কৃষাণ-কৃষাণীরা। আর ধান ঘরে উঠলে পিঠে পায়েস খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। পাড়ায় পাড়ায় চলে নবান্ন উৎসব। গ্রাম বাংলায় নতুন এক আবহের সৃষ্টি হয়। নবান্ন উৎসবের সঙ্গে মিশে আছে বাঙালিয়ানার হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির নানা দিক। প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালি জাতি-ধর্ম-বর্ণকে উপেক্ষা করে নবান্নকে কেন্দ্র করে উৎসবে মেতে ওঠে। একে অন্যের মধ্যে তৈরি হয় এক সামাজিক মেলবন্ধনের।

অগ্রহায়ণের শুরুতেই ঠাকুরগাঁওয়ের গ্রামাঞ্চলে চলে নানা উৎসব, নানা আয়োজন। নতুন ধান কাটা আর সেই সঙ্গে প্রথম ধানের অন্ন খাওয়াকে কেন্দ্র করে পালিত হয় এই উৎসব। বাঙালির বার মাসে তেরো পার্বণ- এ যেন সত্যি হৃদয়ের বন্ধনকে আরও গাঢ় করার উৎসব।

সার্বজনীন এই নবান্ন উৎসব অনেক সময় হিন্দু সম্প্রদায় লক্ষ্মীপূজার সময় আয়োজন করে থাকে। গ্রামে কখনও কখনও মুসলমানেরা আয়োজন করে মিলাদ-মাহফিল। উপলক্ষ্য একটাই, পিঠা বা পায়েস খাওয়া।

এই উৎসব শুধু পহেলা অগ্রহায়ণে নয়। সারা মাস জুড়েই, যেদিন যার ধান কাটা মাড়াই হবে সেদিনই তার বাড়িতে হবে নবান্ন উৎসব। কৃষক শ্রদ্ধার সঙ্গে অন্ন গ্রহণ করার জন্য যে মনোভাব তা তুলে ধরার জন্য একটা আনুষ্ঠানিকতার আয়োজন করেন, তাই নবান্ন উৎসব। এতে খাদ্য গ্রহণ ও ফসল উৎপাদনে মনোযোগ সৃষ্টি হয় কৃষকের। তাছাড়া নবান্ন উৎসব একটি সচ্ছলতার প্রতীকও বটে।

ফসলের উৎসব এই নবান্ন কোথাও কোথাও পৌষ মাসেও আয়োজন করা হয়। পৌষ মাসের প্রথম দিকে সদ্য ঘরে তোলা নতুন ধানের আতপ চালের ভাত খেয়ে এই উৎসবের সূচনা করা হয়। পর পর তিন দিন এই আতপ চালের ভাত খেয়ে এই আনুষ্ঠানিকতা করা হয়। পৌষ মাসে এর আয়োজন করা হয় বলে অনেক জায়গায় একে বলা হয় ‘পৌষাল’। তবে যেহেতু এটি ভাত বা অন্ন গ্রহণের সঙ্গে সম্পর্কিত সেহেতু এটি ‘নবান্ন’ই। তবে যেহেতু আমন ধান ঘরে তোলার মৌসুমই হলো হেমন্ত, তাই নবান্নকে হেমন্তের উৎসবই বলা যায়।

হেমন্ত এলেই বাঙলার দিগন্ত জোড়া ফসলের মাঠ ছেয়ে যায় হলুদ রঙে। এই শোভা দেখে কৃষকের মন আনন্দে নেচে ওঠে। নতুন ফসল ঘরে ওঠার আনন্দ। প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালির জীবনে অগ্রহায়ণ কৃষকের নতুন বার্তা নিয়ে আগমন ঘটে। নবান্ন হচ্ছে হেমন্তের প্রাণ। নতুন ধানের চাল দিয়ে তৈরি করা হয় পিঠা, পায়েস, ক্ষীরসহ হরেক নানা রকম খাবার। সুস্বাদু খাবারের গন্ধে ভরে ওঠে চারপাশ।

সোনালি ধানের প্রাচুর্য আর বাঙালির বিশেষ অংশ নবান্ন ঘিরে অনেক কবি-সাহিত্যিকের লেখায় উঠে এসেছে প্রকৃতির চিত্র।

কবি জীবনানন্দ দাশ তার কবিতায় লিখেছেন- ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়- মানুষ নয়- হয়তো বা শঙ্কচিল শালিখের বেশে- হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে-কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়।’

কবির কবিতার লাইনের মতোই নবান্নে চিরায়ত বাংলার রূপ।

অগ্রহায়ণ এলেই কৃষকের মাঠ জুড়ে ধানকাটার ধুম পড়ে যায়। অত্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটান এ সময়ে কৃষাণ-কৃষাণীরা। ধান ভাঙার গান ভেসে বেড়ায় বাতাসে, ঢেঁকির তালে মুখর হয় বাড়ির আঙিনা। অবশ্য যান্ত্রিকতার ছোঁয়ায় এখন আর ঢেঁকিতে ধান ভানার শব্দ খুব একটা শোনা যায় না। অথচ খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, ঢেঁকিছাঁটা চাল দিয়েই হতো ভাত খাওয়া। তারপরও নতুন চালের ভাত নানা ব্যঞ্জনে মুখে দেয়া হয় আনন্দঘন পরিবেশ। তৈরি হয় নতুন চালের পিঠা, ক্ষীর ও পায়েসসহ নানা উপাদান। দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে নবান্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে চলে খাওয়া দাওয়ার ধুম।

ঠাকুরগাঁওয়ের পাঁচ উপজেলায় আমন ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে, চলছে ধান কাটার মহোৎসব। নবান্নের ধানে মৌ মৌ করছে এখন সর্বত্র। সে ধানের গন্ধে ছুটে আসছে বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখি। কৃষকের সঙ্গে তারাও মেতেছে নবান্নের মহোৎসবে। ইতোমধ্যে ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ শুরু হয়েছে। কৃষকের বাড়ির উঠোনে এখন শুধু ধান আর ধান। ফলন ভালো হওয়ায় হাসি ফুটেছে কৃষকের মুখে।

জেলার বিভিন্ন উপজেলা ঘুরে দেখা যায়, মাঠের সোনালি রঙের পাকা ধান কাটছেন কৃষকরা। কেউ আঁটি বেঁধে ধানের বোঝা কাঁধে নিয়ে আবার কেউ ভ্যানে বা গাড়িতে করে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন। বাড়িতে নিয়ে এসব ধান মাড়াই ও পরিষ্কার করার পর ধানগুলোকে সিদ্ধ করে শুকাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষক-কৃষাণীরা।

ঠাকুরগাঁও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, চলতি মৌসুমে আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ লাখ ৩৭ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমি। আর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪ লাখ ২৯ হাজার ৭১৬ মেট্রিক টন। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে আরও ১০ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে আমনের।

এ ব্যাপারে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. আব্দুল আজিজ বলেন, জেলায় লক্ষ্যমাত্রার থেকে আমন আবাদ বেশি ও উৎপাদন ভালো হওয়ায় এবার লক্ষ্যমাত্রার থেকে উৎপাদনও বেশি অর্জিত হবে। বর্তমানে ধানের যে মূল্য এমন বাজার মূল্য থাকলে কৃষকরা লাভবান হবে।

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার গড়েয়া গোপালপুর গ্রামের মো. আক্কাস আলী, চিত্র বর্মন, রফিকুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পিঠা তৈরির জন্য চালোর গুঁড়া করা হচ্ছে ঘরে ঘরে। বেশিরভাগ বাড়িতে মেয়ে জামাই, আত্মীয় স্বজন আর পাড়া-প্রতিবেশিকে খাওয়ানো হবে নানা ধরনের পিঠা ও পায়েস। খেজুরের রসও সংগ্রহ করা হচ্ছে ।

সদর উপজেলার দেবীপুর ইউনিয়নের খলিশাকুড়ি গ্রামের কৃষক ফজলে রাব্বি জানান, এবার ধানের বাজার ভালই আছে। তাই চাষিদের মনে আনন্দও বেশি। প্রতিবছর আনন্দ করা হয়। এবছরও বড় পরিসরে নবান্ন উৎসব অনুষ্ঠিত হবে বলে জানান তিনি।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মনতোষ কুমার দে বলেন, বাঙ্গালির হাজার বছরের ঐতিহ্য নবান্ন উৎসব। এই উৎসবকে ধরে রাখতে হবে। তবেই মানুষের সঙ্গে মানুষে ভ্রাতৃত্ব বজায় থাকবে।

এসব লালন করতে সরকারি-বে-সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

তিনি বলেন, নবান্নের দেশ বলে একদিন যার পরিচিতি ছিল সেই বাংলাদেশের জীবনধারা থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে নবান্ন উৎসবটি। উৎসবহারা হয়ে জাতি হারিয়ে ফেলেছে তার চিৎশক্তিকে। আর এজন্যই এই উৎসব আয়োজনের ব্যাপারে গ্রামগুলো আর আগের মতো সরব নয়। নতুন ধানের অন্ন এসময়ে যদিও বা মুখে উঠে, তবু তা উৎসবের আঙ্গিকে নয়। কিংবা নয় কোনো শ্রদ্ধাবনত চিত্তে।

—ইউএনবি