April 24, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Monday, February 13th, 2023, 8:27 pm

তুরস্ক-সিরিয়ায় ভূমিকম্প: ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় বেঁচে যাওয়া হাজারো মানুষ

এপি, তুরস্ক :

এক সপ্তাহ আগে তুরস্ক ও সিরিয়ায় আঘাত হানা ভূমিকম্প থেকে বেঁচে যাওয়া কয়েক হাজার মানুষ নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা ও অনিশ্চয়তায় ভুগছেন।

যদিও অনেককে বিধ্বস্ত অঞ্চল থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে, তবে অনেকেই এখনও নিজেদের ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িতেই অবস্থান করছেন এবং নিখোঁজ প্রিয়জনের সন্ধান অব্যাহত রেখেছেন।

উদ্ধারকারীরা প্রথম ভূমিকম্পের ১৭৪ ঘন্টা পরে একজন নারীকে জীবিত খুঁজে পেয়েছেন।

গত ৬ ফেব্রুয়ারি ৯ ঘণ্টার ব্যবধানে দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্ক এবং উত্তর সিরিয়ায় ৭ দশমিক ৮ ও ৭ দশমিক ৫ মাত্রার দুটি ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। এ ভূমিকম্পে ৩৫ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। উদ্ধার অভিযান এখনও অব্যাহত রয়েছে, মৃতের সংখ্যা আরও বাড়ার অশঙ্কা করা হচ্ছে।

সোমবার ইস্তাম্বুলের আন্তাকিয়া শহরের একটি ধসে পড়া ভবন থেকে উদ্ধারকারীরা নাইদে উমায় নামে এক নারীকে উদ্ধার করেন।

এর আগে, গাজিয়ান্তেপ প্রদেশের ইসলাহিয়ে শহরে একটি পাঁচতলা ভবনের ধ্বংসাবশেষ থেকে ৪০ বছর বয়সী এক নারীকে এবং আদিয়ামান প্রদেশের বেসনিতে ৬০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধকে উদ্ধার করে।

ভূমিকম্প আঘাত হানার এক সপ্তাহ পরেও, অনেক মানুষ এখনও আশ্রয়হীন অবস্থায় রাস্তায় দিন কাটাচ্ছে। কিছু জীবিত ব্যক্তি এখনও তাদের প্রিয়জনের লাশ উদ্ধারের জন্য ধসে পড়া ভবনের সামনে অপেক্ষা করছেন।

মালটায়া প্রদেশের পোলাট গ্রামে ভূমিকম্পের কেন্দ্র থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার (৬২ মাইল) দূর পর্যন্ত প্রায় কোনও বাড়িই অবশিষ্ট নেই।

বাসিন্দারা ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়ি থেকে রেফ্রিজারেটর, ওয়াশিং মেশিন এবং অন্যান্য জিনিসপত্র উদ্ধারের চেষ্টা করছেন।

স্থানীয় বাসিন্দা জেহরা কুরুকাফা বলেছেন, পর্যাপ্ত তাঁবু আসেনি, তাই যা পাওয়া গেছে তাই-ই চারটি পরিবার ভাগ করে নিতে বাধ্য হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চারটি পরিবার খোলা আকাশের নিচে মাটিতে ঘুমাই, কারণ পর্যাপ্ত তাঁবু নেই।’

আদিয়ামান শহরে ২৫ বছর বয়সী মুসা বোজকার্ট তাকে এবং অন্যদের পশ্চিম তুরস্কের আফিয়ন শহরে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছেন।

বোজকার্ট বলেন, ‘আমরা চলে যাচ্ছি, কিন্তু আমরা সেখানে যাওয়ার পর আমাদের কী হবে তা আমরা জানি না।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের কোন লক্ষ্য নেই। আমার বাবা-চাচা কেউ বেঁচে নেই। আমার আর কি বাকি আছে।’

আদিয়ামানের কৃষক ফুয়াত একিনসি (৫৫) ধ্বংস হওয়া সত্ত্বেও তার বাড়ি ছেড়ে যেতে অনিচ্ছুক।

তিনি বলেন, তার অন্য কোথাও বসবাস করার উপায় নেই এবং তার খেতগুলো দেখাশোনা করা দরকার।

তিনি বলেন, ‘যাদের সামর্থ্য আছে তারা চলে যাচ্ছে, কিন্তু আমরা দরিদ্র। সরকার সেখানে গিয়ে এক-দুই মাস বাস করতে বলছে। আমি কিভাবে আমার বাড়ি ছেড়ে যাব? আমার খেত এখানে, এটা আমার বাড়ি, আমি কিভাবে এটা রেখে যাব?’

তুরস্ক জুড়ে স্বেচ্ছাসেবকরা কয়েক লাখ জীবিত মানুষকে সাহায্য করার জন্য একত্র হয়েছে। যার মধ্যে একদল স্বেচ্ছাসেবক শেফ এবং রেস্তোরাঁর মালিকরা ঐতিহ্যবাহী খাবার যেমন- মটরশুটি, চাল ও মসুর ডালের স্যুপ শহরের কেন্দ্রস্থলে আশ্রয় নেয়া মানুষদের জন্য পরিবেশন করছেন।

যদিও স্বেচ্ছাসেবীরা উদ্ধার তৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন।

তবে মেক্সিকো ন্যাশনাল অটোনোমাস ইউনিভার্সিটির ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এডুয়ার্ডো রেইনোসো অ্যাঙ্গুলো বলেছেন, জীবিত মানুষ খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা ‘এখন খুব কম।’

রেইনোসো বলেছেন, ধ্বংসাবশেষে আটকে থাকা লোকদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা পাঁচ দিন পরে কমে যায় এবং ৯ দিন পরে তা শূন্যের কাছাকাছি নেমে আসে, যদিও ব্যতিক্রম কিছু ঘটতেও পারে।

ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের জরুরি পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার অধ্যাপক ডেভিড আলেকজান্ডারও রেইনোসোর সঙ্গে একমত হয়েছেন।

তিনি বলেছেন, ধ্বংসস্তূপ থেকে মানুষকে জীবিত উদ্ধারের আশা ‘প্রায় শেষ’।

আলেকজান্ডার বলেন, অনেক বিল্ডিং এতটাই বাজেভাবে তৈরি করা হয়েছিল যে সেগুলো খুব ছোট ছোট টুকরোয় ভেঙে পড়েছিল, খুব কম জায়গাই মানুষের বেঁচে থাকার মতো যথেষ্ট জায়গা ছিল।

তিনি বলেন, ‘সাধারণভাবে বলতে গেলে আমরা ধ্বংসস্তূপের মধ্যে খোলা জায়গা খুঁজে পাই, যেখানে আমরা সুড়ঙ্গ করতে পারি। তবে তুরস্ক ও সিরিয়ার এই ছবিগুলোর মধ্যে কয়েকটির দিকে তাকালে আমরা এমন কোনো জায়গা দেখতে পাইনি।’

শীতকালীন তাপমাত্রা দুর্ঘটনাকবলিত মানুষদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা আরও কমিয়ে দিয়েছে। এই অঞ্চলের তাপমাত্রা রাতারাতি মাইনাস ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস (২১ ডিগ্রি ফারেনহাইট) এ নেমে গেছে।

ভার্জিনিয়া টেকের ইমার্জেন্সি মেডিসিনের অধ্যাপক ড. স্টেফানি লারেউ বলেছেন, ‘হাইপোথার্মিয়া থেকে শরীরকে বাঁচিয়ে রাখার সাধারণ উপায় হল কাঁপুনি এবং কাঁপুনির জন্য প্রচুর ক্যালোরির প্রয়োজন হয়। ‘সুতরাং জীবিত কেউ যদি এতদিন খাবার না খেয়ে থাকে এবং এতটা শীতল তাপমাত্রার সংস্পর্শে থাকে, তবে তারা হয়তো হাইপোথার্মিয়াতে আরও দ্রুত মারা যাচ্ছে।’

তুরস্কের বিশাল ধ্বংসযজ্ঞের জন্য অনেকেই ত্রুটিপূর্ণ নির্মাণ কাঠামোকে দায়ী করেছেন এবং কর্তৃপক্ষ ধসে পড়া ভবনের সঙ্গে জড়িত কন্ট্রাক্টরদের শনাক্ত করা শুরু করেছে।

কর্মকর্তারা বলেছেন, ভূমিকম্প অসহনশীল ভবন নির্মাণের জন্য কমপক্ষে ১৩১ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে তুরস্কে ভবন নির্মাণের জন্য নির্মাণ কোড থাকলেও কোডগুলো খুব কমই মানা হয়।

সিরিয়ায় জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি-জেনারেল মার্টিন গ্রিফিথস বলেছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সাহায্য প্রদানে ব্যর্থ হয়েছে।

রবিবার তুর্কি-সিরিয়ান সীমান্ত পরিদর্শন করে গ্রিফিথস বলেন, সিরিয়ানরা ‘আন্তর্জাতিক সাহায্যের সন্ধান করছে, যা আসেনি।’

তিনি বলেন, ‘আমরা এখন পর্যন্ত উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার জনগণকে সাহায্য করতে ব্যর্থ হয়েছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার এবং আমাদের দায়িত্ব হল এই ব্যর্থতা যত দ্রুত সম্ভব সংশোধন করা।’

হোয়াইট হেলমেট উদ্ধারকারী গ্রুপের মতে সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা দুই হাজার ১৬৬ জনে পৌঁছেছে।

সিরিয়ায় সামগ্রিক মৃত্যুর সংখ্যা শনিবার তিন হাজার ৫৫৩ জনে পৌঁছেছে। যদিও দেশের সরকার-নিয়ন্ত্রিত অংশগুলোতে মৃত্যুর সংখ্যা এক হাজার ৩৮৭ জনের বেশি আপডেট করা হয়নি। রবিবার পর্যন্ত তুরস্কের মৃতের সংখ্যা ছিল ৩১ হাজার ৬৪৩।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রধান তেদ্রোস আধানম গেব্রেয়েসাস সতর্ক করে বলেছেন, সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে বিপর্যয় আরও বাড়বে। যুদ্ধ, করোনা, কলেরা, অর্থনৈতিক পতন এবং এখন ভূমিকম্পের জটিল সঙ্কট এ অঞ্চলের কয়েক লাখ মানুষকে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।’