নিজস্ব প্রতিবেদক:
তীব্র জ্বালানি সঙ্কটের মধ্যে আমলারা সরকারি গাড়ি ব্যবহারে যথেচ্ছ অনিয়ম করে যাচ্ছে। পরিবহনপুলের যানবাহনে সরকারি কর্মকর্তারা কৃচ্ছ্রতা মানছে না। কাঁচাবাজার করা, ছেলেমেয়েদের স্কুলে আনা নেয়া, স্ত্রীর শপিং সবকিছুতে ব্যবহার হচ্ছে সরকারি গাড়ি। অথচ কৃচ্ছ্রতার লক্ষ্যে সরকার বিদ্যুতের লোডশেডিং করছে এবং সরকারি অফিসে ২০ শতাংশ খরচ কমানো, জ্বালানি খবর কমানোর নির্দেশনা দিয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, সরকারি যানবাহনে সরকারি কর্মকর্তাদের যথেচ্ছ অপব্যবহারে যে জ্বালানির অপচয় হয় তা বন্ধ হলে লোডশেডিং ও কৃচ্ছ্রতা সাধনের প্রয়োজন হতো না। সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কতোটি যানবাহন ব্যবহার করে তার সঠিক পরিসংখ্যা নেই। যানবাহন অধিদফতরে ১ হাজার ৭৫০টি সরকারি গাড়ি রয়েছে। কিন্তু সচিবালয়ের প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন প্রকল্পের শত শত গাড়ি সরকারি কর্মকর্তারা নিয়ে ব্যবহার করছে। তাছাড়াও সরকার সরকারি কর্মকর্তাদের প্রাইভেট কার কেনার জন্য ৪০ লাখ টাকা করে ঋণ দিয়েছে। আর ওসব প্রাইভেট কার পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মাসে ৪০ হাজার করে টাকা দেয়া হয়। দেশজুড়েই সরকারি যানবাহন ব্যবহারের মচ্ছব চলছে। সচিবালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিদ্যমান জ্বালানি ও গ্যাসের সঙ্কটে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার কৃচ্ছ্রতাসাধনের পথ ধরেছে। ইতোমধ্যেই দিনে বিদ্যুতের এক ঘণ্টা করে লোডশেডিং করছে। আর বিদ্যুতের ব্যবহার কমাতে মসজিদগুলোতে নামাজের সময় ছাড়া শীতাতাপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্র (এসি) বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সরকারি অফিসেও বিদ্যুতের ব্যবহার কমানোর লক্ষ্যে বেশ কিছু কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতেও বিভিন্ন সরকারি অফিসে প্রয়োজনের তুলনায় অধিক সংখ্যক সরকারি গাড়ি ব্যবহৃত হচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের অধিদফতর, পরিদফতর, কর্পোরেশন, শাখা অফিসগুলোতে অসংখ্য গাড়ি ব্যবহৃত হচ্ছে। অথচ ঠিকমতো গ্যাস ও তেল বিল পরিশোধ করা হচ্ছে না। সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রী, সিনিয়র সচিব এবং সচিব, মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের জন্য জ্বালানি খরচ নির্ধারণ করা থাকলেও বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তা এখনো সংশোধন করা হয়নি। শুরু হয়নি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ২০ শতাংশ জ্বালানি কমানোর নির্দেশনা বাস্তবায়ন। জ্বালানির পরিমাণ নির্ধারণে এখনো প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি।
সূত্র জানায়, সরকার বার বার তাগিদ দিয়েও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের শেষ হওয়া প্রকল্পের গাড়ি উদ্ধার করতে পারছে না। প্রকল্প শেষ হওয়ার পর হাজার হাজার গাড়ি থাকলেও গত জুলাইয়ে মাত্র ২টি গাড়ি জমা হয়েছে। আর গত অর্থবছরে জমা হয়েছে প্রায় ৪০টি গাড়ি। অথচ প্রকল্প শেষ হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে গাড়ি সরকারি যানবাহন অধিদফতরে জমা দেয়ার নির্দেশনা রয়েছে। তাছাড়া এখনো প্রাধিকার পাওয়া কর্মকর্তাদের জ্বালানি সুবিধা কমেনি। বরং বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মকর্তারা সুদমুক্ত ঋণে গাড়ি নেয়ার পরও প্রকল্প এবং অধিদফতরের গাড়ি ব্যবহার করছে। আর ওসব গাড়িতে বিপুল জ্বালানির ব্যয় হচ্ছে। সিনিয়র সচিব, সচিব, বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকরা (ডিসি) প্রি মাসে ২৫০ লিটার পেট্রল বা অকটেন অথবা ৩৫৮ ঘনমিটার সিএনজি পাচ্ছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও) ২১০ থেকে ২৫০ লিটার পেট্রল বা অকটেন অথবা ৩০০ থেকে ৩৫৮ ঘনমিটার সিএনজি ব্যবহার করছে। সহকারী কমিশনার (ভূমি) কর্মকর্তারা পাচ্ছে ১৮০ লিটার পেট্রল বা অকটেন। নির্ধারিত ওই জ্বালানির সুবিধা কমিয়ে প্রজ্ঞাপন সংশোধন করা হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, প্রাধিকার পাওয়া অনেক কর্মকর্তা সুদমুক্ত ঋণে গাড়ি কেনার পর ওসব গাড়ি সরকারি অফিসে ভাড়া দিচ্ছে। আবার তারাই সরকারি গাড়িগুলো ব্যবহার করছে।
সূত্র আরো জানায়, চলতি অর্থবছর ৬৪ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে জ্বালানি খাতে সাড়ে ৩৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। ৪৯২ ইউএনও’র কার্যালয়ে বরাদ্দ রয়েছে ১৬ কোটি টাকা। সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রাধিকার পাওয়া ৩ হাজার উপ-সচিব, যুগ্ম-সচিব, অতিরিক্ত সচিব, সচিব ও সিনিয়র সচিরের গাড়ির পেছনে মেরামত, চালক ও জ্বালানি বাবদ বছরে ১৮০ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো যানবাহন অধিদফতর থেকে পাওয়া গাড়ি চিহ্নিত না করার সুযোগে প্রতিটি মন্ত্রণালয় এবং বিভাগ বিভিন্ন দফতর, অধিদফতর ও শেষ হওয়া চলমান প্রকল্পের গাড়ি অবৈধভাবে ব্যবহার করছে। আর অবৈধভাবে ব্যবহার করা ওসব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বাজেটের টাকা থেকে গাড়ির জ্বালানি ব্যয় হচ্ছে। সেজন্য জ¦ালানি খাতে কোটি কোটি টাকার অতিরিক্ত বরাদ্দও রাখা হয়েছে। অর্থবছরে ৪৭ মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর গাড়ির জন্য জ্বালানির পেছনে বরাদ্দ রয়েছে ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
এদিকে যানবাহন অধিদফতরের অধীনে ১ হাজার ৭৫০টি সরকারি গাড়ি রয়েছে। তার মধ্যে ৮ বিভাগীয় কমিশনার, ৬৪ জেলা প্রশাসক ও ৪৯২ ইউএনও কার্যালয়ে ১ হাজার ৫০০টি গাড়ি রয়েছে। বাকি ২৫০টি গাড়ি ৫৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে চলছে। তাতে প্রতি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ ভাগে পাচ্ছে অন্তত ৫টি গাড়ি। যানবাহন অধিদফতরের গাড়ি সরবরাহ কম হলেও মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোতে জ্বালানি খাতে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। ওই খাতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বরাদ্দ রয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে ৪ কোটি ১৫ লাখ টাকা, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা, কৃষি মন্ত্রণালয়ে ৬৫ লাখ টাকা ও স্থানীয় সরকার বিভাগে ৫৫ লাখ টাকা। তাতে ৪টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে বরাদ্দ রয়েছে ৭ কোটি ১৫ লাখ টাকা। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী ২০ শতাংশ জ্বালানি ব্যয় কমানো হলেও যানবাহন অধিদফতরের গাড়ির চাহিদা অনুযায়ী জ্বালানি খরচের পর টাকা থেকে যাবে।
এদিকে এ প্রসঙ্গে সরকারি যানবাহন অধিদফতরের পরিচালক (সড়ক) মো. আলমগীর হোসেন চেšধুরী জানান, জ্বালানি সাশ্রয়ের জন্য যানবাহন অধিদফতরের কর্মচারীদের অর্ধেক গাড়ি বন্ধ করা হয়েছে। তবে অন্য কোনো মন্ত্রণালয় বা অধিদফতরের কর্মচারীদের গাড়ি কমানো কিংবা জ্বালানি সাশ্রয়ের কোনো তথ্য পরিবহন অধিদপ্তরের কাছে নেই। আর প্রাধিকার পাওয়া কর্মকর্তাদের তেলের পরিমাণ কমানোর বিষয়টিও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত।
অন্যদিকে এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবের চলতি দায়িত্বে থাকা ও অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন অনুবিভাগ) মো. নবীরুল ইসলাম জানান, জ্বালানি সাশ্রয়ের কিছু বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। আরো কিছু সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য এ-সংক্রান্ত গঠিত কমিটি কাজ করছে।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ