গ্রীষ্মকালীন ফল তরমুজের বাম্পার ফলন হওয়া সত্ত্বেও দাম অস্বাভাবিক কম থাকায় লোকসানের মুখে পড়েছেন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলা খুলনার তরমুজ চাষিরা।
লাভের বদলে চাষিরা এখন তাদের উৎপাদন খরচ তোলা নিয়ে চিন্তিত। তারা তরমুজের দাম কম হওয়ার জন্য আংশিকভাবে মধ্যস্বত্বভোগীদের জোটকে দায়ী করছে।
তাদের অভিযোগ, সিন্ডিকেট খুব কম দামে ফল কিনে বেশি মুনাফা নিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করে।
মধ্যস্বত্বভোগীদের ফাঁদ এড়ানোটা যতটা সহজ ভাবা হয়, আসলে বিষয়টা ততটা সহজ নয়। কিছু কৃষকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে দেখা গেছে, তাদের তরমুজ পরিবহনের জন্য ট্রাক ভাড়া দেয়ার পাশাপাশি শ্রমিকদের বেতন দিতে হয় ১৪-২৫ হাজার টাকা। অধিকাংশ চাষিই এই খরচ বহন করতে পারে না।
রমজান মাসের পর তরমুজের দাম উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায় এবং স্থানীয় বাজারে তরমুজের বিক্রি কম হয়।
লোকসান পুষিয়ে নিতে কয়েকজনকে তাদের পণ্য ঢাকা ও খুলনা শহরে নিয়ে যেতে দেখা গেলেও কাঙ্খিত দাম পেতে ব্যর্থ হয়।
খুলনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর কৃষকরা ১৩ হাজার ৯৯০ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ করেছেন।
সবচেয়ে বেশি দাকোপে সাত হাজার ৬২৫ হেক্টরে। এছাড়া বটিয়াঘাটায় তিন হাজার ৬০০, পাইকগাছায় এক হাজার ৫১০, কয়রায় ৮৯৫, ডুমুরিয়ায় ৩৫০, রূপসায় পাঁচ, তেরখাদায় তিন ও ফুলতলা উপজেলায় এক ও মেট্রো থানায় আরও এক হেক্টর জমিতে তরমুজের চাষ হয়েছে।
২০২১ সালে মোট সাত হাজার ৫১২ হেক্টর জমি তরমুজ চাষের আওতায় আনা হয়েছিল এবং তরমুজ চাষ লাভজনক হিসেবে প্রমাণিত হওয়ায় কৃষকরা তাদের চাষ সম্প্রসারিত করেছে।
এ বছর জেলায় আনুমানিক চার লাখ ১৫ হাজার টন তরমুজ উৎপাদন হয়েছে।
খুলনার দাকোপের আনন্দনগর গ্রামের তরমুজ চাষি শেখ আবু সাঈদ কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমি ১০ বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ করেছিলাম। মোটেও বিক্রি হয়নি। ক্ষেতেই পড়ে রয়েছে তরমুজ।
তিনি আরও বলেন, ৫-১০ কেজি ওজনের একটি তরমুজ ক্ষেত থেকে ১০-২০ টাকা পিস বিক্রি হচ্ছে। সেই তরমুজ বাজারে ৩০-৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চাষির কাছ থেকে কম দামে তরমুজ কিনে বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে।
একই গ্রামের চাষি কামরুল ইসলাম বলেন, ১০ বিঘা তরমুজ কেটে বসে আছি। কোথায় যাব, কী করবো ভেবে পাচ্ছি না। এখন হতাশ হয়ে পড়েছি। ঢাকা নিয়ে যেতে ২৫-৩০ হাজার টাকা পরিবহন খরচ। তরমুজের কোনো দাম নেই। যা খরচ করেছি তার চার ভাগের একভাগও দাম পাচ্ছি না।
আনন্দনগর এলাকার চাষি বাবুল শেখ বলেন, আমি পাঁচ বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ করেছিলাম। তরমুজ বিক্রি করতে পারিনি। কেউ দামই বলে না। বাজারে তরমুজের দাম হলেও ক্ষেত থেকে তরমুজ নিতে কোনো ব্যাপারি আসেননি। আমার দুই ভাইয়ের ক্ষেতেই পড়ে রয়েছে তরমুজ। ক্ষেতেই তরমুজ পচে যাওয়ার অবস্থা হয়েছে। খরচ ওঠাতে পারব কিনা সে দুশ্চিন্তায় আছি।
তিনি আরও বলেন, এক বিঘা জমিতে তরমুজ উৎপাদনে ৩০ হাজার টাকা থেকে ৩৫ টাকা খরচ হয়। কিন্তু এখন তরমুজের দাম পাওয়া যাচ্ছে না। এক মাস আগেও তরমুজর দাম ছিল রমরমা। এখন দাম না পাওয়ায় তরমুজ মাঠেই ফেলে রাখতে হচ্ছে।
দাকোপের বাসিন্দা গোলাম মোস্তফা বলেন, মাঠে গাছ নেই। কিন্তু বড় বড় তরমুজ পড়ে আছে। আগে বিঘা প্রতি লাখ টাকা লাভ হলেও এখন দামেই পাওয়া যাচ্ছে না। আনন্দনগর, ছোট চালনা, পানখলী, মৌখালী, তীলডাঙ্গাসহ বিভিন্ন এলাকার মাঠে তরমুজ নষ্ট হচ্ছে। ব্যাপারী না আসায় কৃষকরাই তরমুজ নিয়ে বগুড়া, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ বিভিন্ন এলাকায় ছুটছেন। কিন্তু মোকামে দাম মিলছে না।
বানিশান্তার কৃষক উৎপল সানা বলেন, তরমুজ উৎপাদনে বিঘা প্রতি ৩৫ হাজার টাকা খরচ হয়। তবে ব্যবসায়ীরা এখন ২০ হাজার টাকাও দাম বলেন না। খুলনা শহরে নিয়েও বিক্রি করা যাচ্ছে না। মোকামেও প্রত্যাশিত দাম মিলছে না।
পাইকগাছার উপজেলার গড়ইখালী এলাকার তরমুজ চাষি শাফায়াত হোসেন বলেন, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে তরমুজের কেজি ৩০ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হলেও তরমুজের কোন মূল্যই বলছে না ব্যাপারীরা। আড়তে নিয়ে ৪-৫ দিন শত শত ক্ষেত মালিক আড়ত মালিকদের সঙ্গে ধর্না দিয়ে সম্পূর্ণ লোকসান করে শূন্য হাতে বাড়ি ফিরছে। দাকোপ, পাইকগাছা ও বটিয়াঘাটার কৃষক সর্বশান্ত হতে চলেছে। গত বছর তরমুজের দাম ভালো পাওয়ায় এ বছর অনেকে বেশি জমিতে তরমুজ চাষ করেছেন যারা তারা আরও বেশি ক্ষতিতে পড়েছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খুলনা সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালে এ জেলায় সাত হাজার ৫১২ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ হয়। লাভজনক হওয়ায় এ বছর ১৩ হাজার ৯৯০ হেক্টর জমিতে এর চাষ হয়েছে। উৎপাদন হয় প্রায় সোয়া চার লাখ টন তরমুজ। দাকোপেই এ বছর সাত হাজার ৬০৫ হেক্টর জমিতে অর্থকরী এ ফলের চাষ হয়। কিন্তু ভালো দাম না পাওয়ায় এখন পর্যন্ত ৪৯ ভাগ জমির তরমুজ মাঠেই পড়ে আছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খুলনার উপপরিচালক মো. হাফিজুর রহমান বলেন, রমজানের শুরুতে তরমুজ লাভজনক ছিল। ঈদের পর পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। তাই কৃষকেরা হতাশ হয়েছেন।
খুলনা জেলা কৃষি বিপণনের সিনিয়র কর্মকর্তা শাহরিয়ার আকুঞ্জী বলেন, চাষিরা তরমুজ মাঠ থেকে বিক্রি করতে না পেরে মোকামে নিলে পরিবহন খরচ বেশি হওয়ায় তারা কাঙিক্ষত দাম পাচ্ছেন না। দাকোপ ও বটিয়াঘাটার কিছু কৃষকের তালিকা নিয়েছি। আমাদের কিছু উদ্যোক্তা রয়েছে তাদের মাধ্যমে সরাসরি ক্ষেত থেকে তরমুজ কেনার ব্যবস্থা করছি। গত বছর এভাবে বিক্রির মাধ্যমে কৃষকদের কিছু লাভ হয়েছিল।
—ইউএনবি
আরও পড়ুন
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি