নিজস্ব প্রতিবেদক:
কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশে পাড়ি দেওয়ার চেষ্টার কোন শেষ নেই বাংলাদেশের অনেক মানুষের। এটি অনেকেরই স্বপ্ন। এই স্বপ্ন খারাপ নয়। দেশ থেকে যতো মানুষ বিদেশে কর্ম করবে দেশের রেমিট্যান্স ততো বৃদ্ধি পাবে। দেশ হবে সমৃদ্ধ। পাশাপাশি এসব পরিবারে আসবে স্বচ্ছলতা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে বিদেশে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে অনেকেই বিশেষকরে যুবকরা অবৈধ পথে পা বাড়াচ্ছেন। পড়ছেন পাচারকারীদের কবলে। এতে মৃত্যুর মুখে পতিত হচ্ছেন অধিকাংশই। পাশাপাশি দেশের সুনামও নষ্ট হচ্ছে।
অবৈধ পথে বিদেশে যাওয়ার জন্য পাচারকারীদের সবচেয়ে পছন্দের পথ হলও সাগরপথ। এই পথকে ধরা হয় অবৈধ অভিবাসনের সবচেয়ে বিপজ্জনক পথ হিসেবেও। পদে পদে মৃত্যুভয়। সাগরপথে পাড়ি দেয়ার আগেই আন্তর্জাতিক অপহরণকারী চক্রের কবলে পড়ে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়ে সর্বস্ব হারানো, এমনকি মৃত্যুর আশঙ্কাও অনেক। আবার ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ সাগর পাড়ি দিতে অভিবাসনেচ্ছুদের গাদাগাদি করে তুলে দেয়া হয় ছোট ছোট নৌকায়। প্রতিনিয়তই সাগরে এসব নৌকা উল্টে গিয়ে প্রচুর মানুষের মৃত্যুর তথ্য প্রকাশ হচ্ছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে। আবার বিপজ্জনক এ পথ পাড়ি দিয়ে গন্তব্য দেশে পৌঁছলেও রয়েছে ধরা পড়ে জেল-জরিমানার ভয়। যদিও এসবের কোনো কিছুরই ভয় থামাতে পারছে না ভয়ংকর এ যাত্রাকে। ইউরোপে প্রবেশের ক্ষেত্রে সাগর পাড়ি দেয়ার আগে বাংলাদেশ থেকে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের নিয়ে যেতে ভারত-শ্রীলংকা-লিবিয়া, দুবাই-জর্ডান-লিবিয়া ও দুবাই-তুরস্ক-লিবিয়া এ তিনটি রুটকে বেছে নেয় মানব পাচারকারীরা।
অবৈধ অভিবাসন বন্ধে সরকার যে পদক্ষেপ নিচ্ছে না তা কিন্তু নয়, কিন্তু তারপরও সমুদ্রপথে অনেকেই ইউরোপের দেশে পাড়ি দিচ্ছেন চুপিসারে, এবং অনেককে মৃত্যুও বরণ করে নিতে হচ্ছে। কভিডের কড়াকড়িতেও থেমে নেই সমুদ্রপথে অবৈধ অভিবাসনের প্রয়াস। মহামারী পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করেই ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে অবৈধভাবে প্রবেশের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন অনেক বাংলাদেশী। অনেকে ধরাও পড়েছেন। জার্মানিভিত্তিক তথ্য সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টার পরিসংখ্যান বলছে, গত বছর ১১ মাসে (জানুয়ারি-নভেম্বর) সাগরপথে শুধু ইতালিতে প্রবেশের চেষ্টা চালাতে গিয়েই আটক হয়েছেন ৭ হাজার ৩৬ জন বাংলাদেশী।
সমুদ্রপথে বিদেশে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের মতো বাংলাদেশেও ‘বোট মাইগ্রেশন’ বহুল প্রচলিত হয়ে গেছে। উন্নত জীবনের প্রত্যাশায় অভিবাসনের উদ্দেশ্যে মানব পাচারকারী বা দালালদের প্ররোচনায় ছোট নৌকা বা ভেলার মাধ্যমে সমুদ্র পাড়ি দেয়াকেই বোট মাইগ্রেশন বলছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, এভাবে মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে ইতালি কিংবা গ্রিসে অভিবাসনের চেষ্টা করেন মূলত যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া, আফগানিস্তান, ইরাক অথবা সাব-সাহারা অঞ্চলের কিছু দেশের অধিবাসীরা। তবে ইউরোপে অভিবাসনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশীদের কাছেও গত এক দশকে ভয়ংকর এ রুট প্রাধান্য পেয়ে আসছে।
দেশে স্বচ্ছল জীবন যাপনের জন্য উপযুক্ত চাকরি জোগাড় কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্য করতে না পেরেই বেশিরভাগ যুবক একরাশ স্বপ্ন নিয়ে বিদেশযাত্রার উদ্দেশ্যে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার ভয়ংকর ও অবৈধ ঝুঁকি নিচ্ছেন বলে জানা যায়। এজন্য তাঁরা দ্বারাস্ত হচ্ছেন পাচারকারীদের দুয়ারে। এর শুরুটা হয়েছিল ২০১০ সালের দিকে। সে সময় লিবিয়ায় অনেক বাংলাদেশী কর্মী বিভিন্ন খাতে কাজ করতেন। পরবর্তী সময়ে লিবিয়ায় যুদ্ধ শুরু হলে ফেরত আসতে শুরু করেন বাংলাদেশী কর্মীরা। তবে বড় একটি অংশ আটকা পড়েন। তারাই মূলত প্রথম অবস্থায় যেকোনো পন্থায় ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করেন। তখন থেকেই লিবিয়া হয়ে সমুদ্রপথে ইউরোপে প্রবেশের পথটা জনপ্রিয় হতে থাকে। পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয় মানব পাচার চক্র, যারা বাংলাদেশ থেকে হতাশাগ্রস্ত তরুণদের চুক্তিতে ইউরোপে নিয়ে যেতে শুরু করে। অনেকে ধরা পড়েন। অনেকের মৃত্যু হয়। অল্প কিছুসংখ্যক ইতালি পৌঁছতে সমর্থ হন। যাদের সাফল্য দেখে আরো হাজারো বাংলাদেশী তরুণ ঝুঁকিপূর্ণ এ পথে যাত্রা করতে আগ্রহী হচ্ছেন। তারা মনে করেন, কোনোভাবে দেশটিতে যেতে পারলে একপর্যায়ে বৈধতা পাওয়া যাবে। যদিও বাস্তবতা পুরোই উল্টো। কেননা অবৈধদের ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে স্বাক্ষরিত স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউরসের (এসওপি) আওতায় বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে।
অবৈধ পথে উত্তাল সাগর পাড়ি দিতে মারা যাচ্ছে অসংখ্য প্রাণ। সর্বশেষ ২৫ জানুয়ারি ইতালিতে অভিবাসন প্রত্যাশায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়ার পথে ধরা পড়েন ২৮৭ জন। এর মধ্যে ২৭৩ জনই বাংলাদেশী। যাদের মধ্যে আবার সাতজন বাংলাদেশী ঠা-াজনিত রোগে নৌকাতেই মারা গেছেন। অসাধু মানব পাচারকারী চক্র তাদের ওই বিপৎসংকুল পথে নিয়ে গেছে বলে জানিয়েছে রোমের বাংলাদেশ মিশন। ওই দুষ্ট চক্র থেকে সাবধান থাকতে দেশের তরুণদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন রোমে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শামীম আহসান।
কিন্ত বিদেশ যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর বাংলাদেশিরা এসব সাবধানতা বাণী কর্ণপাত করছেন না। দালালদের খপ্পরে পড়ে জীবন ও অর্থ দুইই হারাচ্ছেন। এ বিষয়ে প্রবাসী বাংলাদেশী কর্মীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা ওয়ারবে ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন সৈয়দ সাইফুল হকের ভাষ্য, তরুণদের ঝুঁকিপূর্ণ বোট মাইগ্রেশনে যারা উদ্বুদ্ধ করছেন, তাদের আমরা ড্রিম সেলার বলি। মৃত্যুঝুঁকি থাকার পরও ইউরোপে নিরাপদ জীবনযাত্রার স্বপ্ন বিক্রি করছেন তারা। আবার সমুদ্রপথে ঝুঁকি নিয়েও যারা বোট মাইগ্রেশনে যাচ্ছেন, তারা কেউই কিন্তু গরিব ঘরের সন্তান নন। দালালদের মাধ্যমে এ পথে ইউরোপে প্রবেশ করতে ১৮-২০ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। কেউ হয়তো ছোট ব্যবসা, দোকান বিক্রি করছেন, কেউ কৃষিজমি বিক্রি করে দিচ্ছেন। একটাই স্বপ্ন, কোনোভাবে ইউরোপে প্রবেশ করতে পারলেই আবার সব পাওয়া যাবে। কেউ কেউ সফলও হচ্ছেন। তবে সে সংখ্যা খুবই কম। আর সে সফলতা দেখে আরো হাজারো তরুণ এ পথে পা দিচ্ছেন। তরুণদের এ ভয়ংকর যাত্রা রুখতে দেশে কর্মক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। একই সঙ্গে দালাল মাফিয়া চক্রকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সাক্ষীর অভাবে দোষীরা ছাড়া পেয়ে যায়।
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, এভাবে অবৈধ পথে বিদেশে পাড়ি জমাতে গিয়ে ধরা পড়া, কিংবা পথিমধ্যে মারা যাওয়ার কারণে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের মর্যাদা বিনষ্ট হচ্ছে। এজন্য বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়- সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিও। কমিটির গত জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকের আলোচনায় বলা হয়, অবৈধভাবে সমুদ্রপথে মানব পাচারের ঘটনায় বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হচ্ছে। বৈঠকে সমুদ্রপথে অবৈধভাবে বিদেশ গমন রোধকল্পে পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় নিয়ে যৌথ কমিটি করে দায়ী সংশ্লিষ্ট এজেন্সিগুলোর লাইসেন্স বাতিলের পাশাপাশি আইন অনুযায়ী যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করার সুপারিশ উঠে আসে। একই বৈঠকে অবৈধ অভিবাসীদের দেশে ফেরত নিয়ে আসার পর রিমান্ডে তথ্য সংগ্রহ করে তাদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয় বলে জানা গেছে।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ