April 27, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Friday, November 11th, 2022, 9:08 pm

তীব্র সঙ্কটেও বেড়েছে গ্যাসের সিস্টেম লস

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

তীব্র সঙ্কটেও বেড়েছে গ্যাসের সিস্টেম লস। মূলত চুরি হওয়া গ্যাসের পুরোটাই সিস্টেম লসের নামে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। গ্যাস বিতরণকালে কারিগরি ও অন্যান্য কারণে সামান্য পরিমাণ যে গ্যাস নষ্ট হয় তাকেই সিস্টেম লস বা পদ্ধতিগত ক্ষতি বলা হয়। ২ শতাংশের নিচে বা সর্বোচ্চ ২ দশমিক ২৫ শতাংশ ক্ষতিকে আদর্শ সিস্টেম লস ধরা হয়। তার মধ্যে বিতরণে ২ শতাংশ ও সঞ্চালনে দশমিক ২৫ শতাংশ। কিন্তু গত আড়াই অর্থবছরে দেশে উত্তোলন ও আমদানিকৃত গ্যাসের সিস্টেম লস প্রায় ৮ শতাংশে ঠেকেছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চেয়ে তা প্রায় ৫ গুণ সেটা বেড়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত গ্যাস উৎপাদন ও বিক্রিতে ২১৮ বিসিএফ সিস্টেম লস দেখানো হয়েছে। পেট্রোবাংলা সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১ হাজার ৮৫ বিসিএফ গ্যাস আমদানিসহ উৎপাদন হয়েছে। আর বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছে ৯৯৫ বিসিএফ গ্যাস বিক্রি করা হয়েছে। বাকি ৯১ বিসিএফ সিস্টেম লস দেখানো হয়েছে। সিস্টেম লস হিসেবে ওই গ্যাসের পরিমাণ সাড়ে ৮ শতাংশের কাছাকাছি। ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ হাজার ১০৪ বিসিএফ গ্যাস উত্তোলন হয়েছে। তার মধ্যে বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছে বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ১৭ বিসিএফ গ্যাস। ৮৭ বিসিএফ গ্যাস সিস্টেম লস হিসেবে দেখানো হয়েছে, যা ৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ। আর ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথমার্ধে ৫৫১ বিসিএফ উত্তোলনকৃত গ্যাসের মধ্যে ৫০৯ বিসিএফ গ্যাস বিক্রি হয়েছে এবং বাকি ৪১ বিসিএফ গ্যাস সিস্টেম লস হয়েছে, যা ৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ। আর অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধেও একই পরিমাণ সিস্টেম লস হতে পারে।
সূত্র জানায়, গ্যাসের সিস্টেম লস বিগত ২০১৯-২০, ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথমার্ধে সবচেয়ে বেশি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে গ্যাসের যে সিস্টেম লস ছিল তা ২০১৯-২০ থেকে বেড়ে প্রায় পাঁচ গুণ হয়েছে। ওই ধারা ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথমার্ধ পর্যন্ত চলমান ছিল। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে উৎপাদিত ও বিক্রিত গ্যাসে সিস্টেম লস দেখানো হয়েছিল দেড় শতাংশের মতো (১৮ বিসিএফ)। ওই অর্থবছরে গ্যাসের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৬০ বিসিএফ। মূলত সিস্টেম লসের নামে বিপুল পরিমাণ গ্যাস চুরি হচ্ছে। যদিও পেট্রোবাংলা সিস্টেম লস কমাতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে এগোচ্ছে।
সূত্র আরো জানায়, দেশে আন্তর্জাতিক জ¦ালানি কোম্পানিগুলোর (আইওসি) কাছ থেকে প্রায় ৩ ডলার করে প্রতি এমএমবিটিইউ গ্যাস কেনা হচ্ছে। ওই হিসাবে প্রতি বিসিএফ গ্যাসের দাম দাঁড়ায় ৩২ কোটি টাকার কিছু বেশি। ফলে সিস্টেম লস হওয়া ২১৮ বিসিএফ গ্যাসের দাম দাঁড়ায় প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। দীর্ঘমেয়াদি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) মূল্য হিসাব করলে ওই অর্থের পরিমাণ ৪ গুণের বেশি। ক্রমবর্ধমান হারে স্থানীয় গ্যাসের উৎপাদন কমে যাওয়ায় চাহিদা মেটাতে সরকার ২০১৮ সাল থেকে এলএনজি আমদানি করছে। আর তারপর থেকেই সিস্টেম লস ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) গ্যাসের সিস্টেম লস কমাতে বিইআরসি নির্দেশনা দিলেও তার প্রতিফলন খুব বেশি দেখা যাচ্ছে না। বরং অনেকটা নিয়ম করেই সিস্টেম লসের নামে গ্যাস চুরি করা হয়েছে। বিশেষ করে আবাসিক, শিল্পে গ্যাস সরবরাহে যে ধরনের পদ্ধতি অনুসরণ করে গ্যাস দেয়ার কথা ছিল বিতরণ কোম্পানিগুলো তা দেয় না।
এদিকে বিগত ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে দেশের জাতীয় গ্রিডে স্থানীয় গ্যাসের পাশাপাশি সংকট মেটাতে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। গত ৪ অর্থবছরে জাতীয় গ্রিডে যে পরিমাণ এলএনজি সরবরাহ দেয়া হয়েছে, অর্থবছর হিসেবে আমদানি করা গ্যাসের অর্ধেকই সিস্টেম লসে চলে যাচ্ছে। সিস্টেম লসের নামে গ্যাসের অপচয় বা চুরি ঠেকানো গেলে স্পট থেকে এত বেশি এলএনজি আমদানি করতে হতো না। ২০১৯-২০ অর্থবছরে যে পরিমাণ গ্যাস উৎপাদন দেখানো হয়েছে, সেখানে এলএনজির পরিমাণ ছিল ২০৩ বিসিএফ। ওই সময় গ্যাসের সিস্টেম লস দেখানো হয়েছে ৯১ বিসিএফ, যা আমদানি গ্যাসের প্রায় অর্ধেক। ২০২০-২১ অর্থবছরে ২১৫ বিসিএফ এলএনজি সরবরাহ হয়েছে। ওই অর্থবছরে গ্যাসের সিস্টেম লস হয়েছে ৮৭ বিসিএফ। একইভাবে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথমার্ধে ১২৩ বিসিএফ এলএনজি সরবরাহ হয়েছে। ওই অর্থবছরের প্রথমার্ধে গ্যাসের অপচয় হয়েছে ৪১ বিসিএফ।
অন্যদিকে জ¦ালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, গ্যাসের সিস্টেম লসের বিষয়টি মূলত পদ্ধতিগত লুট। বিতরণ কোম্পানিগুলো নিয়ম করে ওই অর্থ গ্রাহকের কাছ থেকে নিচ্ছে। অথচ আবাসিকে যে পরিমাণ গ্যাস দিয়ে বিল নেয়ার কথা তা করা হচ্ছে না। শিল্পে যে চাপে গ্যাস দেয়ার কথা তাও দেয়া হচ্ছে না। অথচ মাসের পর মাস, বছরের পর বছর গ্রাহক ঠিকই অর্থ দিয়ে যাচ্ছে। আশঙ্কার বিষয় হলো, গোটা বিষয়টিই একটি সিস্টেমের মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে সিস্টেম গেইন দেখিয়ে ওই গ্যাসের অর্থও তুলে নেয়া হচ্ছে। সিস্টেম লসের গ্যাস কোথায় কীভাবে নষ্ট হয় তার প্রকৃত কারণ জানা যায় না। অথচ সিস্টেম লসের নামে ওই চুরি কমানো গেলে স্পট থেকে এলএনজি আমদানি করার প্রয়োজন পড়তো না।
এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান জানান, সিস্টেম লস কমিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক যে মান আছে তা বজায় রাখাই পেট্রোবাংলার লক্ষ্য। আর ওই লক্ষ্য পূরণে ইতোমধ্যে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। তার মাধ্যমে ব্যাপক হারে গ্যাসের অবৈধ সংযোগ উচ্ছেদ করা হচ্ছে। তাছাড়া একটি বছরকে তিনটি প্রান্তিক ভাগ করে সিস্টেম লস কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে সন্তোষজনক ফলাফলও পাওয়া যাচ্ছে। তার মধ্যে প্রথম প্রান্তিকে ৮ শতাংশ, দ্বিতীয় প্রান্তিকে ৭ শতাংশ এবং তৃতীয় প্রান্তিকে ৬ শতাংশে সিস্টেম লস নামিয়ে আনা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সেটি আরো কমিয়ে আনা হবে।