নিজস্ব প্রতিবেদক:
বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশ হত্যার প্রায় এক মাস হতে চলেছে। কিন্তু আলোচিত এ হত্যাকান্ডের সুস্পষ্ট কোনো কারণ জানাতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিষয়টি এখনো তদন্তাধীন। গত ১৫ নভেম্বর র্যাবের পক্ষ থেকে ফারদিন হত্যার নেপথ্যে চনপাড়ার রায়হান ওরফে হিরো রায়হান গ্রুপ জড়িত থাকার কথা বলা হলেও পরবর্তীসময়ে সেটিও অনেকটা চাপা পড়ে গেছে। নতুন করে ফারদিনের মোবাইল কললিস্ট যাচাই করে সেখান থেকে সবশেষ কথা বলা ব্যক্তিদের থেকে একশ নম্বর বাছাই করা হয়েছে। এসব নম্বরের ব্যক্তিরা আছেন সন্দেহভাজন তালিকায়। মামলাটির তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের মতিঝিল বিভাগ। ডিবি গত ১৭ নভেম্বর কয়েকটি সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখিয়ে জানিয়েছিল যাত্রাবাড়ী থেকে ফারদিনকে তোলা হয় লেগুনায়। চালক-সহকারীকে খোঁজা হচ্ছে। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত ডিবিও হত্যাকান্ডের সুস্পষ্ট কোনো কারণ জানাতে পারেনি। অনেকটা রহস্যের বৃত্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে হত্যাকান্ডটি। ডিবি জানিয়েছিল, ফারদিন ঘটনার দিন রাত ৯টা ৪৫ মিনিট থেকে রাত ২টা পর্যন্ত প্রায় সাত- আটটি জায়গায় যান। তিনি মুহূর্তে মুহূর্তে স্থান পরিবর্তন করছিলেন। কিন্তু তিনি এভাবে কেন স্থান পরিবর্তন করছিলেন তার সঠিক কোনো ক্লু পাচ্ছেন না তদন্তকারীরা। সবশেষ পাওয়া একটি সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে, রাত সোয়া ২টার দিকে সাদা গেঞ্জি পরিহিত এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে তিনি লেগুনায় ওঠেন। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ, গোয়েন্দা তথ্য ও তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় পাওয়া বেশ কিছু বিষয় নিয়ে কাজ করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। এদিকে ফারদিনের বাবা নূর উদ্দিন রানা বলেন, ফারদিনের অন্য কোনো ফুটেজ নিশ্চিত না হলেও যাত্রাবাড়ীর ফুটেজ ৯০ শতাংশ নিশ্চিত হয়েছি। আমার ছেলের হত্যাকান্ডের রহস্য উন্মোচন হোক এবং দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি হোক। এটা শুধু আমার নয়, দেশবাসীর চাওয়া। গোয়েন্দা সূত্রগুলো জানায়, ফারদিন হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ চলছে। কী কারণে এই হত্যাকান্ড এবং কারা এর সঙ্গে জড়িত সেটি বের করতে রাতদিন বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। বেশকিছু তথ্য নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। এর মধ্যে ফারদিন ওই রাতে মাদক সেবন বা মাদক কেনার জন্য রূপগঞ্জের চনপাড়া বস্তিতে গিয়েছিলেন কি না, সেখানে যদি গিয়ে থাকেন তবে সেখানেই তাকে হত্যা করা হয়েছে কি না তা স্পষ্ট নয়। ঘটনার রাতে ঢাকার বাবুবাজার ব্রিজ ও ডেমরার সুলতানা কামাল ব্রিজে ফারদিন হাঁটাহাঁটি করেছেন বলে জানা যায়। এসব বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, ফারদিন ছিনতাইয়ের শিকার হননি সেটি অনেকটাই নিশ্চিত হওয়া গেছে। কারণ ছিনতাইকারীদের উদ্দেশ্য থাকে ব্যক্তির কাছে থাকা টাকা, মোবাইলসহ অন্য গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রী কেড়ে নেওয়া। কিন্তু ফারদিনের ক্ষেত্রে এ রকম কিছুই হয়নি। লাশ উদ্ধারের সময় তার ৩৭ হাজার টাকায় কেনা মোবাইল ফোন, ব্লুটুথ এয়ারপড, হাতঘড়ি, মানিব্যাগ ও নগদ ৯৩০ টাকা পাওয়া যায়। তাকে কেউ নজরদারিতে রেখেছিল কি না সে বিষয়ে তদন্ত চলছে। সূত্র জানায়, ফারদিনের মোবাইলসংশ্লিষ্ট প্রায় পাঁচশর অধিক মোবাইল নম্বর বিশ্লেষণ করেও কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে সন্দেহভাজন শতাধিক মোবাইল নম্বর পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে নিখোঁজের পর উদ্ধার হওয়া ফারদিনের পচন ধরা মরদেহে পাওয়া আঘাতের চিহ্নগুলো কীসের হতে পারে সে বিষয়েও ফরেনসিক চিকিৎসকদের মতামত নেওয়া হচ্ছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, সুলতানা কামাল ব্রিজই যদি শেষ লোকেশন হয়, তাহলে লাশ সিদ্ধিরগঞ্জের বনানী ঘাট পর্যন্ত ভেসে যেতে পারে কি না, তদন্তে সেটিও জোর দিয়ে দেখা হচ্ছে। একই সঙ্গে পরীক্ষার ফলাফল ও বিদেশ যাওয়ার টাকা জোগাড় না হওয়া নিয়ে কোনো ধরনের হতাশার কথা কাউকে ফারদিন বলেছেন কি না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। গোয়েন্দা মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. রাজীব আল মাসুদ বলেন, আমরা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি। ঘটনার রাতের অবস্থান বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বড় দুটি ব্রিজে হাঁটাহাঁটির তথ্য পেয়েছি। কারও সঙ্গে শত্রুতা ও ছিনতাইয়ের যোগসূত্র এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তার বন্ধুদের মাধ্যমে ফারদিন হতাশাগ্রস্ত ছিল কি না জানার চেষ্টা করেছি। আশা করছি হত্যাকান্ডের রহস্য উন্মোচিত হবে। এ হত্যাকান্ডের ঘটনায় গত ৯ নভেম্বর দিবাগত রাতে ফারদিনের বান্ধবী বুশরাসহ অজ্ঞাতপরিচয়দের আসামি করে ‘হত্যা করে লাশ গুম’ করার অভিযোগে রামপুরা থানায় মামলা করেন ফারদিনের বাবা সাংবাদিক নূর উদ্দিন রানা। ফারদিনের লাশ উদ্ধারের পরদিন গত ৮ নভেম্বর ময়নাতদন্ত শেষে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা শেখ ফরহাদ বলেছিলেন, ময়নাতদন্তে আমরা দেখতে পেয়েছি ফারদিনের মাথায় এবং বুকে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তবে সেই আঘাত কোনো ধারালো অস্ত্রের নয়। আঘাতের চিহ্ন দেখে নিশ্চিত হওয়া গেছে এটি হত্যাকান্ড। পুলিশের চাহিদা ও অধিকতর তথ্যের জন্য তথ্য-উপাত্ত ও আলামত মহাখালী ভিসিআরে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে প্রতিবেদন পেলে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যাবে ফারদিনকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছে। ফারদিনের বাবা নূর উদ্দিন রানা বিজনেস পত্রিকা ‘দ্য রিভারাইন’র সম্পাদক ও প্রকাশক। তিনি দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে সাংবাদিকতা করছেন। ফারদিনের মা ফারহানা ইয়াসমিন গৃহিণী। তাদের গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা উপজেলার নয়ামাটিতে। তিন ভাইয়ের মধ্যে ফারদিন ছিলেন সবার বড়। তার মেজ ভাই আবদুল্লাহ নূর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। ছোট ভাই তামিম নূর এ বছর এসএসসি পাস করেছে।
আরও পড়ুন
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে আগ্রহী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার: নাহিদ ইসলাম